Advertisement
E-Paper

তিন রাজপুত্তুর

যে বনে সিংহমশাই নেই, সেখানে বাঘকেই সকলে রাজা মানে। পাহাড়ের পাদদেশে এমনই এক ঘন বন। সেখানে উঁচু উঁচু গাছ। মোটা গুঁড়ি। তাদের গায়ে কবেকার সবুজ শ্যাওলা। ঝুরি ঝুরি লতা ওই সব গাছের গা বেয়ে উঠেছে তো ঠিকই, এক গাছ থেকে অন্য গাছ, তার পর আবার একটা গাছ ধরে ধরে সব যেন নদী দেখতে বেরিয়েছে।

তিলোত্তমা মজুমদার

শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:১১
ছবি: সুমন চৌধুরী।

ছবি: সুমন চৌধুরী।

যে বনে সিংহমশাই নেই, সেখানে বাঘকেই সকলে রাজা মানে। পাহাড়ের পাদদেশে এমনই এক ঘন বন। সেখানে উঁচু উঁচু গাছ। মোটা গুঁড়ি। তাদের গায়ে কবেকার সবুজ শ্যাওলা। ঝুরি ঝুরি লতা ওই সব গাছের গা বেয়ে উঠেছে তো ঠিকই, এক গাছ থেকে অন্য গাছ, তার পর আবার একটা গাছ ধরে ধরে সব যেন নদী দেখতে বেরিয়েছে। সেই সবুজ বনে সবুজ টিয়ার ঝাঁক। তারা সব হাঁকডাক চেঁচামিচি করে বনময় বলে বেড়াতে লাগল শোনো শোনো শোনো/বাঘরানিমার ছানা/সুন্দর তিনখানা/হলুদ-কালো কালো-হলুদ/ডোরায় ডোরা টানা।

আসলে কিন্তু সব ক’টি বাচ্চাই প্রায় একরকম দেখতে। জন্মের পরে তারা ছিল লোমের দলা। তিন জন জট পাকিয়ে মায়ের বুকে গুটিসুটি মেরে থাকত। এখন তারা দিব্যি খেলে বেড়ায়। মিছিমিছি মারামারি করে নিজেরাই। একটু-আধটু মাংসও খায়। আর দেখতে যে কী ফুটফুটে! যে দেখে সেই মুগ্ধ হয়ে ভাবে, এই না হলে রাজপুত্তুর!

এক দিন রাজামশাই বাঘ গিয়েছেন শিকার করতে। জঙ্গলের মধ্যে একটু মাঠ, সেখানে বাঘিনীরানি রোদ পোয়াচ্ছেন। ডোরার ভাই ডুরি বলল, ‘আজ বাবা হরিণ মেরে আনবে।’

আরেক ভাই ডুরে বলল, ‘আমি বলছি খরগোশ।’

‘তুই একটা বুদ্ধু।’ ডোরা বলল, ‘একটা খরগোশে আমাদের পেটই ভরবে না! বাবা ঠিক একটা বাইসনের বাচ্চা আনবে।’

‘হাতির বাচ্চাও আনতে পারে।’

‘আচ্ছা আচ্ছা, যা পাবেন, আনবেন এখন। তোমরা মন দিয়ে খেলো দেখি!’ বললেন রানি বাঘিনী। কিন্তু রাজপুত্ররা শিকার নিয়ে ভাবতে চাইছিল। ডোরা বলল, ‘আমি যখন বড় হব, আস্ত হাতি মারব।’

ডুরি বলল, ‘আমি মারব গণ্ডার। এক দিনে চারখানা। বানাব ভাণ্ডার।’

ডুরে বলল, ‘আমি দশটা শুয়োর মেরে দশ দিন ধরে খাব।’

অলস শয়ান ছেড়ে গা ঝেড়ে উঠে বসলেন বাঘিনী। ছানারা বড় হচ্ছে, এখনই তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার সময়। ভবিষ্যতে তারাই হবে বনের এক-একটি অঞ্চলের শাসক। ভালমতো আইন না শেখালে চলবে কেন? মুখ্যু রাজা দিয়ে কি শাসন চলে? তার পর, রাজা নিজেই যদি সারাক্ষণ লোভীর মতো খাই-খাই করে, সারা বনে অরাজকতা আসতে কতক্ষণ? তিনি গর্জন করে বললেন, ‘অ্যাইয়ো!’

তিন শাবক তো বাঘতাল্লাই ভুলে একেবারে জড়োসড়ো হয়ে গেল। বাঘিনীরানি বললেন, ‘আজ থেকে নীতিশিক্ষার ক্লাস চালু। কাল থেকে বাঘাঙ্ক, পশুবিজ্ঞান আর বাঘচালিশা পড়তে হবে। খাতা-কলম লাও।’

তিন ভাই ভূর্জপত্র আর খাগের কলম
নিয়ে বসল সারি সারি। কলমটা কান চুলকোনর জন্য। লেখালিখির কাজটা নখের আঁচড়েই হয় ভাল।

টিয়ার দল ট্যঁা ট্যঁা কিচির মিচির করে ফল খাচ্ছিল। বাঘিনী ছেলেদের শিক্ষে দিতে বসেছেন এই খবর বনময় রাষ্ট্র করার জন্য উড়াল দিল। বাঘিনী বলতে লাগলেন, ‘জঙ্গলের প্রাণীমাত্রই শান্তিপ্রিয়। তারা কদাপি লোভ করে না। কদাপি অকারণে অপর প্রাণীকে হত্যা করে না। জঙ্গলে লোভের দণ্ড কঠিন। সেই শাস্তি পাবার দশাকে সকলেই অসম্মানজনক মনে করে। তাই জঙ্গলে কেউ চোর নয়। আদেখলা কাঙালের মতো হাম হাম খাম খাম লুটপাটও কেউ করে না। আমিই সব একলা খাব, বাকিরা উপোস করে মরুক, এমন ভাবনা কারও নেই। যারা তৃণভোজী, তারাও যেমন হামলে খেয়ে বন সাবাড় করছে না, তেমনি, আমরা যারা শাকাহারী নই, মাংসাশী, আমরাও শিকার করি প্রয়োজন পড়লে। পেট ভরা থাকলে আমরা অহিংস। কাউকে কিচ্ছু বলি না।’

লেখাপড়া করতে করতে তিন রাজপুত্তুরের হাত ব্যথা। কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। কেবল খেলে বেড়ানোর দিন শেষ ভেবে একটু দুঃখুও হচ্ছে। কিন্তু তারাও
জানে লেখাপড়া করে যে, পশুপতি হয় সে। নইলে বোকার বোকা গাধাও পরামর্শ দিয়ে বলবে রাজামশাই, শুকনো ডাঙায় জাল ফেলুন। আপনি জাল ফেললে রুই-কাত্‌লা
না উঠে পারে!

রানি বাঘিনী তন্ময় হয়ে পড়াচ্ছিলেন। এমন তর্জনে-গর্জনে শিক্ষে চলছিল যে বনের আর সব পশুরাও চারুপাঠ নিতে লাগল। তখন ডুরে বলল মাগো, এ বার দে না মোদের ছুটি/খেলার বেলা ফুরিয়ে এল বনে। বাঘিনী গা ঝাড়া দিয়ে উঠে লেজটা শূন্যে দুলিয়ে শুঁক শুঁক বাতাস শুঁকে কী যেন কী বুঝলেন, বললেন, ‘বাছারা, চল তোদের জঙ্গলের আশপাশটা ঘুরিয়ে আনি।’

তিন ভাই ডোরা-ডুরি-ডুরে মায়ের গা ঘেঁষে বন দেখতে চলল। পাহাড়ের গায়ে এক জায়গায় যেন স্বচ্ছ কাচের দানা। বাঘিনী বললেন, ‘আয় আমরা নুন খেয়ে গুণ গাই।’

‘কার গুণ মা?’

‘যিনি সৃষ্টি করেছেন এই মহাবন, এমন সোন্দর পৃথিবী, কত না গাছপালা! যখন ভ্রমর গুনগুনিয়ে ফুলে ফুলে মধু খায়, হরিণছানা আপন মনে নাচে তখন মনে হয়, ধন্য সৃষ্টিকর্তা। কত না প্রাণী এ জগতে, তাদের সবার জন্য সব রকমের খাদ্য তৈরি।
চল বাছা, ওই নুন চেটে খাই। যখনই ফাঁক পাবি, খাবি এসে।’

ছানারা মায়ের সঙ্গে প্রাকৃতিক নুন খেল। আরও গভীর বনে একটি বড় গাছের তলে কেন কে জানে সরু সরু ডালপালা স্তূপ করা। বাঘরানিমা থমকে থেমে বলে উঠলেন, গররর! দাঁড়াও সবাই! বিপদ! তিনি ভাল করে চৌদিক চেয়ে, বাতাসের গন্ধ শুঁকে বললেন, ‘দ্যাখ বাবারা, ওই যে দেখছিস, ও হল ফাঁদ। ওইখানে আছে গর্ত। দুর্জনে ডালপালা কর্তন করে ঢেকে রেখেছে যেন কিচ্ছু না! নিরীহ প্রাণী না বুঝে যেই ওখানে যাবে, পড়বে গর্তে। আর দুর্জনেরা তাকে ধরে নিয়ে যাবে, ছাড়বে না কোনও শর্তে। অনেক সময় ছাগল-ভেড়া বেঁধে রেখে ব্যাঘ্রজাতিকে লোভ দেখায়! খুব সাবধান। চল, এ বার ঘরে ফিরি।’

ডোরা-ডুরে-ডুরি তিন ভাই গুটি গুটি চলতে লাগল। জগত্‌ যে কেবল খেলা, পড়া, খাওয়া আর আনন্দ নয়, সেখানে ফাঁদ আছে, দুর্জন, দুঃখ, দুর্দশা সেইটে জেনে তাদের ভারী কষ্ট হল! পরের দিন, লেখাপড়া করে, ভরপেট খেয়ে, তিন ভাই বলল, ‘মা, একটু ঘুরে আসি।’

বাঘিনীরানি রাজামশাইয়ের সঙ্গে কথা কইছিলেন। বললেন, ‘বেশি দূর যাস না যেন।’ তিন ভাই মাথা নেড়ে গলাগলি চলল। খানিক নুন খেয়ে, ফড়িং প্রজাপতি ধাওয়া করে, ঘাসে গড়াগড়ি খেয়ে গহীন বনে ঢুকে পড়ল। ডুরে দু’কান তুড়ুক তুড়ুক নাচিয়ে, ভ্রূজোড়া কুঁচকে বলল, ‘কে যেন কাঁদছে!’

‘ফাঁদে পড়েনি তো?’

‘তাই তো মনে হচ্ছে!’

তিন জনে ফাঁদের দিকে দৌড়ল। যা ভেবেছিল তাই। গর্তে পড়ে আছে এক হরিণশিশু। মা-মা করে কেঁদে আকুল। এমন গভীর বনে তার স্বর যেমন সরু তেমন ভয়তুরুতুরু। শোনা যাচ্ছে, আবার যাচ্ছেও না। কেউ কেউ শুনেছিল, যেমন একটা বনশুয়োর, কিন্তু এত সব ডালপালার তলায় যে গর্ত থাকতে পারে আর তাতে একটা বাচ্চা পড়ে যেতে পারে তার মাথাতেও আসেনি।

ডুরে বলল, ‘ভাই কেঁদো না। আমরা তোমাকে উদ্ধার করব।’

হরিণছানা কান্না ভুলে বড় বড় করুণ চোখে চেয়ে রইল।

তিন ভাই খুঁজে-পেতে একটি মোটা লতা সদ্য গজানো দাঁত দিয়ে কেটে আনল। তিন জনে তার এক প্রান্ত দাঁতে চেপে অপর প্রান্ত দিল গর্তে ঝুলিয়ে। হরিণছানা অষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিল সেই লতা। তিন রাজপুত্তুর প্রাণপণে টেনে-হিঁচড়ে তাকে তুলতে লাগল। কাজটা চাট্টিখানি নয়। গভীর গর্ত। তার ওপর তিন রাজপুত্তুরের অভিজ্ঞতাও নেই। তবু তারা হাল ছাড়ল না। একে অপরকে জড়িয়ে, টেনে, ঘেমে, নেয়ে তুলে আনল ছোট্ট হরিণকে। এমন সময় টিয়ার ঝাঁক এসেছিল সেই গভীর বনের পাকা ফল খেতে। তারা তো এই উদ্ধারকর্ম দেখল আগাগোড়া। তার পর উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বনময় রটনা করতে লাগল— বাঘের ছেলে বাঁচায় হরিণছানায়! বাঁদররাও সাক্ষী। তারা গেল মা হরিণীকে সংবাদ দিতে। বনের যত পশুপাখি রাজপুত্রত্রয়ীর কাণ্ড দেখতে ছুটল।

মিষ্টি নরম হরিণছানা গর্তের বাইরে এসে বলল, ‘ধন্যবাদ ভাই। আমাকে বাঁচাবার জন্য ধন্যবাদ। জানি তোমরা এখন আমাকে খেতে চাইবে। শুধু একটা আর্জি। শেষ বারের মতো আমার মা-বাবা-ভাইকে দেখতে চাই।’

ডোরা বলল, ‘কে বলল তোমাকে খাব?’

ডুরে বলল, ‘আমাদের পেট ভরতি। রাজপুত্তুর বাঘের ছানা। কক্ষনো সে লোভ করে না।’

ডুরি বলল, ‘আমাদের নীতিশিক্ষা, জঙ্গুলে আইন, বাঘাঙ্ক, বাঘচালিশা সব পড়তে হয়।’

চটাপট, খটাখট খুরতালি, লেজতালি, থাবাতালি পড়তে লাগল চার পাশ থেকে। পাখিরা সুর করে গেয়ে উঠল খুশির গান। বুনোকাক খরখরে গলায় হেঁকে উঠল এই না হলে রাজপুত্তুর? কা কা কা কা! বা বা বা বা!

সব পশুরাই এসে পড়েছিল। তারাই তালি দিয়েছে। মা হরিণী হেসে-কেঁদে অস্থির। হরিণছানার আহ্লাদ আর ধরে না। সে বলল মা, খেলতে যাই? মা হরিণী বলল কার সঙ্গে খেলবি? ডুরি-ডোরা-ডুরে লাজুক লাজুক মুখে দাঁড়িয়েছিল। এ বার বলল কেন? আমাদের সঙ্গে?

বাঁদর, শুয়োর, হাতি, গণ্ডার, যেখানে যত বাচ্চা ছিল সব ছুটতে লাগল মাঠের দিকে! ডুরি-ডোরা-ডুরের যে কত বন্ধু, তা কে বলবে! বড়রা মুগ্ধ হয়ে এই মিলমিশ দেখতে লাগল। ছোটরা বড়র চেয়ে ছোট নয়। বড়রা ছোটর চেয়ে ছোট হয়।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy