পূর্বানুবৃত্তি: ড্রাইভার সাধনকে ডেকে পাঠালেন জ্যোৎস্নাদেবী। বেড়াতে বেরোলেন ওর গাড়ি করেই। গন্তব্য কাকদ্বীপ হয়ে পঞ্চমুখী গঙ্গা পেরিয়ে কালনাগিনীর ধারে বসা। ‘কর্ণার্জুন’ পালার সময় সেবার পেরিয়েছিলেন বিপদসঙ্কুল কালনাগিনী। জ্যোৎস্নাদেবীর সঙ্গে তখন ছিলেন তাঁর প্রিয় পুরুষ। বিভিন্ন বিপদ থেকে নানা সময়ে নানা ভাবে সতর্ক করেছিলেন জ্যোৎস্নাদেবীকে। এবার কাকদ্বীপে ইলিশ মাছ ভাত খেয়ে সাধন আর জ্যোৎস্নাদেবী এলেন কালনাগিনীর তীরে। সেখান থেকে রাতে থাকার জন্য সাধন ওঁকে নিয়ে এল স্থানীয় সরকারি বাংলোয়। থাকার সুব্যবস্থা হল। পরদিন ফেরার সময় জ্যোৎস্নাদেবীর সঙ্গে দেখা করে গেলেন স্থানীয় একটি নাট্যদলের কর্মীরা। সম্মান জানালেন জ্যোৎস্নাদেবীকে। অন্য দিকে জনমেজয় অফিস যাওয়ার ট্রেনে উঠে দেখলেন সহকর্মীদের জোরদার হাসি-মশকরা চলছে রফিককে ঘিরে। রফিক চটে যায়, শাপশাপান্ত করে। বিষ্ণুপুর পর্যন্ত চলে এসব।
সবে পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়ে যাওয়ায় এখন চাপ কম। তবে জনমেজয়ের নতুন করে জরিপের কাজ হচ্ছে কয়েকটা পাট্টা দেওয়ার কারণে।
রোববার ক্লাব জমে গেল। সুধাময়ীও বেশ খুশি, কারণ ছেলে কিছু দিনের মধ্যে আবার কলকাতায় ফিরে আসছে ইসরো থেকে। এ বার প্রশিক্ষণ হবে আইআইএম জোকা-য়।
জনমেজয়বাবুদের ক্লাব সাধারণ ক্লাব নয়, আসলে এটাই ওঁদের রিহার্সাল রুম-কাম-আড্ডাকেন্দ্র-কাম অপেরা হাউস। অবশ্য পেশাদারি নয়, শখের যাত্রা দল।
ফটিক খুব কাঁচুমাচু মুখে বসে আছে। আর পানসদা বেশ তাড়াতাড়ি চলে এসেছেন এবং নানা প্রশ্নে জর্জরিত করছেন ফটিককে।
পানসদার কথায় কখনও কখনও উত্তর কলকাতার সে কালের কথ্যরীতি চলে আসে, কারণ পানসদা নিজেকে সব সময় কলকাতার লোক বলে থাকেন। যদিও কলকাতা যেতে তাঁকে কেউ তেমন দেখেননি। তাঁর বাহন সব সময় ঘোড়ার গাড়ি, আর সারথি সকলের চেনা ভাল মানুষ মুস্তাফাদা।
“ফটিক, বল দিকিনি আমাদের থেটার বা যাত্রার প্রথম নাট্যশালা কোনটে?”
ফটিক বলল, “পানসদা, যাত্রা আর থিয়েটার দুটো তো আলাদা।”
“ঠিক আচে, তুই প্রথম নাট্যশালার নাম বল!”
“পুরুলিয়ায়?”
“আহাম্মুক কোতাকার! কলকেতাই তো সব কিচুর আদি। সেকানেই শুরু হয়।”
জনমেজয় এর মাঝে বলে দেন, “নারকেলডাঙায় প্রসন্নকুমার ঠাকুর।”
একটু দমে গেলেন পানসদা। তার পর বললেন, “প্রথম নাটক বা পালা?”
ঠিক উত্তর দিলে পানসদার স্পনসরে মাংস-ভাত মিস হয়ে যাবে। জনমেজয় বললেন, “জানি না।”
এ বার খুশি হলেন পানসদা। বললেন, “শেক্সপিয়র সাহেবের জুলিয়াস সিজ়ার।”
ফটিক জিজ্ঞেস করে, “আমরা কি ‘ম্যাকবেথ’ পালায় আনব?”
“আলবাত!” টেবিল চাপড়ান পানসদা।
ফটিক ফাজিল হেসে বলে, “ইংরিজি যাত্রা!”
জনমেজয় বলেন, “পানুদা, ভজাকে ডাকব?”
“না, আগে ‘ম্যাকবেথ’ করা ফাইনাল হবে।”
ফটিক বলতে যাচ্ছিল, সে ওসবে নেই, তখনই জনমেজয় ফটিককে রামচিমটি কাটলেন।
বললেন, “পানসদা, হয়ে যাবে। এখন তো ‘ম্যাকবেথ’-এর বাংলা ভাষান্তর রয়েছে।”
পানসদা ডাকলেন, “ভজা, ভজা।”
ভজা দৌড়ে এল।
“মাংস-ভাত। মুরগি নয়, খাসির মাংস, বুয়েছিস? রেওয়াজি খাসি। পারবি তো?”
ভজা খুব চালাক, সে ঘাড় কাত করল।
জনমেজয় বললেন, “একটা কথা বলি?”
পানসদা বললেন, “বলে ফেল।”
“লেবাডফ সাহেবের হাত ধরেই কিন্তু আমাদের নাট্যশালার শুরু।”
“ঠিক। কিন্তু সত্যি পাবি তো ‘ম্যাকবেথ’-এর বাংলা ভাষান্তর?”
জনমেজয় বললেন, “আছে।”
ফটিক বলল, “ডাইনি কারা করবে?”
পানসদা দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, “কেন, তোর মতো তিন মুখ্যু করবে!”
মাংস-ভাতটা জমিয়ে রাঁধল ভজা। জনমেজয় ‘ম্যাকবেথ’-এর বাংলা ভাষান্তর বার করলেন আর বললেন, “পানসদা, গিরিশবাবুও করেছিলেন। লেডি ম্যাকবেথ করেছিলেন তিনকড়ি দাসী।”
পলাশ একটা গান প্রায়ই গাইত, “আমি যাব না তোমার সনে তুমি ফচকে মেয়ে/ পুরুষ দেখলে অমনি থাক তার পানেতে চেয়ে।”
এ সবই নাকি সে কালের খেউড় গান। এখনকার প্যারডির মতো।
পার্লারে সংক্ষিপ্ত সাজুগুজু করল পল্লবী। দেবল আজ ব্যারাকপুরের মালঞ্চে খাওয়াবে। খুব টান অনুভব করছে না পল্লবী। একটু-আধটু চুমু খাবে, হয়তো নৌকো-বিহার হবে, কোনও ঘাট থেকে। দেবলের কাছে কয়েক দিন যাওয়া হয়ে গেল, এখন ক্লান্তি আসছে।
তবুও চন্দননগরের ঘাট পেরোল পল্লবী। ও-পারে শ্যামনগরে এল, শ্যামনগর থেকে ট্রেনে উঠল ব্যারাকপুর যাবে বলে। দুপুরবেলা বলে ট্রেন ফাঁকা ছিল।
স্টেশনে দেবলের গাড়ি ছিল। মালঞ্চে এর আগে আসেনি পল্লবী। বেশ লাগছে। খাওয়া-দাওয়ার হলটা ফ্লোটেলের মতো সাজানো। খেতে খেতে বিকেল গড়িয়ে গেল।
দেবল বলল, “চলো, তোমায় স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসি।”
পল্লবী বলল, “আর কোথাও যাবে না?”
দেবল হেসে বলল, “না, আজ নয়। আজ আমার বিজ়নেস ডিল আছে। তা ছাড়া আমার বৌ-ও সন্দেহ করছে। সে বোধহয় আজই তোমায় শ্যামনগর স্টেশনে দেখে ফেলেছে।”
পল্লবী বলল, “তোমার বৌ দেখেছে তো আমি কী করব?”
দেবল বলল, “ডিয়ার, কয়েক দিন সাবধানে থাকতে হবে।”
পল্লবীও ক্লান্ত, কিন্তু দেবলের প্রচুর টাকা। একটা কিছু আদায় করতে হবে তো।
পল্লবী বলল, “তুমি জানো তো, আমি চাকরি করি না।”
“জানি। চাকরি করতে চাও?”
“না। তুমি আমাকে একটা ফ্ল্যাট দেবে। একদম আমার নামে।”
দেবল বেশ ধাক্কা খেল। দু’দিন শুয়েই ফ্ল্যাট চাইছে! হঠাৎ রাগ চড়ে গেলেও দেবল নিজেকে সামলে নিল। শান্ত গলায় বলল, “হবে। পুরনো হলে হবে? একেবারে গঙ্গার ধারে।”
“কন্ডিশন কেমন হবে! ভুলভাল?”
“আমি ইন্টিরিয়র ডেকরেশন করিয়ে দেব।”
পল্লবীর চোখ দুটো চকচক করে উঠল।
পল্লবীকে স্টেশনে নামিয়ে দ্রুত ড্রাইভ করতে লাগল দেবল। কান দুটো ঝাঁ-ঝাঁ করছে। বেশ কিছু ছবি, ভিডিয়ো পল্লবীর কাছে রয়েছে।
ট্রেনে উঠেও গঙ্গার ধারের ফ্ল্যাটের স্বপ্নে বুঁদ হয়ে রইল পল্লবী। এসে নামল শ্যামনগরে।
১৯
ট্রেজারি বিল্ডিংয়ের তিন তলায় পুনর্বাসন দফতর। দীপঙ্কর ভেবেছিলেন দেরি হবে, কিন্তু ঠিক সময়ে পৌঁছে বায়োমেট্রিক হাজিরা দিলেন। একটা কলরব শোনা গেল। ট্রেনযাত্রীরা এসেছেন। কিছু ক্ষণ পর জনমেজয়বাবু এলেন।
বললেন, “স্যর, আজ কি একটু বিমর্ষ লাগছে?”
হাসলেন দীপঙ্কর। বললেন, “বসুন। বাবার ডায়েরি থেকে পেলাম। বলুন তো এর অর্থ কী?”
জনমেজয় বললেন, “বলুন স্যর।”
“পিতার বৈমাত্রেয় ভাই, মোর সহোদর/ কি বলিয়া পিণ্ড দেবো কহ গদাধর।”
জনমেজয় বললেন, “যুধিষ্ঠির প্রশ্ন করছেন কৃষ্ণকে পিণ্ডদান পর্বে। আসলে সূর্যের দুই পুত্র— যম বা ধর্মরাজ এবং কর্ণ। আবার ধর্মের পুত্র যুধিষ্ঠির। ফলে তিনি দ্বিধাগ্রস্ত। পিণ্ডদান দেবেন কোন সম্পর্কের ভিত্তিতে।”
দীপঙ্কর হেসে বললেন, “পালাটি ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের লেখা। আমরা নাম বদলালাম। ‘নর-নারায়ণ’ নয়, শুধু ‘কর্ণ’।”
জনমেজয় বললেন, “উনি ডায়েরি লিখতেন?”
“অনিয়মিত। কখনও কখনও নিজেকে টপ্পার গীতিকার ভাবতেন। নাম নিয়েছিলেন নবকার্তিক।”
জনমেজয় বললেন, “অনেক রত্ন রেখে গেছেন। সেই মায়ের সঙ্গে আবার দেখা হয়েছে?”
“এক দিন শেয়ালদা স্টেশনে...”
জনমেজয় হেসে বললেন, “চিৎপুরের যাত্রাপাড়ায় তো ওর সঙ্গে গেছিলেন!”
“হ্যাঁ গেছিলাম। আবার যেতে পারলে বেশ হয়। একটা প্রশান্তি আসে মনে।”
“প্রশান্তিটাই তো আসল।”
দীপঙ্কর এ বার বললেন, “কলকাতার লোয়ার সার্কুলার রোডের ধারে বিশাল শ্মশানভূমি দেখেছেন? শ্মশানভূমি নয়, কবরখানা।”
জনমেজয় অবাক হয়ে বললেন, “আপনি দেখেছেন, তাই না?”
“হ্যাঁ। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবর আছে। সাঁ সুসির অভিনেত্রী মারিয়া ম্যাডলিন টেলরের কবর আছে।”
জনমেজয় সামান্য চমকে উঠলেন, “পানসদা বলে এক জন আছেন, তিনি সাঁ সুসির কথা বলছিলেন। আমরা তো ধরতে পারছিলাম না। যা-ই হোক, সেই কবরখানায় আপনি কেন গেছিলেন?”
“তখন পিসির বাড়িতে লেখাপড়া নিজের তাগিদে করতাম আর সময় পেলেই সেই কবরখানায় যেতাম। মা-বাবা থেকেও নেই, তখন সমস্ত পৃথিবীই আমার কাছে শ্মশান।”
“এখন মনে হয় না তো? আমরা সবাই আছি!”
“না, মনে হয় না। মাকেও তো পেলাম।”
জনমেজয় বললেন, “হারিয়ে পাওয়া। আর একটা কথা স্যর! আমরা পুজোয় ‘ম্যাকবেথ’ করব।”
দীপঙ্কর বললেন, “দারুণ তো!”
“আপনার মা জ্যোৎস্নাদেবীকে দিয়ে নাটকের উদ্বোধন করব। একটা ছোট দুর্গাপুজোও হয়।”
“মা-কে দিয়ে করান। রাজি হয়ে যাবেন।”
“উনি কিন্তু এক কালের নামী অভিনেত্রী!”
“আমি বললে রাজি হবেন।”
ঘরের ছবিটার দিকে তাকালেন তিনি। হাত দিয়ে উঁচু যতখানি হওয়া যায়, হয়ে নামালেন তিনি। একটু ধুলো হয়েছে, আঁচল দিয়ে মুছে নিলেন। তাঁদের তো সপ্তপদী গমন হয়নি, দুটো মালা নিয়ে এসেছিলেন রাধাপ্রসাদদা। সে দিন উনি রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষণিক’ কবিতাটি বলছিলেন, আজও মনে পড়ে।
“এ চিকন তব লাবণ্য যবে দেখি/ মনে মনে ভাবি একি/ ক্ষণিকের পরে অসীমের বরদান/ আড়ালে আবার ফিরে নেয় তারে/ দিন হল অবসান।”
সময় যেন কাটতেই চায় না, বিশেষ করে রাত। সেই আলোকিত রংমহল, কখনও জাহানারা, কখনও বেগম রাজিয়া।
সব সময় ডাকছে অতীত। আর এই সময় শূন্যে খেলা করে। জেগে থাকে রাতের কেয়া। গন্ধ ছড়িয়ে বলে, ‘সময় এ রকমই। সব কিছু দিয়ে যেতে হয়। দিনের প্রতাপে খর রোদে আমারও কি কিছু থাকে!’
জ্যোৎস্নাদেবী বলেন, ‘তুমি তো ফিরে আসো কেয়া প্রতি রাতে। কিন্তু আমরা নটনটীরা গন্ধর্বের অভিশপ্ত প্রজাতি। হঠাৎ এক দিন চিরতরে হারিয়ে ফেলি সব।’
আবার ভাত বসাতে হবে একার জন্য, ইচ্ছে করে না।
হঠাৎ মোবাইল বেজে ওঠে।
“হ্যালো...” কোমল কণ্ঠে বলেন তিনি।
“মা, আমি দীপঙ্কর।”
মাতৃত্বের যাবতীয় উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ে। কোনও ক্রমে কান্নার গমক সামলে নেন।
“বল বাবা।”
“মা, আমি কথা দিয়েছি, তুমি রাখবে তো?”
তুই বা তুমির ভেদাভেদ থাকে না। মা আর সন্তানের সংলাপ যেমন অনাবৃত হয়, সেই আবরণহীনতার মাতৃকোরক থেকে তিনি বলেন, “তুমি যখন কথা দিয়েছ, আমি রাখব।”
দীপঙ্কর বলেন, “পুরুলিয়ায় একটি অপেশাদার যাত্রার গ্রুপের অনুষ্ঠানে যেতে হবে, তোমাকে উদ্বোধন করতে হবে।”
“আমি করব।” মনে মনে বলেন, ছেলের জন্য বেঁচে থাকতে হবেই ওঁকে। বুকের মধ্যে কষ্ট হয় আজকাল। চাপ-চাপ লাগে। তবুও তিনি বাঁচবেন। সন্তানের জন্য বাঁচতে হবে।
আবার বলেন, “চিন্তা কোরো না, আমি যাব।”
দীপঙ্কর বলেন, “আমি জানতাম।” তার পর বলেন, “তুমি ভাত রান্না করবে কিন্তু! না খেলে তোমার ঘুম আসবে না।”
হো হো করে হেসে ওঠেন তিনি, বলেন, “বাপ রে! ছেলের শাসন।”
দীপঙ্কর বলেন, “আচ্ছা, সাবধানে থেকো। রাখছি মা।”
মুঠোফোন অফ করেন দীপঙ্কর।
পল্লবী কঠিন চোখে দেখে দীপঙ্করকে। বলে, “কার ফোন?”
দীপঙ্কর বলেন, “তোমার জেনে কী হবে?”
“মহিলাকণ্ঠ মনে হল তো! একই ছাদের তলায় যখন আছি, তোমাকে বলতেই হবে।”
“তোমার কাছে তো কত ফোন আসে, আমি কি জানতে চাই?”
“বিশ্বাসটা তৈরি করতে হয়েছে।”
হো হো করে হেসে ওঠেন দীপঙ্কর।
“হাসছ যে!”
“না, এমনি।”
“কে বলবে তো তুমি!”
এই সময় দীপ পাশের ঘর থেকে চলে আসে, বলে, “বাবা, সেই ঠাম্মাটা?”
“হ্যাঁ বাবা,” সস্নেহে ছেলেকে বলেন দীপঙ্কর।
ক্রমশ
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)