E-Paper

ঢেঁকিধারী দুর্যোধনের তাড়ায় আতঙ্কিত ভীম

দুর্যোধনের ভূমিকায় ছিলেন যাত্রাসম্রাট ‘মুগুর ঘোষ’। আসল নাম ঋষিবর হালদার। জমিদারিও উৎসর্গ করেন যাত্রার নেশায়।

অভিজিৎ হালদার

শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২৩ ০৯:০৬
Mugur Ghosh.

স্বনামধন্য: অভিনেতা মুগুর ঘোষ।

পঞ্চাশ-ষাটের দশকে সুন্দরবন তথা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো যাত্রাশিল্পী ‘মুগুর ঘোষ’-এর কথা ক’জনই বা জানেন! পুঁথি কিংবা বইয়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার মতো অবস্থা হলেও কোনও তথ্যেরই হদিস মেলে না। তাই পশ্চিমবঙ্গ কাঁপানো এই শিল্পীর জীবন-আখ্যান অজানাই থেকে গেছে। পারিবারিক সূত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে যে গল্প পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় ‘ঋষিবর হালদার’ ওরফে ‘মুগুর ঘোষ’ বা ‘ঈশিভুঁড়ি’-র জীবন বেশ রোমাঞ্চকর। সুন্দরবনের মথুরাপুর অঞ্চলের হালদার হাটের জমিদার নরেন্দ্রনাথ হালদারের বড় ছেলে ‘ঋষিবর’ জমিদারি সম্পত্তির প্রায় সিংহভাগ খুইয়েছিলেন এই যাত্রার নেশায়। জীবন উৎসর্গ করেছিলেন শিল্পের জন্য। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দুর্ভিক্ষপীড়িত সুন্দরবনের দ্বীপে দ্বীপে অভিনয় করে বেড়িয়েছেন তিনি।

তাঁর এই শিল্পীজীবনের শুরুর দিকটা ছিল রোমাঞ্চকর। হালদার হাট গ্রামের প্রায় তিন-চারশো বছরের পুরনো সঙ্কীর্তন-মেলা উপলক্ষে এসেছিল এক কৃষ্ণযাত্রার দল। সেই দলের স্ক্রিপ্ট চুরি করেছিল এই গ্রামেরই এক বাসিন্দা। সেই স্ক্রিপ্টকে কেন্দ্র করে শুরু হয় অভিনয়, ও তা থেকে একটি যাত্রা দল। সেখানে অভিনয়ের সূত্রে ঋষিবর হালদার পরিচিতি পান সুন্দরবন জুড়ে। তার পর একের পর এক যাত্রা দলে অভিনয়ের সুযোগ আসে তাঁর। এই ভাবেই একে একে বিভিন্ন যাত্রা দলের মুখ হয়ে ওঠেন তিনি।

তখন যাত্রায় মাইকের ব্যবস্থা ছিল না। খালি গলায় অভিনয়। কোনও এক গ্রামে যাত্রাপালা বসলে পাশাপাশি চার-পাঁচটা গ্রাম উজাড় করে লোক আসত সে পালা শুনতে। খালিগলায় শেষের সারির মানুষদের কান পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হবে সংলাপ। দরাজ গলার উত্তাপ সেই পাল্লাতেই ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন ‘মুগুর ঘোষ’। দ্বীপে দ্বীপে ছড়িয়ে পড়েছিল যাত্রাসম্রাট ‘মুগুর ঘোষ’-এর কথা।

‘মুগুর ঘোষ’ নামেও আছে কিংবদন্তি। জমিদারি গেলেও জমিদার বাড়ির বড় ছেলে ‘ঋষিবর’ ছিলেন খাইয়ে মানুষ। জামবাটিতে ছাড়া তরকারি খেতেন না। নখের কানা না ডোবা পর্যন্ত পাতে দুধ ঢেলে যেতে হত। কলসি উল্টে জল খেতেন। শ্বশুর বাড়ি ছিল দু’কিলোমিটার দূরে। বাড়ির উত্তরের পাড়ে গিয়ে এক হাঁকে শ্বশুরবাড়িতে থাকা স্ত্রীকে ডেকে নিতেন। বিরাট দামোদর শেঠ মার্কা ভুঁড়ি। আশেপাশের পাড়াতে ‘মোটা হালদার’ কিংবা ‘ভুঁড়ি হালদার’ নামেও পরিচিত ছিলেন তিনি। শোনা যায়, যতটা শারীরিক দিক থেকে দশাসই ছিলেন, মনের দিক থেকে ততটাই না কি ভিতু ছিলেন।

যাত্রাসম্রাট ‘মুগুর ঘোষ’ হওয়ার আগে যখন যাত্রার ভূত মাথায় চেপেছিল, তখন তিনি প্রথম মথুরাপুরের এই অঞ্চলে পুতুল নাচের দল নিয়ে আসেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার জ্বালাবেড়িয়া থেকে প্রথম পুতুলনাচের কায়দা কৌশল তিনি শিখে আসেন। নানা রকম কায়দার পুতুল নাচের দলও করেন। পরের দিকে আবার যাত্রা দলে যোগ দেন। কৃষ্ণযাত্রার কংস তিনি। মহাভারতের দুর্যোধন তিনি। রামযাত্রার রাবণও তিনিই। আবার সময়মতো সামাজিক পালায় চাকরের অভিনয়েও। তাঁকে মাথায় রেখে যাত্রার চরিত্র নির্মাণ করতেন লেখকেরা। সেই সময়ের যাত্রা কিংবা ছায়াছবিতে চাকর চরিত্র গল্পের পক্ষে খুবই প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক ছিল।

শিল্পীজীবনের নানা ওঠাপড়ার মধ্য দিয়েই তাঁর জীবন-আখ্যান নির্মিত। খালি গলায় অভিনয় করে অভিনয়কলার পাশাপাশি গলার ঘনত্ব দেখিয়েছেন তিনি। শোনা যায়, এক বার মহাভারত পালা করতে গিয়েছিলেন। ঋষিবর হালদার সেজেছেন দুর্যোধন। ক্লাইম্যাক্স চলছে। ভীষণ যুদ্ধ। গদাধারী ভীমসেনের সঙ্গে দুর্যোধনের যুদ্ধ হবে। সাজঘরে হইহুল্লোড়। হইহই রব। মহাভারতের অভিমানী নায়ক দুর্যোধন পোশাক পরে প্রস্তুত। কিন্তু তাঁর গদা পাওয়া যাচ্ছে না। এ দিকে ভাড়া করা বিখ্যাত দলের যাত্রা। একটু সমস্যা হলেই ভাড়ার টাকায় কাটতি। কী হবে!

একটাই মাত্র গদা আছে। ভীমসেন নিলেন সেই গদা। দুর্যোধন বেশধারী ঋষিবর আদেশ দিলেন পাড়া থেকে বড় জাব পেটানো মুগুর খুঁজে নিয়ে আসতে। গ্রামের দু’-এক জন লোক সেখানে ছিল। তাদের পাড়ায় এ রকম কোনও মুগুর নেই বলেই জানাল। সাজঘরের পাশের বাড়ির উঠোনে মই ভাঙা ঢেঁকি পড়ে ছিল। গদাধরী দুর্যোধন সেই মই ভাঙা ঢেঁকি কাঁধে করে মঞ্চে উঠলেন। কী ভীষণ সে যুদ্ধ! ভীমসেন গদা ছেড়ে প্রায় পালায়-পালায় অবস্থা। মঞ্চের চারিদিকে চরকির মতো পাক খাচ্ছেন দুর্যোধন। ঢেঁকি ঘুরিয়ে চলেছেন সমানে। দর্শক ফেটে পড়ছে হাততালি আর কলরবে। হই হই রব উঠছে দর্শক আসন থেকে। সে দিনের যুদ্ধে ঠিক কে জিতেছিল, কারও মনে নেই। এ ভাবেই মহাভারত পালা শেষ হয়েছিল সে দিন। মহাভারতের কাব্যিক পরিসমাপ্তি ঘটেনি হয়তো। কিন্তু উচ্চমাত্রার হাস্যরস মনে গেঁথে গিয়েছিল সবার।

সেই থেকেই যাত্রাগানের পরিসরে নতুন যাত্রা শুরু করেন ঋষিবর হালদার। হয়ে ওঠেন যাত্রা জগতের সম্রাট ‘মুগুর ঘোষ’। সুন্দরবন থেকে সে যাত্রাগানের যাত্রা শুরু হয়ে ধীরে ধীরে মেদিনীপুর হুগলি হাওড়া বর্ধমান বাঁকুড়া পুরুলিয়া হয়ে দার্জিলিং পৌঁছেছিল। ভীমসেন ও দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ পালার যুদ্ধের ফলাফল হিসাবে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণোচ্ছ্বল হাসি-হুল্লোড়ে জেগে আছেন সুন্দরবনের যাত্রাসম্রাট— ‘ঋষিবর হালদার’ তথা ‘মুগুর ঘোষ’।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Feature Actor

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy