Advertisement
E-Paper

অদৃশ্য শিকড়

ছোট গল্প

পার্থপ্রতিম সান্যাল

শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৯:৫৮
Share
Save

আচ্ছা মাস্টারমশাই, আপনি যে বলছেন অনেক দূরে চলে যাবেন, তা যেখানে যাবেন, সেটা কি মাদ্রাজের থেকেও দূরে? জানেন, মাদ্রাজে আমার কাকা থাকেন। মাদ্রাজ অনেক দূরে, দুপুরে ট্রেনে চড়লে পরের দিন রাতে পৌঁছয়— সে ট্রেন সব স্টেশনে থামে না আর ভীষণ জোরে চলে।”

রানি ওর মাস্টারমশাইকে বলেছিল এক দিন পড়ার সময়। রীতিমতো মাস্টারসুলভ ভঙ্গিতে।

অভি অর্থাৎ অভিজিৎ তার ছাত্রীকে, মানে রানিকে বলেছিল, “তোমাদের বাড়ির বাগানে এমন একটা গাছ পুঁতব যার শিকড় খুব লম্বা হবে, সেটা টালিগঞ্জের কলাবাগানে পুঁতলে, সোজা মাটির অনেক অনেক ভিতরে গিয়ে পৃথিবীর অন্য দিকের মাটি ফুটো করে যদি বেরোয়, তা হলে সেই দেশে আমি যাচ্ছি।”

অভির জবাবে রানির চোখদুটো ছানাবড়া, “কী বলছেন! সে শিকড়টা মাটির অন্য দিকে দেখা যাবে? আমার মনে হয় সেটা অদৃশ্য হয়ে যাবে। তা সে কোন দেশ?” মাস্টারমশাইকে রানি জিজ্ঞেস করল।

অভির জবাব, “ইউএসএ। আর আমি যেখানে যাব, তার নাম সিনসিনাটি।”

এই ভাবেই অভি বুঝিয়েছিল তারা ছাত্রী রানিকে ইউএসএ আর ভারতবর্ষের ভৌগোলিক দূরত্ব। রানিটা এত বোকা ছিল যে, হুগলি নদী কলকাতার উত্তর দক্ষিণ পূর্ব না পশ্চিম কোন দিকে, তাও বলতে পারত না। এ রকম ছাত্রী যে ক্লাস সেভেনে দু’বছর আটকে থাকবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। রানির স্কুলে দু’বছর এক ক্লাসে আটকালে পরের বছর রাখা হয় না, কিন্তু রানির বাবা যে হেতু রাজ্য সরকারের শিক্ষা দফতরের সেক্রেটারি, তাই স্কুল কর্তৃপক্ষ নিমরাজি হয়েও রানিকে তৃতীয় বছর সেভেনে পড়ার সুযোগ দিয়েছিল।

রানির মা যথারীতি স্কুলের মিস থেকে দারোয়ান পর্যন্ত সবাইকেই রানির এই রেজ়াল্টের জন্য দায়ী করেছেন, শুধু নিজের মেয়েকে ছাড়া— সত্যি তো, মেয়ের আর কী দোষ! মেয়ে হিন্দি ছবি দেখতে ভালবাসে। আর ছুটির দিনে বাড়িতে পেন ড্রাইভ চালিয়ে নতুন হিন্দি গানগুলোর সঙ্গে আয়নার সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নাচে।

এই ভাবে রানির মা যখন সবাইকে দোষারোপ করছেন, তখন এক দিন রানির বাবা অফিস থেকে ফিরে রানিকে বললেন, “কাল থেকে তুমি অভির কাছে পড়বে। আমার বন্ধুর ছেলে অভিজিৎ। লেক গার্ডেন্সে থাকে। সিবিএসই-তে প্রচুর মার্কস পেয়ে প্রেসিডেন্সিতে ফিজ়িক্সে অনার্স নিয়ে থার্ড ইয়ারে পড়ছে। কলেজেও টপার। চেষ্টা করছে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে মাস্টার্স ডিগ্রি করার। ও রকম একটা মাস্টার তোমার কাছাকাছি থাকলে তোমার মাথাটা একটু পরিষ্কার হবে।”

ব্যাপারটার শুরুটা এ রকমই ছিল। যদিও এ রকম বড়লোকের আদুরে বোকাসোকা মেয়েকে পড়ানোর প্রস্তাবটা বাবা যখন অভিকে বললেন, অভি এক কথায় না বলে দিয়েছিল।

কিন্তু অভির মা বললেন, “কী বলছিস তুই! এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারির মেয়ে বলে কথা! তোর বাবা কর্পোরেশন স্কুলের অঙ্কের মাস্টার, যদি তোর বাবাকে মিথ্যে অজুহাতে চাকরি থেকে বসিয়ে দেয়— তখন আমরা কোথায় যাব?”

মায়ের এই কথার আর কোনও জবাব দেয়নি অভি, শুধু মাঝে মাঝে মাকে বলত, “আমার লেখাপড়ার সময়টা শুধু শুধু নষ্ট হচ্ছে, মেয়েটা কিছুই শিখবে না।”

রানিকে অঙ্ক করাতে করাতে মাঝে মাঝে অভি ধৈর্য হারিয়ে ফেলত। সামান্য এ প্লাস বি হোল স্কোয়ারের অঙ্ক দশ বার বোঝানোর আর করানোর পরেও রানি একটাও অঙ্ক নিজে নিজে অভির সামনে করতে পারত না। তার উপর এত দুষ্টু ছিল রানি, অভিকে বলত, “মাস্টারমশাই, আপনি ‘হম আপকে হ্যায় কৌন’ দেখেছেন?”

অভি বকলেও কোনও প্রতিক্রিয়া হত না।

যাই হোক, সে বার অভির বকুনিতে বা চাপে সেভেন থেকে এইটে প্রোমোশন পাওয়ার পরে এক দিন পড়ানোর সময় অভিকে রানি বলল, “মাস্টারমশাই, আমার বন্ধুরা আমি পাস করেছি শুনে অবাক হয়ে গেছে! বলছে, তুই কখনও এই রকম মাস্টারমশাইকে ছাড়িস না।”

এই ভাবে ঘড়ির কাঁটা ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে দু’বছর চলে গেল। অভি স্কলারশিপ নিয়ে ইউএসএ যাওয়ার সুযোগ পেল।

রানির বাবা অভির বাবাকে বললেন, “এত বুদ্ধিমান ছেলে, ওকে আইএএস পরীক্ষায় বসতে বলুন। দেশে বড় সরকারি চাকরি পাবে। বিদেশে গিয়ে আর কী করবে!”

কিন্তু কিছুটা অভির জেদে, কিছুটা অভির মায়ের ইচ্ছেয় রানির বাবার সে প্রস্তাব টিকল না।

তার পর এসে গেল সে দিন। অভি দমদম থেকে মুম্বই, মুম্বই থেকে কেএলএম-এর প্লেনে পৌঁছল আমস্টারডাম। তার পর ওখান থেকে কেএলএম-এর কানেকটিং ফ্লাইটে আটলান্টিক পেরিয়ে পৌঁছল ডেট্রয়েট। ডেট্রয়েট থেকে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে সিনসিনাটি।

ছোট শহর, ওহাইয়ো নদীর ধারে, অপূর্ব সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য। ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন ইউনিভার্সিটি। ভারতীয় ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কম, প্রথম বছরে দুটো সেমিস্টারে টপার অভিজিৎ। আর সেই সময় জার্মান বান্ধবী গিজিলা এল অভির কাছাকাছি। দু’জনে সারা দিন কোয়ান্টাম থিয়োরি, অ্যাটমিক কনফিগারেশনের আলোচনায় ডুবে থাকতে থাকতে কখন যে একে অপরকে ভালবেসে ফেলল, ওরা তা আলাদা করে খেয়ালও করল না।

সে ভালবাসাকে পরিণতি দিতেই ওরা বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হল।

অভি ডক্টরেট করার পর সিনসিনাটি ইউনিভার্সিটিতে লেকচারারের পদ পেল। তার বছর পাঁচেকের মধ্যে সে ইউনিভার্সিটিতে নিউক্লিয়ার ফিজ়িক্সের হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট-এর পদে উন্নীত হল। গিজিলাকে নিয়ে স্থায়ী ভাবে সিনসিনাটিতে থেকে গেল অভি।

ক্রমশ জীবনযাত্রার মান আরও উন্নত হল ওদের। একটা বাগান লাগোয়া বাড়িও কিনে ফেলল ওরা। কোয়ান্টাম থিয়োরি, অপ্টিকাল এমিশন, লেসার রে নিয়ে দু’জনের অনেক এক্সপেরিমেন্টে সফল হলেও, জীবনের এক অন্যতম উত্তরণের পরীক্ষায়, স্বামী-স্ত্রী থেকে বাবা-মা হওয়ার পরীক্ষায় ওদের সাফল্য এল না। গিজিলার মা হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম বলেই ডাক্তাররা মত প্রকাশ করলেন।

তাতে অভির বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কারের ইচ্ছেটা দমল না। সে তার কাজ নিয়েই রইল। গিজিলার প্রতি ভালবাসাও তার কমল না। মায়া-মমতা-সাহচর্যে সে চেষ্টা করে যেতে লাগল, শূন্যতার বোধ যেন গিজিলাকে স্পর্শ করতে না পারে। কিন্তু মা-বাবার মনের কষ্ট অভিকে মাঝে মাঝে আঘাত দিত।

তাই কিছুটা মায়ের চাপেই গিজিলাকে নিয়ে অভি প্রায় বছর দশেক পরে টালিগঞ্জের কলাবাগানের বাড়িতে এল। মায়ের দৃঢ় বিশ্বাস, এক জন বিখ্যাত সন্ন্যাসীর ওষুধে অভি বাবা হতে পারবে।

কলাবাগানে অভিদের সাত ফুট বাই সাত ফুটের দুটো ঘর আর সরু রান্নাঘর দেখে গিজিলা অবাক, “অভি, তোমার বাবা-মা কী করে এত দিন এই ছোট্ট আলো-বাতাসহীন ঘরে বেঁচে আছে? তারা কী করে বুঝবে যে, পৃথিবীতে আলো-বাতাসের কোনও অভাব নেই!”

সত্যি কথা বলতে, গিজিলার এই সব প্রশ্নে অভি বেশ বিব্রত বোধ করছিল। শুধু বলেছিল, “আমাদের কলাবাগানের লোকেদের মানসিকতার সঙ্গে জার্মান সেনাবাহিনীর টেনাসিটির একটা মিল আছে।”

এই সব কথাবার্তা চলাকালীন হঠাৎ পাড়ায় চেঁচামেচি। রানিদের বাড়ি থেকে কান্নাকাটির আওয়াজ আসছিল। মা বললেন, “অভি গিয়ে দেখে আয় না এক বার, রানিদের কী হল, এক কালে তোর ছাত্রী ছিল। তোর একটা দায়িত্ব আছে।”

অভি কথা না বাড়িয়ে রানিদের বাড়িতে পৌঁছল। যা শুনল, তাতে হতবাক। রানি নাকি সুইসাইড করতে গিয়েছিল! রানিকে পিজি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

রানিদের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। রানির বাবা অনেক দিন আগে মারা গিয়েছেন। অভিকে দেখে রানির মা বললেন, “অভি, সারা দুনিয়ায় এত বড় বড় কাজ করলে, আর তোমার বোকা হাবা ছাত্রীটার দিকে তাকালে না। ওই দেখো, ওর দু’বছরের ছেলেটা মা-মা বলে কাঁদছে। রানির উপর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা, এমনকি ওর বরও এত অত্যাচার করত যে, সহ্য না করতে পেরে মেয়ে আমার বিষ খেয়েছে! এখন রানির কিছু হলে এই ছেলেটাকে নিয়ে আমি কী করব বলতে পারো...” কান্নায় ভেঙে পড়লেন রানির মা।

একটা ট্যাক্সি নিয়ে কিছুটা হতবুদ্ধি অবস্থায় অভি পিজি হাসপাতালে পৌঁছল। তার পর পাড়ার ছেলেদের সাহায্যে রানির বেডের কাছে যখন পৌঁছল, রানি তখন কোমায় আচ্ছন্ন। রানির বেডের পাশে যে ডাক্তারবাবু দাঁড়িয়েছিলেন, পাড়ার ছেলেদের গুঞ্জনে তিনি বুঝতে পারলেন, অভিই রানির ছোটবেলার মাস্টারমশাই।

চশমার ফাঁক দিয়ে অভির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “আপনিই পেশেন্টের মাস্টারমশাই! পেশেন্ট তো শুধু বলছে, ‘মাস্টারমশাই, আমাকে ছাড়বেন না। আমি সব পরীক্ষায় আপনাকে নিয়ে পাস করব...’ থাকুন একটু, যদি আপনাকে কিছু বলে...” বলে ডাক্তারবাবু চলে গেলেন।

রানির বেডের সামনে অভি কত ক্ষণ দাঁড়িয়েছিল জানে না, হঠাৎ মনে হল রানি যেন চোখ খুলে তাকে দেখতে পেয়েছে, তখনই তার হাতটা চেপে ধরে বলল, “মাস্টারমশাই আর পারছি না। আপনি আমার দু’বছরের ছেলেটার দায়িত্ব নিন। ওকে আপনার মতো তৈরি করে দিন। শ্বশুর-শাশুড়ির অত্যাচারে বিষ খেয়েছি। কোনও দিন কিছু চাইনি আপনার কাছে, শুধু আজ কথা দিন যে, আমার ছেলেকে আপনি লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করবেন। না হলে আমি মরেও শান্তি পাব না, মাস্টারমশাই...”

রানি মারা যাওয়ার পর রানির শ্বশুর ছেলের দ্বিতীয় বার বিয়ে দিলেন, আর বাপি, অর্থাৎ রানির ছেলেকে দত্তক নিয়ে অভি আর গিজিলা সিনসিনাটিতে ফিরে এসেছিল।

সেও প্রায় কুড়ি বছর হয়ে গেল। অভি এখনও ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়, বাপিও ফিজ়িক্সে মাস্টার্স ডিগ্রি করছে। তবে তার নাম এখন আর বাপি নয়, গিজিলা তার নাম বদল করে রেখেছে জন।

আজ রবিবার, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পাতা ঝরার সময় শুরু হওয়ার আগে, সকালের রোদে গার্ডেন চেয়ারে গিজিলা আর আর জন বসে চা খাচ্ছে। অভি বাগানের এক কোণে খুব লম্বা শিকড়সমেত একটা গাছ পোঁতার চেষ্টা করছে।

জন বাবার কাছে এসে বসল। খানিক ক্ষণ বাবার মাটি খুঁড়ে শিকড়টা ঢোকানোর চেষ্টা দেখে বাবাকে জিজ্ঞেস করল, “ড্যাড, কী করতে চাইছ?”

অভি হেসে বলল, “আমি এই গাছের শিকড়টা মাটির এত গভীরে পুঁতে দিতে চাইছি, যাতে মাটির তলা দিয়ে পৃথিবীর আর এক প্রান্ত পর্যন্ত এটা বিস্তারিত হতে পারে।”

জন কিছু বুঝতে পারল না। গিজিলা বলল, “ইয়োর ড্যাড ওয়ান্টস টু সার্চ আ রুট।”

জন এ কথায় আরও অবাক হয়ে গেল। শুধু অভি নিজের মনে মনে বলল, ‘আমাদের শিকড়টা কী করে আবার ফিরে পাব? জানি না।’

গিজিলা কোনও কথা না বলে, উঠে গিয়ে ড্রইংরুমের সাউন্ড সিস্টেমে অভির একটা প্রিয় গান চালিয়ে দিল, ‘সার্থক জনম আমার, জন্মেছি এই দেশে/ সার্থক জনম মাগো, তোমায় ভালবেসে...”

অভি পঁচিশ বছরে গিজিলাকে অনেকটা বাঙালি করে তুলেছিল, কিন্তু ও যে অভিকে এতটা বুঝেছে, সেটা ভেবে ওর চোখটা ভিজে উঠল।

তার মনে হল, এটা বোধহয় সেই অদৃশ্য শিকড়ের প্রভাব।


ছবি: সৌমেন দাস

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

story Short story

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}