E-Paper

চুরি গেলেন চ্যাপলিন

তাও আবার মৃত্যুর পর এবং কফিনসুদ্ধ। মৃত কমেডি-সম্রাটের জন্য মুক্তিপণ ধার্য হয়েছিল ছ’লক্ষ মার্কিন ডলার। প্রয়াণের পরও যেন এক বিস্ময়-নাটকের অংশ হয়ে উঠলেন এই অভিনেতা।

শেষকৃত্য: মৃত্যুর পর সমাহিত করা হচ্ছে চার্লি চ্যাপলিনকে।

শেষকৃত্য: মৃত্যুর পর সমাহিত করা হচ্ছে চার্লি চ্যাপলিনকে।

সুব্রত মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০২৫ ০৮:৩৬
Share
Save


শহরের নাম ভেভে। সুইটজ়ারল্যান্ডের জেনেভা লেকের পাশে ছোট্ট শহর। সেখানে আজ খুব শোরগোল। শহর যেন উত্তেজনায় ফুটছে। কারণ নগর আদালতে এক জবরদস্ত মামলার শুনানি। সকাল থেকেই কোর্টের বাইরে ভিড়ে ভিড়াক্কার। সেই সঙ্গে যোগ দিয়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সাংবাদিককুল। কী এমন ঘটনা, যা নিয়ে তোলপাড় এই শহর?

সেটা জানতে হলে ঢুকে পড়তে হবে আদালতের এজলাসে। বিচারকের আসনে বসে আছেন বিচারক। কাঠগড়ায় আসামি দুই যুবক। সরকারি আইনজীবীকে দিয়ে শুনানি শুরু করলেন বিচারক।

আইনজীবীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বিচারক জানতে পারলেন, মামলাটি অপহরণ ও মুক্তিপণ দাবির। চাওয়া হয়েছে ছয় লক্ষ ডলার। অপহৃত ব্যক্তিকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁর কফিন এখন কোর্টের সম্মুখে রাখা রয়েছে বিচারপ্রক্রিয়ার জন্য।

কফিন প্রসঙ্গে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন বিচারক, “বলেন কী, অপহরণের পর কি খুন করা হয়েছে?”

সরকারি আইনজীবী জানান, “না হুজুর। খুনের কেসই নয়।”

“তবে কফিনের মধ্যে কী করে গেল?”

“হুজুর, মারা যাওয়ার পর অপহরণ হয়েছে।”

বিচারক হতভম্ব, “মারা যাওয়ার পর অপহরণ?”

“মুক্তিপণের লোভে ওঁকে অপহরণ করাহয়েছে হুজুর।”

বিচারক অধৈর্য, “আরে মারা-ই যদি গিয়ে থাকেন, তবে অপহরণ কী করে হয়? ব্যাপারটা ঠিক করে বলুন তো!”

“হুজুর, মৃত্যু হয়েছিল ২৫ ডিসেম্বর। কবর দেওয়া হয়েছিল ৩০ ডিসেম্বর। তার মাসখানেকের মধ্যেই কবর খুঁড়ে কফিন নিয়ে পালায় এই দুই চোর। তার পরই মুক্তিপণ দাবি করে।”

বিচারক এত ক্ষণে বুঝলেন বিষয়টা। বললেন, “এটাকে অপহরণ না বলে চুরি বলা ভাল, কারণ যাকে অপহরণ করা হয়েছে, তিনি তো আর জীবিত নন। সে যা-ই হোক, অপহৃত ব্যক্তির নাম কী?”

সরকারি আইনজীবী সসম্ভ্রমে বললেন, “ধর্মাবতার, তাঁর নাম সারা পৃথিবী জানে। তিনি চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন।”

জন্ম এবং মৃত্যু— দুটোতেই হয়তো নিজের অজান্তে ঠাট্টা করে গেছেন পৃথিবীর সর্বকালের সেরা এই কৌতুক অভিনেতা। জন্ম লন্ডনে। ইংল্যান্ডের সমস্ত নবজাতকের ঠিকুজি-কুষ্ঠি যেখানে নথিভুক্ত থাকে, সেই সমারসেট হাউস-এ, চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন নামে কোনও নামই নেই। হয়তো তিনি বিশ্বনাগরিক বলেই পৃথিবীর কোনও দেশেই তাঁর স্থায়ী বাসস্থান জুটল না। ইংল্যান্ড ত্যাগ করতে হয়েছিল তাঁকে। আমেরিকাও তাঁকে ভাল চোখে দেখেনি। শেষ জীবন কাটে সুইটজ়ারল্যান্ডের এক অখ্যাত শহরে।

স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চ্যাপলিন ১৯৫৩ সালে সুইটজ়ারল্যান্ডে চলে আসেন। ১৯৭২ সালে ৮৩ বছর বয়সে তাঁর অস্কারপ্রাপ্তি এবং ১৯৭৭ সালের ক্রিসমাসের দিন ৮৮ বছর বয়সে কর্সিয়ার-সুর-ভেভের বাড়িতে তিনি মারা যান। চার দিন পরে শহরের অ্যাংলিকান চার্চে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর মৃতদেহ স্থানীয় কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। চ্যাপলিনের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী প্রায় একশো মিলিয়ন ডলার সম্পত্তির অধিকারী হন।

জীবিত অবস্থায় যা তাঁর সিনেমার উপজীব্য হতে পারত, তা-ই ঘটল মৃত্যুর পর। স্বয়ং তাঁকে নিয়ে এর চেয়ে বড় রসিকতা আর কী-ই বা হতে পারে? চুরি গেলেন চ্যাপলিন! তাও কফিন সহ!

সমাহিত করার মাস দুয়েকের মধ্যে দুষ্কৃতীরা কবর খুঁড়ে তাঁর মৃতদেহ-সহ কফিন চুরি করে। ১৯৭৮ সালের ১ মার্চ, গভীর রাতে কালো পোশাক পরা, টর্চ এবং বেলচা হাতে দু’জন ব্যক্তিকে দেখা যায় কবরস্থানে ঘুরে বেড়াতে। পরদিন সকালে আলো ফোটার পর দেখা যায়, চ্যাপলিনের কবরটি খোঁড়া, ভিতরে কফিনটি নেই।

কফিন চুরির খবর জানাজানি হতেই চার দিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এটা কী স্মারক-শিকারিদের কাজ? চ্যাপলিনকে কি এখান থেকে সরিয়ে ইংল্যান্ডে সমাহিত করা হবে, যেমনটি এক সময় তাঁর ইচ্ছা ছিল? কেউ এমনও অনুমান করেছিলেন যে, চ্যাপলিন আসলে ইহুদি ছিলেন, তাই তাঁকে ইহুদি কবরস্থানে স্থানান্তরিত করা হয়েছে বা নব্য-নাৎসিরা ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’-এর প্রতিশোধ নিয়েছে। নানা গুজবে ও জল্পনায় কান পাতা দায়।

সুইস পুলিশ বেশ কিছু দিন পুরোপুরি অন্ধকারে ছিল। কারণ সে রাতে সমাধিক্ষেত্রে অন্ধকারে জনাদুয়েক লোককে চলাফেরা করতে দেখা গেছিল, এ ছাড়া কোনও প্রাথমিক সূত্র ছিল না। প্রায় অর্ধশতক আগের এই ঘটনাকে এখনও মৃতদেহ চুরির একটি সাড়া-জাগানো উদাহরণ হিসাবে স্মরণ করা হয়। কফিন-চোররা দিন কয়েক পর কফিন ফেরত দেওয়ার শর্ত হিসাবে চ্যাপলিন পরিবারের কাছ থেকে ছ’লক্ষ মার্কিন ডলার মুক্তিপণ দাবি করে একটি উড়ো ফোন করে। এটি তদন্তকারী স্থানীয় পুলিশকে রহস্যভেদের আর একটি সূত্র দেয়।

সুইস সংবাদপত্রে তাঁর মৃতদেহ চুরির সংবাদ। সৌজন্য: সুইস জাতীয় জাদুঘর।

সুইস সংবাদপত্রে তাঁর মৃতদেহ চুরির সংবাদ। সৌজন্য: সুইস জাতীয় জাদুঘর।

কফিন-চোরেরা শুধু অর্থ দাবি করে থেমে থাকেনি, চ্যাপলিনের কফিন যে তাদের কাছে রয়েছে, তা প্রমাণ করতে গর্তের পাশে থাকা কফিনটির একটি ছবিও তুলেছিল। চ্যাপলিনের স্ত্রী মুক্তিপণের দাবিতে সাড়া দেওয়ার ভান করেন এবং পরিবারের আইনজীবী পরিকল্পনামাফিক দুষ্কৃতীদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি কলে কথাবার্তা চালিয়ে যান। সেই সুযোগে পুলিশ চ্যাপলিনের বাড়ির ফোন ট্যাপ করে কোথা থেকে কলগুলি আসছে তা শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। কফিন-চোরেরা প্রতি বার লুসান এলাকার নানা টেলিফোন বুথ ব্যবহার করত, যার ফলে তদন্তকারীরা প্রায় ২০০টি টেলিফোন বুথের উপর নজর রাখা শুরু করেন। অবশেষে সাফল্য আসে। মৃতদেহ-সহ কফিন চুরির ঠিক ৭৬ দিন পর, পুলিশ অবশেষে দুই কফিন-চোরকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। তাদের নাম রোমান ওয়ার্ডাস এবং গ্যান্টসচো গ্যানেভ। এদের ধরার পর পুলিশ শেষ পর্যন্ত অপহৃত কফিনটি উদ্ধার করে।

তদন্তে প্রকাশ পায়, ধৃত দু’জনেই গাড়ির মেকানিক। এক জন বুলগেরিয়ার এবং অন্য জন পোল্যান্ডের। এক জনের বয়স ২৪, অন্য জনের ৩৮। তারা স্বপ্ন দেখেছিল, তাদের নিজস্ব একটা গাড়ি মেরামতের দোকান হবে। তার জন্য চাই বড় মূলধন। রাতারাতি বড়লোক হওয়ার লক্ষ্যেই ওই অপকর্ম।

দু’জন মিলে রাতের অন্ধকারে ১৩৫ কেজি ওজনের ওক কাঠের কফিনটি কবরস্থান থেকে তুলে একটি গাড়িতে রাখে। গাড়ি নিয়ে নিকটবর্তী নোভিল গ্রামের বাইরে একটি ভুট্টা খেতে বড় গর্ত খুঁড়ে কফিনটি লুকিয়ে রাখে। তার পর চ্যাপলিন পরিবারে উড়ো ফোন এবং মুক্তিপণ দাবি।

দুই গাড়ির মেকানিক যে নেহাতই আনাড়ি এবং পেশাগত দুষ্কৃতী নয়, তা তাদের কাজেই প্রকাশ পায়। ধরা পড়ার পর জেরার মুখে তারা মনে করতে পারেনি, ওই ভুট্টার খেতের কোথায় তারা কফিনটি লুকিয়েছিল। পুলিশকে মেটাল ডিটেক্টর ব্যবহার করতে হয় এবং কফিনের ধাতব হাতলের কারণে চ্যাপলিনের দেহ-সহ সেটি উদ্ধার করা হয়।

‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে জানা যায়, রোমান ওয়ার্ডাস এক জন তরুণ পোলিশ শরণার্থী। বেকারত্ব এবং আর্থিক সমস্যায় ভুগছিল সে। তখনই আলাপ হয় অন্য গাড়ি মেকানিক গ্যান্টসচো গ্যানেভের সঙ্গে। দু’জনেই তখন কর্মহীন। জেরার মুখে রোমান ওয়ার্ডাস জানায়, খবরের কাগজে এই ধরনের একটি ঘটনা পড়ে সে চার্লি চ্যাপলিনের দেহ অপহরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। গ্যানেভ আদালতকে বলে, সে তুরস্কে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে বুলগেরিয়ায় কারাগারে বন্দি হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পালাতে সফল হয়। লুসানে গাড়ির মেকানিকের কাজ পেয়েছিল সে।

ভেভে নগর আদালত চার্লি চ্যাপলিনের কফিন চুরি ও তাঁর পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা করার অভিযোগে, রোমান ওয়ার্ডাসকে সাড়ে চার বছর এবং গ্যান্টসচো গ্যানেভকে দেড় বছরের জন্য কারাদণ্ড দেয়। সম্ভবত রোমান ছিল মূল দুষ্কৃতী, আর গ্যানেভ তার সহকারী।

দুই আসামির শুনানিকালে আরও অনেক তথ্য বেরিয়ে আসে। কফিনটি লুকিয়ে রাখার পর দুষ্কৃতীরা ‘মিস্টার রোচ্যাট’ ছদ্মনাম ব্যবহার করে চ্যাপলিনের বাড়িতে ফোন করে মুক্তিপণ দাবি করে। টাকা না পেলে চ্যাপলিনের স্ত্রী ও সন্তানদের খুনের হুমকি দেয়। চ্যাপলিন পরিবারের আইনজীবী জিন-ফেলিক্স বেশির ভাগ মুক্তিপণের ফোনগুলি ধরেছিলেন। তিনিই আদালতে ‘মিস্টার রোচ্যাট’দের পরিচয় প্রকাশ করেন।

নোভিল গ্রামের বাইরে একটি ভুট্টা খেত থেকে উদ্ধার করার পর চার্লি চ্যাপলিনের দেহাবশেষ দ্বিতীয় বার যথাযথ ভাবে সমাহিত করা হয় কর্সিয়ার-সুর-ভেভের সমাধিক্ষেত্রে। এ বার কফিনটি দু’মিটার কংক্রিটে ঢাকা দিয়ে রেখে, কবরের উপরেও কংক্রিটের একটি স্ল্যাব স্থাপন করা হয়।

এমন একটি রোমাঞ্চকর ঘটনা সংবাদপত্রের প্রতিবেদনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, সেলুলয়েডেও অমর হয়ে গিয়েছে। ফরাসি পরিচালক জ়েভিয়ার বুভোয়াস তাঁর ২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দ্য প্রাইস অব ফেম’ (লা র‌্যানকন দে লা গ্লোয়ার) সিনেমায় ঘটনাটি তুলে ধরেন। বেলজিয়ান কৌতুকাভিনেতা বেনোয়া পোয়েলভোর্দে অভিনীত ফরাসি চলচ্চিত্রে দুষ্কৃতীদের নাম বদলে রাখা হয় এডি ও ওসমান। ছবিতে চ্যাপলিনের মেয়ে অপহরণকারীদের প্রতি কিছুটা সহানুভূতি এবং উদারতা প্রদর্শন করেন।

কফিন চুরি যাওয়ার দিন নির্ঘাত কফিনে শুয়ে মাথার টুপি খুলে হেসেছিলেন চ্যাপলিন। শেষে কি না চুরি হলেন তিনি স্বয়ং! তাও মারা যাওয়ার পর। বেঁচে থাকতে অপহরণ করলে হয়তো দু’পয়সা পেতে পারত গরিব বেকার যুবকদু’টি। ভবঘুরে আনাড়ি দুষ্কৃতীর অপকর্ম গরিবের পেট চালানোর দায় বলেই নির্ঘাত ক্ষমা করেছিলেন তিনি, কফিনে শায়িত অবস্থাতেই।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Charlie Chaplin Switzerland

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।