Advertisement
E-Paper

বড়লোকের বখাটে

এ ফেরারি পোড়ায়, সে প্যানে দামি মদ ঢালে, ও পোষা কুকুরকে পরায় লাখ টাকার ঘড়ি। কেউ গাড়ি চালিয়ে লোক চাপা দেয়।এ ফেরারি পোড়ায়, সে প্যানে দামি মদ ঢালে, ও পোষা কুকুরকে পরায় লাখ টাকার ঘড়ি। কেউ গাড়ি চালিয়ে লোক চাপা দেয়।

সৌরজিৎ দাস

শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:২২
ছবি: সুমন চৌধুরী।

ছবি: সুমন চৌধুরী।

পরম শর্মা। বছর সতেরো আঠেরোর একটা ছেলে। সান ফ্রান্সিসকোতে থাকে। ২০১৩-য় সে ছিল ইনস্টাগ্রাম-এর সেনসেশন। ‘ইট্সল্যাভিশবিচ’ নামে তার অ্যাকাউন্টে ঢুকলে দেখবেন কাঁড়ি কাঁড়ি ছবি। কখনও ছেলেটি বিছানায় তাড়া তাড়া ডলারের মধ্যে ডুবে আছে, কখনও হাতে পাঁচ-ছ’টা আইফোন তাসের মতো সাজিয়ে রেখেছে, আবার কখনও বেলুনের সুতোয় একগুচ্ছ নোট জড়িয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে! এবং প্রায় প্রত্যেকটা ছবির সঙ্গে একটা করে কমেন্ট— ‘আজ দোকান থেকে আইফোন-৫ এর সব স্টক কিনে নিলাম। ওই, ইচ্ছে হল আর কী!’, ‘আমি গাড়ি স্টার্ট করি বোতাম টিপে আর তোমরা আতিপাতির দল স্টার্ট করো চাবি ঘুরিয়ে’, ‘আমার কুকুরটাও তোদের চেয়ে ভাল অবস্থায় থাকে রে চাষারা’ ইত্যাদি ইত্যাদি। লোকেরাও ছাড়বে কেন? তারাও এন্তারসে গালি দিয়ে পোস্ট করতে থাকে তার অ্যাকাউন্টে। ইনস্টাগ্রাম-এর ‘মোস্ট হেটেড টিনএজার’ হিসেবে দারুণ নাম কেনে পরম। তার আসল পরিচয় নিয়ে নানান জল্পনা থাকলেও, পয়সার ফাঁট দেখিয়ে মানুষকে রাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে দারুণ সফল হয়েছিল সে।

কেরলের ধনী ব্যবসায়ী মহম্মদ নিশাম-এর ছেলের ব্যাপারটা অবশ্য অন্য রকম। মাত্র ন’বছর বয়স তার। অনেক দিন ধরেই বাবা-মা’র কাছে তাদের ফেরারি গাড়িটা চালাবে বলে বায়না ধরেছিল। অন্য সময় বারণ করলেও, ছেলের ন’বছরের জন্মদিনের দিন আর তার অনুরোধ ফেলতে পারেননি তাঁরা। তার থেকে কয়েক বছরের ছোট ভাইকে পাশে বসিয়ে অত দামি গাড়ি নিয়ে এক চক্কর ঘুরে এসেছিল সে। গোটা ব্যাপারটা ভিডিয়ো করে নেট-এ আপলোড করেন তার মা। ব্যস, লোকজন দেখে হেভি খাপ্পা। পুলিশে খবর চলে যায়। গ্রেফতার হন নিশাম। অত ছোট ছেলেকে কেন অত দামি গাড়ি চালাতে দেওয়া হল, সে প্রশ্নে বাবামায়ের সপাট উত্তর, ছেলেটার জন্মদিন ছিল। তা ছাড়া আমি জানি ও কোনও অ্যাক্সিডেন্ট করবে না। ছেলেটার মা আবার যোগ দেন, ‘ও তো ছোট্ট থেকে আমাদের ল্যাম্বরঘিনি, বেন্টলে চালাচ্ছে। খুব ভাল চালায়। ভাবুন তো, ক’টা ছেলে এই বয়সে অমন গাড়ি চালাতে পারবে? আমি তো ওর জন্য ভীষণ প্রাউড!’ সত্যিই তো, বেলুনে করে টাকার তোড়া ওড়ানো বা নাবালক ছেলের হাতে দামি ফেরারি গাড়ি ছেড়ে দেওয়া— এগুলো কি আমার আপনার মতো মধ্যবিত্তদের ধকে কুলোবে? পরম-এর কথা এক অর্থে ঠিক কি না?

এক চরম পুত্রের কথা বলি। বাবা সুইটজারল্যান্ডের বিরাট ধনী লোক। ছেলের নিজেরই গাড়ির সংখ্যা পনেরোটা। ফেরারি, ল্যাম্বরঘিনি, কী নেই। কিন্তু ছেলের ফেরারিটা মোটে পছন্দ নয়। তার চাই ফেরারিরই নতুন আর একটা মডেল। বাবাকে কী ভাবে রাজি করানো যায়? বন্ধুদের সঙ্গে ষড় করে, গাড়িটা একটা অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়ে স্রেফ আগুন লাগিয়ে দেয় সে। এবং তার পর এমন সব হাবিজাবি মিথ্যে কথা বলতে থাকে, যাতে মনে হয়, কী করে গাড়িটায় আগুন লেগে গিয়েছিল, সে জানেই না।

বড়লোক তো অনেকেই হয়, কিন্তু বাবার পয়সায় বাবুয়ানি দেখানোর সবচেয়ে চালু তরিকা হল, আশ্চর্য অবান্তর উপায়ে টাকা উড়িয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়া। আমাদের পুরনো জমিদারদের নিয়েই তো কত গল্প আছে। বেড়ালের বিয়ে দিতে নাকি লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতেন তাঁরা। সেই বিয়েতে রাতের বেলায় যাতে সূর্যের কিরণ ঝরছে মনে হয়, তাই চুমকি আর জরির বৃষ্টি করা হত ছাদ থেকে। গোলাপজল দিয়ে এই জমিদারতনয়রা জলশৌচ করতেন। তা হলে, ব্রুনেই-এর রাজকুমার যদি তার তিরিশ বছরের জন্মদিনে তাবড় তাবড় হলিউড তারকাদের আমন্ত্রণ করে (আসলে পয়সা দিয়েই নিয়ে আসে এমন কানাঘুষো শোনা যায়), আমন্ত্রিত সব অতিথিকে রির্টান গিফ্‌ট হিসেবে আইপড, ডায়মন্ড সেট বা দামি ক্রিম উপহার দেয়, পার্টিতে শুধু ফুলের পেছনেই লক্ষ লক্ষ টাকা উড়িয়ে দেয়, সেটা কি খুব বেশি কিছু?

প্লেনে অনেক ক্ষণ কাটাতে হবে? মনে হচ্ছে আশপাশের লোকেরা আপনাকে ঠিক চিনতে পারছে না? হল্লা শুরু করুন। হোটেলে আপনাকে নাবালক বলে মদ দেবে না? ঝামেলা বাধিয়ে দিন। আর যদি কেউ বাধা দিতে আসে, তাকে চিৎকার করে জানিয়ে দিন আপনি কে। আপনার বাবার কত টাকা। চাইলে আপনার বাবাকে দিয়ে তার চাকরি দু’সেকেন্ডে খেয়ে নিতে পারেন। আগে কত বার এমনটা করেছেন, পুলিশকে কত লাখ টাকা দিয়ে তক্ষুনি ছাড়া পেয়েছেন। তবেই না ধনী হিসেবে আপনার ইউএসপি বাড়বে!

পোষা কুকুরের পায়ে গোল্ড প্লেটেড অ্যাপ্‌ল ঘড়ি পরিয়ে, নামি রেস্তোরাঁয় একপাল বন্ধুদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করে, দামি মদ বাথরুমের প্যানে ঢেলে কিংবা দামি গাড়ির লাইন লাগিয়ে তার সামনে কেত মেরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলুন, আর সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করুন। চিন-এ তো এক সময় এই ধরনের ধনী ছেলেমেয়েদের ওপর সাধারণ লোক খুব খেপে গিয়েছিলেন! সরকারও ভাবনাচিন্তা করছিল, এদের কী ভাবে বাগে আনা যায়। এমনই একটি মেয়ের বিরুদ্ধে সেক্স পার্টি পরিচালনা করার অভিযোগ ওঠে। অমনি সে তার সোশাল মিডিয়ায় তার অভিযোগকারীদের উদ্দেশে নিজের একটি ছবি পোস্ট করে। সেটায়, সে ৫০ লক্ষ ইউয়ান মূল্যের ক্যাসিনো চিপ হাতে ধরে আছে। সঙ্গে ক্যাপশন, ‘আমি এতটাই ধনী যে আমাকে যৌনতা বেচতে হয় না।’

আর যদি কোনও সময় কোনও অপরাধ করে ফেলেন? সঙ্গে সঙ্গে বাবা-মা’র ক্ষমতার সাহায্য নিন। তাঁরা হয়তো নিজেদের পাওয়ার কাজে লাগিয়ে সম্পূর্ণ অন্যের ঘাড়ে আপনার দোষটা চাপিয়ে দিয়ে আপনাকে বাঁচিয়ে দেবেন। দু-তিন বছর আগের ঘটনা। ভারতের খুব ধনী এক ব্যবসায়ীর একটি খুব দামি গাড়ি মুম্বইয়ের রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্ট করল। আরও দুটি গাড়ি তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হল। পুলিশ কেসটা হাতে নিতেই, সেই ধনীর সংস্থার এক কর্মী এসে সব দায় স্বীকার করে, পুলিশের কাছে ধরা দিল। খবরটা কাগজে বেরোলেও তা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি হয়নি। এবং অনেকেরই ধারণা, যে লোকটি পুলিশের কাছে ধরা দিয়েছিল, সে আসল দোষী নয়। সেই ধনীর এক ছেলে ছিল স্টিয়ারিং-এর পেছনে। কিন্তু সেই বিষয়ে পুলিশ কিংবা মিডিয়া মুখ খুলতে নারাজ।

যদিও সব সময় আইনের চোখে ফাঁকি দিয়ে পেরোতে পারে না সব বখে যাওয়া বড়লোকজাদা। যেমন, একটি অ্যাড সাইটে একটা চুরি করা ফোন বেচতে গিয়ে ধরা পড়ে পরম শর্মা। চিনে সেক্স পার্টি আয়োজন করা মেয়েটিকে বেটিং-এর দায়ে হাজতে পোরে পুলিশ। সুইটজারল্যান্ডের সেই ধনীর ছেলেটাও ধরা পড়ে। যে জায়গায় গাড়িটা আগুন ধরে যায়, সেখানকার একটি সিকিয়োরিটি ক্যামেরায় ধরা পড়ে যায় ছেলেটা কী ভাবে সঙ্গীদের সাহায্যে গাড়িটায় আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিল। ব্যস। সম্প্রতি কলকাতার রেড রোডে এক বায়ুসেনা জওয়ানকে গাড়ি চাপা দেওয়া সাম্বিয়া সোহরাব-ও পুলিশের হেফাজতে। হয়তো এদের শাস্তি হবে। আবার হয়তো, ব্যাপারগুলো পাবলিক মেমোরি থেকে চলে যেতেই, অন্য ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তবে চিন্তা নেই, ফের উঠে আসবে নতুন নাম, নতুন কীর্তি।

sourajit das
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy