পূর্বানুবৃত্তি: দেবলের স্ত্রীর কাছে প্রভূত তিরস্কার শোনার পর গভীর অস্বস্তিতে পড়ে পল্লবী, কিন্তু তার উদ্দেশ্য পরিবর্তিত হয় না। অন্য দিকে ট্যুরিজ়ম গেস্ট হাউসে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে ট্যুরিস্ট গাইড অসিতকুমারের সঙ্গে বিষ্ণুপুরের নানা দ্রষ্টব্য স্থান ঘুরে দেখলেন দীপঙ্কর, দীপ ও জ্যোৎস্নাদেবী। ট্যুরিস্ট লজে ফিরে আসার পর জ্যোৎস্নাদেবীর সঙ্গে দেখা হল জনমেজয়ের। ওঁকে চিনতে পারলেন তিনি। জ্যোৎস্নাদেবীর মনে পড়ে গেল এক সঙ্গে অভিনয় করার স্মৃতি। রাতে দীপঙ্করের বাড়ি ফিরলেন জ্যোৎস্নাদেবী। অনেক রাতে বাড়ি ফিরলেও পল্লবী যথেষ্ট সৌজন্যপূর্ণ ব্যবহার করল জ্যোৎস্নাদেবীর সঙ্গে। তাঁর রান্না করা খাবার খেল, একই সঙ্গে ঘুমোলও। শেষরাতে ঘুম ভাঙার পর জ্যোৎস্নাদেবীর মনে ভেসে উঠল বিবাহিত নায়কের সঙ্গে যাপন করা তাঁর সংসারজীবনের কিছু অন্ধকার অংশের কথা।
কলকাতা সংস্কৃতির শহর। জাত অভিনেতার কদর করে, কিন্তু ফুরিয়ে গেলে খুব সহজে ভুলে যায়। তিনি একাই তাঁর ভেলা ভাসিয়ে দিলেন বেহুলার মতো। এ বার বেহুলা আর মৃত লখিন্দরের জীবনে ফিরে আসায় প্রত্যাশী নন। ধীরে ধীরে স্বামী মুছে যাচ্ছিল। কিন্তু নতুন কোনও পুরুষের প্রেমে পড়লেন না। এর চেয়ে বন্ধুত্ব শ্রেয়। সময় বদলাচ্ছে, যুগও। সাদা-কালো টেলিভিশনের যুগ এল, কিন্তু দর্শক তখনও থিয়েটারমুখী। নামীদামি নাট্যব্যক্তিত্বের চোখে পড়লেন, প্রশংসা পেলেন। বিরাটিতে জমি কিনে বাড়ি তৈরি শুরু করালেন। তখন সাধনের বাবা দিলীপ গাড়ি চালাত। পরে সাধনও এল।
অবশেষে বিনা আমন্ত্রণে তিনি ফিরলেন। নিঃস্ব, কপর্দকহীন, অভিনয় তো ভুলেই গেছেন। গলায় কীর্তনের একঘেয়ে সুর। কঠিন হলেন জ্যোৎস্নাদেবী। বললেন, “টাকা তো সব রক্ষিতার পিছনে শেষ করে এসেছ। এখানে থাকতে হলে বাড়িটা হচ্ছে, দেখাশোনা করবে। প্রয়োজনে মজুরদের সঙ্গে কাজ করবে। রাজি থাকলে বলো, না হলে বিদেয় হও।”
রাজি না হয়ে তখন উপায় কী! রাজি হলেন, যত্নও পেতে শুরু করলেন। মেয়েমানুষের মন, এক বার যে সিঁদুর পরিয়েছে, তাঁকে অবজ্ঞা করা তো সম্ভব নয়। কিন্তু মানুষের জীবনযাপন প্রতিশোধ নেয়। প্রথমে সিফিলিস, তার পর অ্যালঝাইমার’স। শেষ জীবনে তক্তপোশ আর কল্পিত নবকার্তিকের টপ্পা। গলায় সুর ছিল। ঈশ্বর সব কিছু কেড়ে নিলেন, শুধু সুর নতুন করে দিলেন গলায়। টপ্পা, খেউড়, হাফ খেউড়। শ্রোতা বলতে একমাত্র তিনি। বাড়িটার নাম নিজেই রেখেছিলেন ‘মিনার্ভা’, আপত্তি করেননি জ্যোৎস্নাদেবী।
আখড়া থেকে এক জন এক বার এসেছিলেন। ভাল মানুষ, নাম সন্তোষ। বলেছিলেন, “বড়বাবুকে ওরা ধ্বংস করে দিল, চোখের সামনে দেখলুম।”
জনমেজয় বলছিল, “নবকার্তিক বলে এক জন টপ্পা গায়ক গুপ্তিপাড়া থেকে কলকাতায় গেছিল সে কালে, কিন্তু হারিয়ে গেল। সবাই তো আর রামনিধি গুপ্ত, গোপাল উড়ে, মোহন বসু হতে পারেন না।”
পায়ে একটু লাগল। ডাইনিংটার আলো খুঁজে নিতে হবে। হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল।
দীপঙ্কর উঠে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছেন।
“মা, চলো চিলেকোঠার বাথরুমটা ভাল আছে। এই বাথরুমটা পল্লবী নোংরা করে রেখেছে।”
জ্যোৎস্নাদেবী চিলেকোঠার ঘরে উঠলেন। সামনে একটা খোলা ছাদ। দীপঙ্কর দুটো চেয়ার নিয়ে এসে রেখেছেন। টি-টেবিলে লিকার-চা।
দীপঙ্কর বললেন, “মা, বিস্কুট নেবে?”
“না, এখনও ভাল করে মুখ ধোয়া হয়নি।”
মা ও ছেলে চেয়ারে বসে চায়ে চুমুক দিলেন। মেঘেরা কখনও কখনও কালো, কখনও বা সাদা ভেসে চলেছে। কেয়াফুলের গন্ধ ভেসে আসছে।
জ্যোৎস্নাদেবী বললেন, “তোমাদেরও কেয়া ফুলের গাছ আছে?”
দীপঙ্কর বললেন, “না, মা। কাছেই একটা ঝিল রয়েছে, সেখানে কেয়াবন আছে। ভোরের হাওয়ায় গন্ধ ভেসে আসছে।... আচ্ছা মা, কয়েকটা দিন থেকে যেতে পারো তো!”
“তুমি অফিস যাবে তো?”
“এই বেরোব।”
“তখন আমি কী করব! আমিও তোমার সঙ্গে চলে যাব... কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগছে তোমার কাছে এসে!”
“কেন মা!”
“জীবনে এই চাহিদা অপূর্ণ ছিল। সন্তানের ভালবাসার চাহিদা।”
“বাড়ি গিয়ে কী করবে?”
“শিল্পীভাতার জন্য এক বার যেতে হবে তথ্য সংস্কৃতি দফতরে। ওরা খুব একটা সম্মান করে না। ওদেরও দোষ নেই। কত মানুষ, যাদের সঙ্গে শিল্পের কোনও যোগ নেই, সেখানে গিয়ে ভাতার জন্য বসে থাকে। অনেক ফড়ে বা দালালও থাকে।... আচ্ছা, তোমার মায়ের খবর জানো?”
“মারা গেছেন।”
“তোমায় জানিয়েছিল?”
“মুখাগ্নি করতে গিয়েছিলাম। দার্জিলিংয়ের একটি গ্রামে।”
“ছেলেমেয়ে আছে ওঁর?”
“অনেকগুলি ছেলেমেয়ে। মৃত্যুর আগে আমার কথা বলেছিলেন। অনেক খোঁজাখুঁজি করে ওরা এসেছিল। মুখাগ্নি করে ফিরে এসেছিলাম।”
এই সময় পল্লবী উঠে এল, অগ্নিমূর্তি।
হিসহিস করে বলল, “সকাল থেকে খোশগল্প শুরু হয়েছে! নরক গুলজার চলছে!”
দীপঙ্কর বললেন, “এ সব কী বলছ?”
“ওঁদের বিশ্বাস করা যায়! অভিনেত্রী বলে কথা! ছেলের সঙ্গেও শুতে পারে।”
“তোমার জগৎ শুধু বিছানায় শোয়া, তাই এ সব বলতে পারো!” শক্ত গলায় বললেন দীপঙ্কর।
পল্লবী এ বার জ্যোৎস্নাদেবীর দিকে তাকিয়ে বলল, “কী বলেন আপনি! রসের গল্প চলছিল তো?”
জ্যোৎস্নাদেবীর সুন্দর মুখের রেখাগুলো কঠিন। ভুরুতে ভাঁজ। তিক্ত গলায় বললেন, “তুমি আমায় নরম ভেবো না। দীপঙ্কর তোমায় ছেড়ে দিলেও আমি তোমায় ছেড়ে দেব না।”
পল্লবী বলল, “কী দেখবেন?”
“মানহানির মামলা করব।”
দীপঙ্কর বললেন, “ফ্ল্যাট হল! কত বার তো দেবলের সঙ্গে শুলে!”
“ইতর কোথাকার!” পল্লবী বলল।
জ্যোৎস্নাদেবী বললেন, “আমার ছেলের যদি কোনও ক্ষতি করো, আমি তোমাকে কখনও ক্ষমা করব না। মনে রেখো কথাটা।”
পল্লবী গজগজ করতে করতে নীচে চলে গেল। সকালের সুর তত ক্ষণে কেটে গেছে।
দীপঙ্করও অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেলেন। জ্যোৎস্নাদেবীও উঠলেন।
দীপ উঠে পড়েছে, সে বলল, “ঠাম্মা, আবার আসবে কিন্তু!”
“আসব সোনা। তোমার আর তোমার বাবার জন্য আসতেই হবে।”
যেতে যেতে ওঁরা যখন ঝিল পার হলেন, কেয়াবনের ঝোপ থেকে বেরিয়ে সর্পদম্পতি ওঁদের অনুসরণ করতে করতে সর্পিল গতিতে সঙ্গ দিল। মা ও সন্তানের সঙ্গে চলেছে দুই সরীসৃপ— এ যেন পৃথিবীর চেনা দৃশ্য নয়। অপার্থিব না হলেও বড্ড অচেনা, কারণ এই পৃথিবীতে এখন লোভ, প্রতিহিংসা, রিরংসাটুকুই স্বাভাবিক হয়ে পড়ছে।
২৩
কয়েক মাস ধরে শিল্পীভাতা পাননি, সে কথা জানাতেই সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরে এসেছিলেন জ্যোৎস্নাদেবী। কাজ হয়ে যেতে সেই অফিস থেকে বেরিয়ে সামনে একটি চায়ের দোকান দেখে থমকে দাঁড়ালেন, সামনে এগিয়ে গেলেন।
বললেন, “মোহনা, তুই!”
দোকানে তখন একেবারেই খদ্দের ছিল না। চশমার কাচ মুছে নিয়ে সেই বৃদ্ধা ভাল করে দেখে বললেন, “আপনাকে... খুব চেনা লাগছে!”
“আমি জ্যোৎস্না। চিনতে পারছিস না!”
হঠাৎ সেই বৃদ্ধা কেঁদে উঠলেন।
জ্যোৎস্নাদেবী বললেন, “কাঁদছিস কেন?”
“দিদি, আমি নিঃস্ব আজ।”
“তোর পালিত পুত্রের জন্যই তো যাত্রা ছাড়লি। বললি সে এখন রেলে চাকরি পেয়েছে। শেষ অভিনয় করেছিলি শোভাবাজার রাজবাড়িতে।”
“হ্যাঁ দিদি, ব্রজেন দে-র পালা, ‘সোনাই দীঘি’।”
“ছেলে বিয়ের পর আর দেখে না, তুইও সর্বস্ব খুইয়েছিস, তাই তো!”
মোহনা বলল, “ছেলে চেষ্টা করেছিল খুব। নিরন্তর অশান্তিতে বিষও খেয়েছিল। দেখলাম, পথের কাঁটা হয়ে লাভ নেই। ও সুখে থাকুক।”
“এক বার আমার কাছে আসিস। আমরা বাতিলের দল নতুন করে শুরু করব।”
“আপনি বাতিল হতেই পারেন না।”
“তখনকার যাত্রাপালার সঙ্গে এখনকার অনেক তফাত। আজকের যাত্রায় গান থাকে না।”
“আহা, ‘চন্দ্রশেখর’ পালায় আপনার শৈবলিনী আজও চোখে লেগে রয়েছে যেন।”
“সে তুই ভালবাসিস বলে এ সব বলছিস।”
“দিদি, এক কাপ চা খাবেন?”
“না রে, বাড়ি গিয়ে রান্নাবান্না করতে হবে।”
“খাওয়া হয়নি এখনও! আপনাকে একটা ওমলেট করে দিই।”
“আমি তো নিরামিষ খাই।”
“দাদা তো মারা গেছেন। অনেকে বাংলার নবাব মীরকাশিমের চরিত্রে পঞ্চু সেনের কথা বলে, আমার কিন্তু দাদার অভিনয় বেশি ভাল লাগত।”
“সবটাই তোর ভালবাসা। আমি এখন যাই রে।”
“আচ্ছা দিদি, তোমায় একটা প্রণাম করি।”
প্রণাম নিলেন জ্যোৎস্নাদেবী। মোহনা অল্প দিন অভিনয় করলেও প্রতিভা ছিল।
বাড়ি গিয়ে একটু আলুভাজা করে নিলেন, ভাতটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। ডাকে একটা বই এসেছে। ‘বাংলার যাত্রা: সঙ্গ অনুষঙ্গ’।
পড়তে শুরু করবেন, এই সময় টের পেলেন বাইরে আলো মরে আসছে।
কয়েকটা পাতা উল্টে একটু এগিয়ে গেলেন, চোখ আটকে গেল শান্তিগোপালের কাছে এসে। অমরদা নিয়ে গেছিলেন, তখন তিনি শিশু। বাবার ব্যাঙ্কে এসেছিলেন পালাকার অমর ঘোষ। সে দিন জ্যোৎস্না গেছে বাবার সঙ্গে। বয়স পাঁচ বছর হবে।
বাবা বললেন, “অমরদা, শুনছি শান্তিগোপাল নাকি আসছেন?”
তখনও অমরদাকে জানার বয়স নয়। স্মৃতিও কিছুটা আবছা। হয়তো ভবিষ্যতে যাত্রায় আসবেন বলে এইখানটায় এসে মনোযোগ আটকে গেল।
১৯৬৮। আসছে ‘হিটলার’। যাত্রাপালায় নতুন যুগের সূচনা। যাত্রার খোলা আসরে আসছে অস্ট্রাম, আলো, মাইক্রোফোন টেপরেকর্ডার। সব এক সঙ্গে এল ‘হিটলার’-এ। প্রবেশ আর প্রস্থান আলাদা করা হল। সে এক অদ্ভুত সময়, বাংলা যাত্রার স্বর্ণযুগ। দর্শকও বিপুল ভাবে গ্রহণ করেছিল শান্তিগোপালকে।
এর পর লেনিন, রাজা রামমোহন, নেপোলিয়ন, ওথেলো, কার্ল মার্কস। অনেক পরে অমরদার সঙ্গে যখন দেখা হল তিনি বেশ প্রবীণ। জ্যোৎস্নাও অভিনেত্রী হিসেবে বেশ নামডাক করেছেন। অমরদা সোভিয়েট ল্যান্ড পুরস্কার পেয়েছিলেন। রাজা রামমোহন দেখতে উত্তর কলকাতায় মদনমোহনতলায় এসেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী, নতুন ধারার রাজনৈতিক যাত্রায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল।
আর যাত্রাজগতে আলোড়ন তোলা সেই অপেরার নাম ছিল তরুণ অপেরা।
যাত্রাকে যাত্রা রেখেই প্রগতি আনবেন— এই কথাটার সঙ্গে দ্বন্দ্ব করে বেঁচে থাকতে হয় শিল্পীকে। আসলে দুটো এক সঙ্গে বাঁচানো যায় না। আজ যে যাত্রা ভিন্ন রুচির হল, তাও যদি টিকে থাকে, শিল্পটা একেবারে হারিয়ে যাবে না। এক বার ‘সাহেব বিবি গোলাম’ যাত্রায় রূপদান করবেন ভেবেছিলেন, তখন তিনি শিল্পীতীর্থে। লেখক বিমল মিত্রের সঙ্গে চেতলায় দেখা করতে গেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, “মা, পারলে মন দিয়ে কোরো। কেউ কখনও অমর হয় না। আমিও তো ভেবেছিলাম ‘সাহেব বিবি গোলাম’ লিখে একদিন অমর হব।”
হয় না, সবটাই ক্ষণস্থায়ী। নট-নটীর দেহ, লাবণ্য, সে দিনের স্টেজ সব সব চোখের নিমেষে মিলিয়ে যায়। কত আশা করে একদা হয়েছিল সারকারিনা। সে দিন তা ছিল স্বপ্নের নির্মাণ। পেশাদার যাত্রায়, সারকারিনা এক আবির্ভাব। দীর্ঘশ্বাস পড়ল জ্যোৎস্নাদেবীর।
আহা, কেয়া ফুলের সুবাস আসছে। রাতের রানি জেগে উঠছে।
খুব ভোরে ওঠেন তিনি। যখন ভোরের জানলার কাছে বসেন, কেয়া তার শেষ সুগন্ধি হাওয়ায় মাখিয়ে দেয়। ভ্রমরেরা আসে মধুর লোভে। না, কেয়ার কোরকে মধু থাকে না। তার গন্ধ শুধু কীট দংশনের জন্য। কীটে আক্রান্ত কেয়ার বুক থেকে শব্দ বেরোয় না, কারণ সে যে রাতের রানি। উপভোগের জন্য সৌন্দর্য মেলে দেয় বিনা প্রতিবাদে।
সকাল হচ্ছে একটু একটু করে। এক সময় এই ভোরের জানলায় কত কিছু দেখা যেত। আদিগন্ত সবুজ মাঠ ছিল। এখন শুধু বাড়ি আর বড়ি। একের পর এক সুরম্য অট্টালিকা। পাখি ডাকছে প্রচুর। ভোর হলেই ডাকে নাম-না-জানা সব পাখি। এখনও সামান্য কিছু সুপুরি, নারকেল গাছ আছে। যে দিন মানুষের লোভে সমস্ত গাছ লুপ্ত হবে, পৃথিবী ব্যাপ্ত হবে কার্বন ডাইঅক্সাইডে, পাখি আর আসবে না।
অমর ঘোষদা বলেছিলেন, “তুমি তো বটানির ছাত্রী, তাই না?”
তিনি মাথা নেড়ে বলেছিলেন, “হ্যাঁ।”
“কোন কলেজে পড়ো?”
“হাওড়া নরসিংহ দত্ত কলেজ।”
“তোমাদের বাড়ি তো হাওড়ায়? খুব প্রাচীন শহর। ওখানে একটি বাড়ি ভাঙার সময় লেখক বিমল মিত্র ছোট রানির কঙ্কাল দেখতে পান, গলায় সাতনরি হার। সেই ‘সাহেব বিবি গোলাম’ উপন্যাসের সূত্রপাত। পড়েছ?”
মাথা নেড়ে তিনি বলেছিলেন, “হ্যাঁ।”
তবে বিমল মিত্র এ রকম কিছু দেখেই লেখা শুরু করেন, বিশ্বাস হয়নি জ্যোৎস্নার। মুখে কিছু বলেননি।
“যদি ‘সাহেব বিবি গোলাম’ যাত্রা হয়, তুমি কার রোল করতে চাও!”
“ছোট রানি।”
“আমরা করব। তবে এখন কাস্টিং-এ রয়েছেন জ্যোৎস্না দত্ত।”
“যাত্রাসম্রাজ্ঞী!”
“হ্যাঁ। তোমার নামটা বদলে নেবে?”
“না। আমি আমার মতো অভিনয় করে জায়গা তৈরি করব।”
“খুব কনফিডেন্স। কিন্তু লেখাপড়া করে অধ্যাপনা করতে পারতে। ডব্লুবিসিএস দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হতে পারতে। অনেক সহজ পথ।”
“অভিনয় আমার ভাল লাগে। আমি শিখতে চাই, কিছু পেতে চাই না এই জগৎ থেকে।”
“মনে রেখো কথাটা। অনেক অপমান, তিরস্কারের পর সামান্য সম্মান, যশ আসবে। তুমি রূপবতী, ভ্রমরেরা আসবে মধু আহরণে। তখনকী করবে?”
চুপ করে ছিলেন জ্যোৎস্নাদেবী।
“কত অভিনেত্রী ওই পঙ্কিল পথে হারিয়ে গেছেন। দেহসুখ উপভোগ করতে গিয়ে নিজেই কখন বহু পুরুষের ভোগ-লালসার সামগ্রী হয়ে গেছেন। হয় আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন, অথবা উন্মাদিনী হয়ে পথে পথে ভিক্ষা করেছেন।”
শিউরে উঠেছিলেন তিনি।
“ভয় পেলে! তোমাকে সাবধান করলাম। তোমার জীবন তোমারই। একটা কথা বলি!
“বলুন না!”
“যাত্রার বিষয়ে অপ্রাসঙ্গিক। তুমি বটানির ছাত্রী তো, তাই জানার লোভ হচ্ছে।”
“বলুন না দাদা!”
“কেয়া বা কেতকীর বৈজ্ঞানিক নাম জানো?”
জ্যোৎস্না উত্তর দিয়েছিলেন, “প্যান্ডানাস টেকটোরিয়াস। প্যান্ডানেসি ফ্যামিলির উদ্ভিদ।”
“কোন কোন দেশে দেখা যায়?”
“মালয়েশিয়া, পূর্ব অস্ট্রেলিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ।”
কেয়াপাতার কিনারাগুলিতে খুব ধার। একেবারে করাতের মতো। সেই ধার তো জ্যোৎস্নারও ছিল। বাড়াবাড়ি করলে রক্তাভ হয়েছেন অনেকেই। তখন যাত্রায় শিক্ষিতা মেয়ে থাকত না। প্রথম প্রথম রিহার্সালে অনার্সের বইগুলিও সঙ্গে থাকত।
পশ্চিম বাংলায় কেয়া বর্ষার ফুল। কেয়া ফুলের তেল থেকে অনেক কিছু হয়। ভেষজ গুণও আছে। শুধু মধু নেই। রাশি রাশি কাঁটা। কত ভ্রমরের মৃত্যু হয় ভুল করে কেয়ায় মধু পান করতে এসে।
অমরদা বলেছিলেন, “তুমি তো ভাল ছাত্রীও। আমার মনে হয় যাত্রায়ও তুমি অনেকটাই যাবে।”
ক্রমশ
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)