Advertisement
E-Paper

ব্লাড ক্যানসার রোগী, ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা, অশীতিপর শুনানির লাইনে! কমিশনের ‘বাড়ি যাব’ কেবল ঘোষণা? চতুর্থ দিনে প্রশ্ন

কারও বয়স ৮০, কেউ ৯০ পার করেছেন। অশক্ত, অসুস্থ শরীরটাকে প্রায় টানতে টানতে তাঁরা পৌঁছোচ্ছেন এসআইআরের শুনানিকেন্দ্রে। কমিশনের বিবৃতির পরেও বাস্তব পরিস্থিতি এমনই। যে ভাবে দেখা গেল শুনানির চতুর্থ দিন।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ ২১:২৯
SIR In West Bengal

হয়রানির নানা মুখ। এসআইআরের শুনানির চতুর্থ দিন। —নিজস্ব ছবি।

ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর)-এর শুনানি প্রক্রিয়ায় বয়স্ক এবং অসুস্থদের কথা ভেবে নতুন নিয়ম করেছে নির্বাচন কমিশন। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আবেদনের ভিত্তিতে ভোটারের বাড়ি গিয়ে শুনানি করবে তারা। কিন্তু কাগুজে ঘোষণার বাস্তব প্রতিফলন দেখা গেল না এসআইআর-শুনানির চতুর্থ দিনেও। জেলায় জেলায় শুনানিকেন্দ্রের সামনে লম্বা লাইন। সেখানে অপেক্ষারতদের মধ্যে দেখা গেল অসুস্থ বৃদ্ধ থেকে অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে। অ্যাম্বুল্যান্সে করে শয্যাশায়ী বৃদ্ধ গেলেন শুনানিকেন্দ্রে। আবার শুনানির ভয়ে আত্মহত্যা এবং অসুস্থ হয়ে পড়ার অভিযোগও উঠল। হয়রানি চলছেই— তারই খণ্ড খণ্ড ছবি ধরা পড়ল রাজ্যের নানা জায়গায়।

বীরভূমে মুখে অক্সিজেনের নল লাগানো অবস্থায় শুনানিকেন্দ্রে হাজির হয়েছিলেন ৬৫ বছরের সজল পাল। একদা মার্চেন্ট নেভিতে কাজ করা বৃদ্ধ ‘প্রশাসনের মানবিকতা’ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সজল বোলপুরের বাসিন্দা। চাকরির সূত্রে যৌবনে বাইরে কাটিয়েছেন। সে জন্য ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় তাঁর নাম তোলা হয়নি বলে দাবি বৃদ্ধের। কমিশনের নোটিস পেয়ে বোলপুর–শ্রীনিকেতন ব্লক অফিসে হাজির হয়েছিলেন মুখে অক্সিজেনের নল লাগানো অবস্থায়। এসআইআর প্রক্রিয়ায় অব্যস্থার অভিযোগ তুলে ক্ষোভে ফেটে পড়েন প্রাক্তন এই মার্চেন্ট নেভি আধিকারিক। তিনি বলেন, ‘‘এমন একটি দেশে বাস করছি, যেখানে দেশের হয়ে কাজ করার পরেও নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হয়।” তাঁর ওই মন্তব্য শুনে শুনানি‌তে হাজির হওয়া বাকিদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়। অসুস্থ এবং প্রবীণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক সংবেদনশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাঁরা।

দুর্গাপুরের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের বেনাচিতি সুভাষপল্লি এলাকার বাসিন্দা কলি ঘোষ দস্তিদার। বয়স ৭৬ বছর। হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সম্প্রতি পেসমেকার বসিয়ে বাড়িতে ফিরেছেন। কিন্তু বাড়িতে ফিরেই ডাক পেয়েছেন শুনানিতে। মঙ্গলবার গাড়িভাড়া করে দুর্গাপুরের ভিরিঙ্গি টিএন স্কুলের শুনানিকেন্দ্রে উপস্থিত হন বৃদ্ধা। তাঁর কথায়, ‘‘খুব কষ্ট হল। তবু আসতেই হল।’’ মেয়ে নিশা ঘোষ দস্তিদার বলেন, ‘‘মায়ের অবস্থা এমনিতেই খারাপ। তার পরেও নিয়ে আসতে হল। বাড়িতে গিয়ে যদি শুনানি হত, তা হলে ভাল হত। এখন তো আমাদের চরম সমস্যার মধ্যে পড়ে এখানে আসতে হয়েছে।’’

কারও বয়স ৮০, কেউ ৯০ পার করেছেন। এমনই চার প্রবীণা ভোটার অ্যাম্বুল্যান্সে চেপে হাজির হলেন মুর্শিদাবাদের শুনানিকেন্দ্রে। জিয়াগঞ্জে সিংঘী উচ্চবিদ্যালয়ে চলছে মুর্শিদাবাদ বিধানসভার ভোটার তালিকার সংশোধন। সেখানে মলিনা দাস, নির্মলা সরকার, কল্যাণী দাস এবং শিবানী দাস প্রমুখ প্রবীণাকে লাইনে দেখে মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ পুরসভার চেয়ারম্যান প্রসেনজিৎ ঘোষের মন্তব্য, ‘‘এসআইআরের নামে প্রহসন চলছে। বৈধ ভোটারদের নাম বাদ দিতে শীতের মধ্যে বৃদ্ধদের বাড়ি থেকে রাস্তায় বার হতে বাধ্য করা হচ্ছে।’’

কোচবিহারে মহকুমাশাসকের দফতরে গিয়ে দীর্ঘ ক্ষণ থেকে বসে ছিলেন ব্লাড ক্যানসার আক্রান্ত ৭৫ বছরের বৃদ্ধা। নাম লেখা চক্রবর্তী। কোচবিহার ২ নম্বর ওয়ার্ডের ২৩৯ নম্বর বুথের ওই বাসিন্দার বাড়ির চার সদস্যের নাম ভোটার খসড়া তালিকায় বেরোয়নি। কনকনে ঠান্ডায় অসুস্থ মায়ের পাশে বসে পুত্র পঙ্কজ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এসআইআরের যে খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, সেখানে আমাদের পরিবারের চার জনের নাম নেই। তার মধ্যে আমার মা রয়েছেন। ২০০২ সালের ভোটার তালিকার জায়গায় আমার আত্মীয়ের নামও দেওয়া হয়েছিল। তার পরেও আমাদের নাম আসেনি। তার পরিণতি হল অসুস্থ মাকে নিয়ে এখানে (শুনানিকেন্দ্রে) বসে আছি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘বাড়ি গিয়ে যদি শুনানি করা হত, তা হলে ভাল হত। নির্বাচন কমিশনের কাছে অনুরোধ করব, যাঁরা অসুস্থ, বয়স্ক তাঁদের যদি বাড়ি গিয়ে ‘হেয়ারিং প্রসেস’ করা হয় তা হলে খুব ভাল হয়।’’

কমিশনের নয়া নির্দেশিকার পরও হয়রানিই ভবিতব্য। এমনই মনে করেন নকশালবাড়ি বিডিও অফিসে শুনানির জন্য লাইনে দাঁড়ানো আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা সৃজনা রাই। বাড়ি থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে শুনানিকেন্দ্র গিয়েছিলেন তিনি। সৃজনা বলেন, ‘‘আরও আগে যদি বলত কমিশন যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শুনানি করবে...।’’ ঝাঁজিয়ে ওঠেন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সৃজনার স্বামী বিশ্বদীপ। তিনি বলেন, ‘‘একটা বসবার জায়গা পর্যন্ত নেই! বাড়িতে গিয়ে শুনানির কথা কমিশন জানিয়েছে শুনলাম। কিন্তু কখন কবে তা তো জানি না।’’ এই ঘটনা নজরে পড়েছে দার্জিলিং জেলা তৃণমূল কোর কমিটির সদস্য পাপিয়া ঘোষের। তিনি বলেন, ‘‘আমরা আমাদের বিএলএদের জানিয়েছি, এই ধরনের বিষয়গুলির উপর নজর রাখতে। সৃজনার মতো কেউ যদি শুনানিতে চলেও আসেন, তা হলেও যেন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়। তাঁদের বাড়ি গিয়ে যাতে শুনানি হয়, সেটাই দেখব।’’

উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতের বরিশাল কলোনির বাসিন্দা সুনীল বারুই দীর্ঘ দিন ধরে শয্যাশায়ী। ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় নাম নেই তাঁর। তাই ৮৫ বছর বয়সে এই প্রচণ্ড শীতের মধ্যে অ্যাম্বুল্যান্সে শুয়ে শুনানিকেন্দ্রে পৌঁছোন। পরিবারের দাবি, বাড়ি গিয়ে শুনানির আবেদন নাকচ হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করা হয়েছে। যদিও ওই বৃদ্ধের কাজ দ্রুত করে ছেড়ে দিয়েছে কমিশন।

নোটিস পেয়ে ১০২ বছর বয়সে নাওয়া-খাওয়া ভুলেছেন পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালের ইড়পালা গ্রাম পঞ্চায়েতের খাসবাড় ৩২ নম্বর বুথের বাসিন্দা গান্ধারী জানা। বয়সের ভারে ন্যুব্জ গান্ধারী ওই এলাকার সবচেয়ে প্রবীণা। তাঁর বাড়ির লোকজন বলেন, ‘‘এত বছর ধরে ভোট দিয়ে আসার পরেও তাঁকে এই বয়সে এসে প্রমাণ দিতে হবে!’’ সংশ্লিষ্ট বুথের বিএলও হীরালাল সিংহ জানান, ‘ডাটা নো ফাউন্ড’ দেখানোর কারণে শুনানির নোটিস দেওয়া হয়েছে। ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় ওঁর নাম থাকলেও বিএলও অ্যাপে ফর্ম ডিজিটাইজেশনের সময় ‘নট ফাউন্ড’ দেখাচ্ছে। তাই নোটিস। ওই নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চাপানউতর।

যা বলেছিল কমিশন

সোমবার সিইও দফতর থেকে জানানো হয়েছে, তিন ধরনের ভোটার যদি অনুরোধ করেন, তাঁদের শুনানিতে ডাকা হবে না। সেখানকার বিএলও, ইআরও এবং এইআরও-দের বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। কমিশন বলেছে, ৮৫ বছর বা তার বেশি বয়সি ভোটারদের শুনানিকেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। অসুস্থ এবং বিশেষ ভাবে সক্ষমদেরও শুনানিকেন্দ্রে যেতে হবে না। এই তিন ধরনের কোনও ভোটার যদি হাজিরার নোটিস পান, তা হলে তাঁরা চাইলে ইআরও, বিএলও বা এইআরও-কে জানাতে পারবেন। পরে সংশ্লিষ্ট ভোটারের বাড়িতে গিয়ে শুনানির কাজ সারা হবে।

জয় গোস্বামীকে নোটিস

নির্বাচন কমিশন তলব করেছে কবি জয় গোস্বামীকে। মঙ্গলবার তাঁর পরিবার সূত্রে এমনটাই জানা গিয়েছে। কবিকে ২ জানুয়ারি তলব করা হয়েছে বলেই জানিয়েছেন কন্যা দেবত্রী গোস্বামী। ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় নাম নেই জয়ের। টালিগঞ্জ বিধানসভার ভোটার জয়ের পরিবার। স্ত্রী কাবেরী ও কন্যা দেবত্রীর নাম খসড়া ভোটার তালিকায় রয়েছে। পরিবার সূত্রে জানা যাচ্ছে, ২০০২ সাল পর্যন্ত ভোটার তালিকায় নাম পর্যন্ত ছিল না কবির। এমনকি ভোট দিতেও যেতেন না তিনি। কিন্তু তার পর থেকে ধারাবাহিক ভাবে ভোট দিয়ে এসেছেন তিনি। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনেও নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।

সেই তো নাম এল!

মেদিনীপুর শহরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের তোলাপাড়া এলাকার বাসিন্দা ৮৫ বছরের ক্ষীতিশ মজুমদার গত ৩০ অক্টোবর বীরভূমের ইলামবাজারে মেয়ের বাড়িতে আত্মহত্যা করেছিলেন। পরিবারের দাবি, এসআইআরের আতঙ্কে নিজেকে শেষ করেছেন বৃদ্ধ। সেই বৃদ্ধের নাতি প্রদীপ মজুমদারের নাম রয়েছে খসড়া তালিকায়। দাদু মারা যাওয়ার পর বাড়িতে একাই থাকেন ২৩ বছরের প্রদীপ। তিনি বলেন, ‘‘এসআইআরের ফর্ম দাদু, মা এবং আমার নামে এসেছিল। সবগুলো পূরণ করে জমা দিয়েছিলেন। দাদু, মা মারা গিয়েছেন, সেই তথ্য দিয়েছি।’’ প্রকাশিত খসড়া তালিকায় প্রদীপের নাম রয়েছে ১৫২ বুথের ৪৪১ নম্বরে। বাংলাদেশ থেকে এ দেশে এসেছিলেন তিনি। থাকতেন মেদিনীপুরের বাংলাদেশি কলোনি এলাকায়। ১৫২, ১৫৩, ১৫৪ বুথ এলাকাটির শতাধিক পরিবার এসআইআরের শুনানিতে হাজিরার নির্দেশ পেয়েছে।

পাশে আছি

আগে বলেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বার বললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রী তাঁর দলের বিএলএ-দের শিবির করে বসতে বললেন। তাঁর বার্তা, “কেউ ভয় পাবেন না। দল আপনাদের পাশে আছে। সরকারও পাশে আছে।” শুনানিকেন্দ্রের ভিতর কেন বিএলএ-দের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, তার ব্যাখ্যা দিয়ে মমতার দাবি, বিজেপির লোক নেই বলেই কোনও দলের বিএলএ-দেরই ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। বাঁকুড়ার জনসভা থেকে বিজেপি এবং কমিশনকে তোপ দাগেন মুখ্যমন্ত্রী। শুনানিতে বয়স্ক মানুষদের হেনস্থা করার অভিযোগ তোলেন তিনি। “একটা ন্যায্য লোকের নাম বাদ দেওয়া হলে আন্দোলন দিল্লিতেও হবে, বাংলাতেও হবে।” তা ছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে এসআইআর-এ ৫৪ লক্ষ লোকের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর অভিযোগ, কমিশনের অফিসে বিজেপির আইটি সেলের লোক বসে রয়েছে। নামের ইংরেজি বানানের রকমফেরের জন্য নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করলেন মুখ্যমন্ত্রী।

SIR West Bengal SIR Election Commission SIR hearing
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy