Advertisement
E-Paper

ক্যামেরার জন্যে মরে যেতেও রাজি

আঠারো বছর বয়সে পৌঁছনোর আগেই বখে গিয়েছিলাম। সিগারেট খাওয়া, মদ খাওয়া, পদ্য লেখা, বয়স ভাঁড়িয়ে ফিল্ম সোসাইটির শো-গুলোতে ঢুকে পড়া, সবই রপ্ত হয়ে গিয়েছিল। বিএ পড়ছি।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৬ ০০:৪৯

আঠারো বছর বয়সে পৌঁছনোর আগেই বখে গিয়েছিলাম। সিগারেট খাওয়া, মদ খাওয়া, পদ্য লেখা, বয়স ভাঁড়িয়ে ফিল্ম সোসাইটির শো-গুলোতে ঢুকে পড়া, সবই রপ্ত হয়ে গিয়েছিল। বিএ পড়ছি। গভীর রাতে বাড়ি ঢুকে মা’র মুখে শুনলাম, বাবা বলেছেন, রেজাল্ট খারাপ হলে গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন। ছোটবেলায় সুযোগ পেলেই দিদির হারমোনিয়াম টেনে বের করে সারেগামাপাধানিসা বাজাতাম। এক বার তো কম্পাউন্ডার-কাকু আর ড্রেসার-কাকুকে হারমোনিয়াম বাজিয়ে ‘মন চল নিজ নিকেতনে’ শুনিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলাম। মা’কে বললাম, আর রেজাল্ট ভাল হলে? মা বললেন, ক্যামেরা। মা জানতেন, একটা স্টিল ক্যামেরার জন্যে আমি মরে যেতেও রাজি।

রেজাল্ট বেরল, আর পরের দিনই বাবা নিজে গিয়ে মেট্রো গলি থেকে দুশো টাকা দিয়ে একটা রাশিয়ান ক্যামেরা কিনে আনলেন। ৭২ এক্সপোজার, মানে ছত্রিশের বদলে বাহাত্তরটা ছবি তোলা যাবে। ধর্মতলার একটা ফটো-স্টুডিয়োয় তিন টাকায় কাটা ফিল্মের রোল পাওয়া যেত। নেশা ধরে গেল ছবি তোলার। খালাসিটোলার চেয়েও বেশি ভালবেসে ফেললাম ক্যামেরাটাকে। বাড়ির এমন মানুষ ছিল না, এমন ঘটনা ছিল না, যা আমার ক্যামেরায় ধরা পড়ত না। ঘটনা বলে ঘটনা! চিনির দানা নিয়ে পিঁপড়ে চলেছে ঘরের দেওয়াল বেয়ে, সজনেডাঁটার ওপর থেকে বেরিয়ে আসছে শুঁয়োপোকা, রোদে শুকোতে দেওয়া ডালের বড়ি থেকে একটা বড়ি নিয়ে উড়ে যাচ্ছে কাক, ছোটভাই হিসি করছে, দিদি আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাস হয়ে গেছে... ক্যামেরা ছাড়ছে না কোনও কিছুই। সকালবেলা ভাত খেয়ে মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়তাম কাঁধের ঝোলায় ক্যামেরা নিয়ে। দাঁড়িয়ে থাকতাম রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ওই এক বুড়ো আসছে, কত রেখা মুখের ওপর। প্রত্যেকটা রেখায় কত গল্প! এমনকী রেখাগুলোর মধ্যিখানের কুঁচকোনো চামড়াতেও আটকে থাকা কত সময়, ধরে রাখতাম ক্যামেরায়। চার কেজির মাছ হাঁকিয়ে হেঁটে আসছেন ঘোষবাবু। ক্যামেরা নিয়ে তার সামনে দাঁড়ালাম। মাছের ছবি... ঘোষবাবুর ছবি। গর্বে আটখানা ঘোষবাবুর মুখ। হাসছেন ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে, মনে হল হাসছে ঘোষবাবুর মাছটাও।

পাড়া থেকে একটু এগিয়ে গিয়ে ছিল এক বেশ্যালয়। দুপুরবেলা খোলা পিঠ রোদে দিয়ে চুল শুকোত তারা, হুবহু আমাদের মা-মাসিদের মতোই। তাদের খোলা পিঠের ছবি তুলতাম, খোলা চুলের। কখনও হালকা রোদের খোলা মাঠেই ঘুমিয়ে পড়ত তারা, পায়ে আলতা। ছবি তুলতাম আলতা পরা পায়ের। কোনও দিন আমাকে কিছু বলেনি, শুধু মাঝে মাঝে অদ্ভুত প্রশ্রয়ের হাসি হেসেছে।

হাজরা রোডে মামাবাড়ির কাছে, ভবানীপুরের একটা গলির মধ্যে ছিল রবি দরজির দোকান। পুজোর সময় মামাবাড়ি থেকে দেওয়া শার্টপ্যান্ট এই রবিই সেলাই করে দিত। এক দিন ক্যামেরা নিয়ে ওই গলি দিয়ে যাচ্ছি, দেখি, একমনে সেলাই করে চলেছে রবি। তার ষোলো বছরের মেয়ে চা এনে রাখল সেলাই টেবিলের ওপর। আমি দাঁড়িয়ে ওর ছবি তুলতে শুরু করলাম। মেয়েটিও নরম ভাবে হাসল, মাঝে মাঝে লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে নিচ্ছিল। রবি মাথা নিচু করে সেলাই করে যাচ্ছিল, হঠাৎ তার চোখে পড়ল মেয়ের দিকে, তার পর আমার দিকে। চিৎকার করে উঠল, এত বড় সাহস আমার মাইয়ার ফুট তুলোস! লাফ দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে আমাকে তাড়া করল রবি দরজি, হাতে বিশাল বড় কাপড়-কাটা কাঁচি। আমি ছুট লাগালাম, এ-গলি সে-গলি পেরিয়ে কোনও রকমে ১০৯/২১-এ’তে এসে প্রাণে বাঁচলাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে রবি চিৎকার করে চলেছে, এই কাঁচি দিয়া কাইট্যা ফালামু তর নাক। আশুতোষ কলেজের বডিবিল্ডিং চ্যাম্পিয়ন আমার ছোটমামু বারান্দায় বেরিয়ে এসে খালি গায়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালেন। এক বার বাইসেপ নাড়ালেন, এক বার ট্রাইসেপ। রবি ও তার কাঁচি মিলিয়ে গেল হাওয়ায়।

মেঘ ফাটিয়ে অঝোর বৃষ্টি ঝড়ের সঙ্গে মিশে উড়িয়ে দিচ্ছে সবুজ পলিথিন, হালদারবাবুর ছাতা। এগিয়ে আসছে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে লীলার মুখ। জল ঝরছে মুখ বেয়ে। অদ্ভুত হাসছে লীলা। ক্যামেরা ধরে রাখত কত কী! বছর দুয়েক বাদে লীলার বিয়েতে বাঁধিয়ে দিয়েছিলাম সেই ছবি।

বালিশের পাশে ক্যামেরা রেখে ঘুমিয়ে পড়তাম। তোলা ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সময় কেটে যেত। বন্ধুরা সঙ্গ ত্যাগ করল, বান্ধবীরা আমাকে দেখলেই ছুটে পালিয়ে যেত, যদি আবার তাদের ছবি তুলতে চাই! এক জন জানতে চেয়েছিল, ছবি তোলা ছাড়া তোমার আর কিছু বলার নেই আমাকে? আমার সত্যিই কিছু বলার থাকত না। এক দিন সক্কালবেলা বাড়িতে বেল। দরজা খুলে দেখি নরেশ। বলল, পরশু ঠাকুমার শ্রাদ্ধ। একটাও ছবি নেই। তুই যে তুলেছিলি ঠাকুমার ছবি, তার নেগেটিভটা আছে? কালকের মধ্যে এনলার্জ করে বাঁধাতে হবে। নরেশের ঠাকুমার শ্রাদ্ধে দুপুরবেলা গিয়ে দেখি, অজস্র মালার ভেতর থেকে মুখ বের করে ফোকলা দাঁতে হাসছেন নরেশের ঠাকুমা। নরেশের মা বলল, আমার শাশুড়ির মুখে জন্মে এ রকম হাসি দেখিনি! কী ভাবে তুললি এই ছবি? আমারও একটা এ রকম ছবি তুলে দিস। নরেশের জ্যাঠা বলল, আমারও। ভাল করে বাঁধিয়ে দিও। পয়সাকড়ি যা লাগে আমি দিয়ে দেব। এই ভাবে প্রায় খান কুড়ি ছবির অর্ডার পেয়ে গেলাম। সবারই বয়স ঝুঁকে পড়েছে আরও বয়সের দিকে। সবারই মুখে ভয় যেন উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। নরেশের ন’কাকিমা বলে উঠলেন, ‘শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর/ অন্যে কথা কবে/ ছবি রবে নিরুত্তর।’

দু’দিন পর বাড়িতে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। ভাঁড়ার ঘরে ড্রাম খুলে চাল বের করতে গিয়ে মা দেখেন, ভেতরে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে আছে এক সাপ। রান্নার কাননপিসি বলল, কেউটে। বাবা বললেন, চন্দ্রবোড়া। কম্পাউন্ডার-কাকু খবর পেয়ে ছুটে এলেন, বললেন, কালনাগিনী। এক্ষুনি পুলিশে খবর দিতে হবে। আমি ক্যামেরা নিয়ে চালের ড্রামের সামনে দাঁড়ালাম একটু ঝুঁকে। মাথা তুলে তাকাল সেই সাপ। ক্লিক শব্দ হল, আমি সরে দাঁড়ালাম, আর সাপটা আস্তে আস্তে ড্রাম থেকে বেরিয়ে, দেওয়াল বেয়ে উঠে খোলা জানলা দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেল।

এক দিন মহিষাদল থেকে সুব্রতর চিঠি এল, কবি সুব্রত চক্রবর্তী। যাদবপুর থেকে ফিজিক্সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে মহিষাদল কলেজে চাকরি পেয়েছে। ঝোলায় ক্যামেরা ভরে উঠে পড়লাম ঝুলন্ত বাসে। হাওড়া স্টেশন যাব। আমি ঝুলছি, আমার ব্যাগ ঝুলছে, ঝুলছে নীচের পা-দানিতে আরও কয়েক জন। টিকিট কাটতে গিয়ে দেখি হঠাৎ কী রকম হালকা লাগল, আর ছ্যাঁৎ করে উঠল বুক। যা ভেবেছি। জামাকাপড়গুলো আছে, শুধু সব থেকে তলায় রাখা ক্যামেরাটা নেই! গোটা হাওড়া স্টেশন ছুটে বেড়ালাম, বাসস্ট্যান্ডে খুঁজে বেড়ালাম, মহিষাদল যাওয়ার ট্রেন চলে গেল। সুব্রত স্টেশন থেকে আমাকে না পেয়ে ফিরে যাবে। মনে হচ্ছে জ্বালিয়ে দিই হাওড়া স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, ট্রেন। কত বছর একসঙ্গে ছিলাম আমরা। একসঙ্গে ঘুমোতাম, একসঙ্গে বেরিয়ে পড়তাম। ক্যামেরাটা কত কী চিনিয়েছিল আমাকে— আলো, অন্ধকার, ছায়া, মানুষ, বিষাদ আর আনন্দ। ছবি তুলেছি কত কিছুর, শুধু নিজের ছবি তুলিনি কোনও দিন, ইচ্ছেই হয়নি! সন্ধের ট্রেনে মহিষাদল যেতে যেতে ভাবছি, কার কাছে আছে ক্যামেরাটা? কেমন আছে?

ঘুম থেকে উঠে সকালবেলা সুব্রত বলল, তোমার একটা ছবি তুলব, তার পর তুমি আমার একটা ছবি তুলে দেবে। এই বার কলকাতা গিয়ে একটা ক্যামেরা কিনেছি।

camera
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy