Advertisement
E-Paper

পশ্চিম রাঢ়ের অন্য দীপাবলি

সে দিন কপিলাদের দেখতে মর্ত্যে নেমে আসেন শিবঠাকুর। তাই এ সময় গরু-ছাগলদের বরাদ্দ শুধু ভাল খাবার আর আদরযত্ন।

প্রবীর সরকার

শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২২ ১০:০৫
রঙিন: বাঁদনা পরবের দিন নানা রঙে সাজানো হয় গবাদি পশুদের

রঙিন: বাঁদনা পরবের দিন নানা রঙে সাজানো হয় গবাদি পশুদের

পশ্চিম সীমান্ত-রাঢ়ের জনপ্রিয় মঙ্গলকাব্য ‘কপিলামঙ্গল’। এই পালাগান স্থানীয় ভাবে ‘অহীরা গীত’ নামেও পরিচিত। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধের মধ্যে কাশীনাথ দাস, ক্ষুদিরাম দাস, কেতকাদাস প্রমুখ বহু কবি এ কাব্য লিখেছেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান মল্লভূমের কবি শঙ্কর কবিচন্দ্র। কপিলামঙ্গলের কাহিনি অনেকাংশে ভাগবত পুরাণ আশ্রিত, তবে স্থানীয় লোককথাও মিশে গেছে। কপিলামঙ্গলের কাহিনিতে আছে এক দেবসভার কথা। ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর ইন্দ্র বরুণ কার্তিকসহ মুখ্য দেবতারা সকলেই উপস্থিত। আলোচ্য বিষয়টি গুরুতর, মর্ত্যবাসীদের মধ্যে আজকাল ভক্তির বড় অভাব। বিস্তর আলোচনা, বিতর্ক এবং গবেষণার পর জানা গেল, মর্ত্যভূমিতে গাভী নেই বলেই যত অনাচার। যেখানে পঞ্চগব্য মেলে না, সেখানে দেব-বন্দনায় ভক্তিভাব আসবে কেমন করে! অনেক ভেবে ব্রহ্মা প্রস্তাব দিলেন, স্বর্গের কপিলা কিছু দিন স্বর্গ ছেড়ে মর্ত্যে গিয়ে থাকুক। তার পুণ্যপ্রভাবে মানুষের মনে ভক্তিভাব ফিরে আসবে। কিন্তু স্বর্গগাভী কপিলা থাকে কল্পতরুর নীচে, স্বর্গসুখ ছেড়ে কেন মর্ত্যে যাবে সে? ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর তিন জন একত্রে গেলেন সেই কল্পতরুর কাছে, সব কথা জানিয়ে অনুরোধ করলেন—‘অবনী মণ্ডলে যাত্রা কর ঠাকুরানী।/ তুমা বিনে বিফল হঞয়েছেন ধরণী॥’

আকাশ ভেঙে পড়ে কপিলার মাথায়। এমন স্বর্গসুখ ছেড়ে যেতে হবে মর্ত্যে! তার পর ছোট ছেলে মনোরথ, এখনও শিং ওঠেনি! কিন্তু দেবতাদের অনুরোধ মানে তো আদেশ। তবু মিনতি করে কপিলা, পৃথিবীতে জীবনযাপন যে কত কষ্টের, তার ফিরিস্তি দেয়— ‘অবনী মণ্ডলে গেলে বড় দুঃখ পাব। / সুধারস তেজিয়া কেমনে ঘাস খাব॥’

এর পর আছে মানুষের হাতে নিত্য অপমান আর লাঞ্ছনা। মনোরথকে তারা আলাদা করে দেবে মায়ের কাছ থেকে। ছেলের জন্য দুধও রাখতে পারবে না, জোর করে সবটা দুইয়ে নেবে। আবার বেশি দুধ দিতে না পারলে ‘চরা গাই বলিয়া থুইব নাম মোর’। চাষির হাতে মার খেতে হবে। চোখে ঠুলি পরিয়ে বেদম খাটাবে। থাকতে দেবে নোংরা গোয়ালে, সেখানে মশার উৎপাত, বাইরে বাঘের ভয়। নিজের দুঃখ তবু সহ্য হবে, কিন্তু সন্তান মনোরথের দুঃখ কোনও মতেই সইতে পারবে না কপিলা। দেবতারা প্রতিশ্রুতি দিলেন— ‘পদাঘাত তোমারে যদ্যপি কেহ করে।/ মস্তক পাতিয়া লব সকল অমরে॥’

শেষে শিবঠাকুরও বললেন, ‘তুই যা রে কপিলা। মর্ত্যে তোর কষ্ট হবে না। মানুষেরা ভক্তি করবে, আর আমিও মাঝে মাঝে রাতের অন্ধকারে চুপি চুপি গিয়ে দেখে আসব কেমন যত্ন-আত্তি করছে তারা।’

সে দিন কার্তিকের অমাবস্যা। সুরলোক থেকে নরলোকে এল কপিলা। সঙ্গে শিবঠাকুর। আকাশ জুড়ে আলোর পথ দেখালেন দেবতারা। সেই আলোই দীপাবলির আলো। তার পর থেকে প্রতি বছর ওই কার্তিকের অমাবস্যায় আলোর পথ বেয়ে শিবঠাকুর নেমে আসেন মর্ত্যে, দেখতে আসেন তাঁর কপিলা কেমন আছে, মনোরথেরা কেমন আছে। অন্ধকারে ভোলানাথের যেন পথভুল না হয়, তাই যাত্রাপথে আলো জ্বালিয়ে রাখে পশ্চিম রাঢ়ের কৃষক সমাজ। সঙ্গে তিন থেকে পাঁচ দিনের একটি লোকায়ত উৎসব। নাম ‘বাঁদনা’ পরব, অর্থাৎ গো-বন্দনার উৎসব। তার নানা আচার, বিচিত্র আয়োজন। গোয়াল ঘর পরিচ্ছন্ন করা, নদী কিংবা বাঁধে নিয়ে গিয়ে গরুগুলিকে ভাল করে স্নান ও পরিচ্ছন্ন করানো, শিঙে ঘাড়ে তেল মাখানো, কপালে চালগুড়ি আর সিঁদুরের টিপ পরানো, শিং আর গলায় শালুক ফুলের মালা। সারা বছর সেবা করে যে গরু, তাকে তো কিছুটা ফিরিয়ে দিতেই হবে। রাতের অন্ধকারে শিবঠাকুর কখন তাঁর কপিলাকে দেখতে আসবেন কেউ জানে না, তাই তিন দিন ধরে ‘বাঁদনা’ পরব। এই সময়টা নির্ধারিত থাকে গবাদি পশুর বিশ্রামের জন্য, আর তাদের সেবার জন্য। গরুকে প্রহার করা যায় না এই দিনগুলিতে। লাঠিগুলি দূরে দূরে ছুড়ে ফেলে দেয় গোপালকের দল। তিন দিনের উৎসবে প্রথম দিনের নাম ‘জাওয়ার’, দ্বিতীয় দিন ‘জাগর’, তৃতীয় দিন ‘গয়রা’। চতুর্থ আর পঞ্চম দিনেও তার রেশ থাকে কোথাও কোথাও। সে সব দিনে ‘গয়রা-গোঁসাই পূজা’, ‘চইখপুরা’, ‘গরু চুমা’, ‘গোঠ পূজা’, ‘গরু খুটা’, ‘কাঁড়া খুটা’— চলতে থাকে নানা লোকাচার। সব গরু বিশ্রাম পায় এই সব দিনে, ভাল ভাল খাবার পায়। কচি ঘাস, খড়. লতাপাতা, খোলভুষি সব মজুত থাকে আগে থেকে। গরু-বাছুরের সঙ্গে এই সময়টায় আদরযত্ন পায় কাঁড়া-মোষ, ছাগল-ভেড়ারাও।

কার্তিকী অমাবস্যায় দেশ যখন আলোর উৎসবে উত্তাল, তখন জঙ্গলমহলের এ উৎসবে আলো জ্বলে ভিন্ন স্নিগ্ধতায়। ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি যখন প্রতীক-বিস্মৃত পশুবলির উল্লাসে মত্ত, তখন সেই চোখ-ধাঁধানো আলোর আড়ালে ‘বাঁদনা পরব’ এক আশ্চর্য সবুজ দ্বীপখণ্ড। গবাদি পশুর প্রতি মমতায় আলোর এ উৎসব যেন আরও বেশি উজ্জ্বল।

Bandna Festival purulia bankura
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy