Advertisement
E-Paper

পাহাড় জুড়ে স্লোগান, ‘জয় গোর্খা!’

থেকে থেকে গুলির শব্দ। দিনগুলো ভয়ংকর থেকে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠছে রোজ। সন্ধে হতে না হতেই দোতলার বারান্দায় দাঁড়ালে চোখে পড়ে দূরের আগুন-লাগা বস্তি আর গ্রামের ঘরগুলো। সালটা ১৯৮৬-’৮৭। দার্জিলিঙের কুয়াশা-ঢাকা সকাল আর সন্ধেগুলো তখন অশান্ত।

শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০০
কালিম্পং, ১৯৮৬। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সময় এ রকম দৃশ্য প্রায়ই দেখা যেত পাহাড়ি শহরগুলোর রাস্তার মোড়ে।

কালিম্পং, ১৯৮৬। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সময় এ রকম দৃশ্য প্রায়ই দেখা যেত পাহাড়ি শহরগুলোর রাস্তার মোড়ে।

থেকে থেকে গুলির শব্দ। দিনগুলো ভয়ংকর থেকে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠছে রোজ। সন্ধে হতে না হতেই দোতলার বারান্দায় দাঁড়ালে চোখে পড়ে দূরের আগুন-লাগা বস্তি আর গ্রামের ঘরগুলো। সালটা ১৯৮৬-’৮৭। দার্জিলিঙের কুয়াশা-ঢাকা সকাল আর সন্ধেগুলো তখন অশান্ত। গুলির আওয়াজ, মিছিলের স্লোগান— ‘জয় গোর্খা জয় গোর্খা’, ‘হাম্রো মাঙ্‌ দিনু পড়ছ’, ‘জ্যোতি বসু হায় হায়, বঙ্গাল সরকার হায় হায়’। বম্বিং-এর বুক-কাঁপানো শব্দে উত্তাল দার্জিলিং, কালিম্পং আর কার্শিয়াং, এই তিনটে শহর।

গোর্খাল্যান্ড পাওয়ার দাবিতে সুবাস ঘিসিংয়ের নেতৃত্বে তখন জোর কদমে চলছে ‘গোর্খা আন্দোলন’। আমরা তখন দার্জিলিংয়েই থাকি, আমার স্বামী সেখানে প্রশাসনের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এক পদে। চব্বিশ ঘণ্টাই ব্যস্ত, বাড়ি আসা-যাওয়ার সময়ের কোনও ঠিক নেই। আমাদের কোয়ার্টার্স ছিল দার্জিলিঙের চকবাজারে। বন্দুকের গুলি কখনও কখনও ঘরের দেওয়াল ফুটো করে ঢুকে যেত। তাই পুরো অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফিস জায়গা বদল করে নিয়ে যাওয়া হল ম্যাল-এর পিছন দিকে, রবীন্দ্র সদন বা ভানু ভবন (আজকের গোর্খা রঙ্গমঞ্চ ভবন)-এ। আমার স্বামী সেখান থেকে কোনও কোনও দিন রাতে এক-দু’ঘণ্টার জন্য বাড়ি আসতেন। দুটো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ঘরে, স্কুলে যায়— এক জন লোরেটো কনভেন্টে, আর এক জন মাউন্ট হারমন স্কুলে। গোর্খা লিবারেশন ফ্রন্ট আর পুলিশের মধ্যে যখন-তখন বেধে যেত গুলির লড়াই। ফল: বন্‌ধ। স্কুল-কলেজ, গাড়িঘোড়া, অফিস, বাজার, সব নিমেষের মধ্যে বন্ধ হয়ে পুরোপুরি অচলাবস্থার সৃষ্টি হত। বাচ্চাদের স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে আসাটাও ছিল বিপজ্জনক। লোরেটো কনভেন্ট তো তা-ও চকবাজারেই, কিন্তু ছেলে বাড়ি ফিরে না আসা অবধি আমার বুক দুরদুর করত, ঠিকমত ফিরবে তো? তখন মাউন্ট হারমন স্কুলের প্রিন্সিপাল ছিলেন এক জন অস্ট্রেলিয়ান, রেভারেন্ড জন জনস্টন। তিনি স্কুলের বড় গেটে তালা লাগিয়ে বোর্ডার বাচ্চাদের পড়াশোনা নিজেই দেখতেন, আর ক্লাস শেষে ডে-স্কলার জুনিয়র ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি পাঠাতেন সিনিয়র স্টু়ডেন্টদের সঙ্গে। পিকেটারদের কথা অগ্রাহ্য করতেন, স্কুল বন্ধ করতেন না। এ জন্য লিবারেশন ফ্রন্টের হাতে তাঁর কম দুর্ভোগ হয়নি। ইটের ঘায়ে কপাল ফেটে গেছে, স্কুলের ইনফার্মারিতে গিয়ে কপালে ব্যান্ডেজ বেঁধে এসে কাজে বসেছেন, কিন্তু স্কুলের কাজ থেকে তাঁকে বিরত করা যায়নি।

আরও এক জনের কথা না বললেই নয়। আর কে হান্ডা— তদানীন্তন পুলিশ সুপারিনটেন্ডেন্ট। সবাই বলত, মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ও আর কে হান্ডার মাথা একসঙ্গে কাজ করত। তাঁদের নেতৃত্বেই এই আন্দোলন স্তব্ধ হয়েছিল।

বাড়িতে আসতেন দার্জিলিং শ্রীরামকৃষ্ণ বিএড কলেজের অধ্যাপক দেবপ্রসাদ ভড়। বিপত্নীক মানুষ, আমাদের বাড়ি রাতের খাবার খেয়ে, গল্প করে, বারোটা বাজলে রওনা দিতেন নিজের কোয়ার্টার্সে— ক্যাপিটাল সিনেমা হল পেরিয়ে, স্প্রিংবার্ন হোটেলের পাশে। এই ভীষণ গন্ডগোলের সময়ও রোজ রাতে একা হেঁটে বাড়ি ফিরতেন। কনকনে শীতের রাত, শুনশান রাস্তায় একটা কুকুরও থাকত না। রাস্তার কোনায় প্রায়ই দেখা যেত পলিব্যাগে মোড়া কাটা মুন্ডু, ব্যাগের মধ্যে কাটা হাত-পা, ভোজালির কোপে ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। বেশির ভাগ খুনগুলো ঘটত রাতেই। বারোটা বাজতেই ধুম করে বোমার শব্দ— সম্ভবত খুনের সিগনাল দিতে, বা মৃত্যুমুখী মানুষটির চিৎকার লুকোতে। পর দিন স্যর আমাদের বাড়ি এলে যখন পলিব্যাগের কথা তুলতাম, উনি বলতেন: ‘ও, তাই কাল রাতে যখন যাচ্ছিলুম, দুটো ছেলেকে দেখি ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে অন্ধকারে গুজগুজ করছে!’ জিজ্ঞেস করতাম, আপনি অত রাতে একা যান, সিআরপি’রা ধরে না? উনি হাহা হাসতেন: ‘ধুস! ওরা জানে, রাত বারোটায় কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে যে লোকটা একা হেঁটে যায় সে প্রফেসর ভড়, ওকে ধরে কোনও লাভ নেই!’

আশেপাশে আর কোনও বাঙালি পরিবার ছিল না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরের আগুন-লাগা ঘরবাড়িগুলো দেখতে দেখতে অজানা ভয়ে কেঁপে উঠতাম। তার পর এল সেই চল্লিশ দিনের স্ট্রাইক। খাবারদাবারের প্রচণ্ড অসুবিধে। আমার স্বামীকে গাড়ি নিয়ে অফিসের কাজে শিলিগুড়ি যেতে হত। অনেক মানুষ ওঁর হাতে জিনিসপত্রের লম্বা লিস্টি ধরিয়ে দিতেন, শিলিগুড়ি থেকে যদি এনে দেন। উনি বহু বার বিপদে পড়েছেন, শুধু স্থানীয় ভাষা জানতেন বলে রক্ষা পেয়েছিলেন। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয় সেই সময়। ঘাড়ে গুলি লেগে আহত হন পুলিশ সুপার হান্ডা, রেড-এর নামে সিআরপি’রা অকথ্য অত্যাচার চালায় স্থানীয় মানুষের ওপর। রাতবিরেতে ঘরে ঢুকে, সব জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলে, লুঠপাট করত। কত অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে যে নিজেদের ঘর ছেড়ে অন্যের ঘরে লুকিয়ে রাত কাটিয়েছে! অনেক নিগৃহীত পরিবার আমাদের কাছে আশ্রয়, সাহায্য চাইতে আসত। দার্জিলিঙ-কালিম্পঙের বস্তি, চা-বাগানের বহু দরিদ্র পরিবারকে সেই স্মৃতি এখনও হয়তো তাড়া করে বেড়ায়।

সত্তর দশকের ভাষা আন্দোলন দেখেছি, এই শতকের জনমুক্তি মোর্চার আন্দোলনও, কিন্তু আশির দশকে গোর্খা আন্দোলনের ভয়াবহতা, আমার মতে, সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে। আন্দোলনের ওই দুটো বছর, সরকারি কর্মচারীদের খাওয়া, ঘুম, বিশ্রাম— কিচ্ছু ছিল না। ছিল প্রচণ্ড মানসিক চাপ। আন্দোলন শেষ হল এক দিন, কিন্তু সেই সময় তৈরি হওয়া মধুমেহ রোগটি আজও আমার স্বামীর সঙ্গী।

সাধনা দাস, দার্জিলিং

sadzdas@gmail.com

আশির দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে? লিখুন এই ঠিকানায়:
হ্যালো 80’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১।
বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy