Advertisement
E-Paper

মিনিবাসের কন্ডাক্টর ছিলাম

এখন হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট। তারও মূলে আছে মিনিবাসে এক প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে আলাপ। ভাগ্যিস তাঁদের সঙ্গে গল্পগাছার বদভ্যাসটা ছিল!এখন হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট। তারও মূলে আছে মিনিবাসে এক প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে আলাপ। ভাগ্যিস তাঁদের সঙ্গে গল্পগাছার বদভ্যাসটা ছিল!

রেবতীরমণ বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৬ ০০:০০
ছবি: সুমন চৌধুরী।

ছবি: সুমন চৌধুরী।

পৌষের মাঝামাঝি, ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। কাল রাত থেকে শুরু হয়েছে ফিসফিসিয়ে বৃষ্টি। থামার নাম নেই। স্ট্যান্ডে গাড়ি নিয়ে পৌঁছতেই স্টার্টার জানিয়ে দিল, আমাদের আজ থার্ড ট্রিপ। শোনামাত্র মেজাজটা উচ্ছে-তেতো হয়ে গেল। প্রায় সারা রাত জাগার পর তাড়াতাড়ি স্ট্যান্ডে এলাম ফার্স্ট ট্রিপ করব বলে, যাতে সাত ট্রিপ করে কালকের লোকসানটা পোষানো যায়। নাঃ, সাত ট্রিপ আর হবে না, ছ’ট্রিপেই থামতে হবে।

কালকের রাতটা যা গেল! আমাদের মিনিবাসটা চলে ডানলপ ব্রিজ-বিবাদী বাগ রুটে। ছুটির দিন আর সন্ধে সাতটার পর বিবাদী বাগের বদলে এসপ্লানেডে কে সি দাসের উলটো দিকে গাড়ি পার্ক করি। আমি এই গাড়ির কন্ডাক্টর। ড্রাইভিংটা জানা আছে বলে মাঝেমধ্যে এক-আধ ট্রিপ গাড়িও চালাই। যদিও আমার হেভি ভেহিক্‌ল লাইসেন্স নেই। গাড়ির মালিক অজিতবাবু কপট ধমক দেন, ‘পুলিশ ধরলে কিন্তু আমি ছাড়াতে যাব না।’ আমি হেসে বলি, ‘ঠিক আছে, ফাইনের টাকা আমিই দিয়ে দেব।’

কাল শেষ ট্রিপের মাথায় কে সি দাসের সামনে গাড়ি লাগিয়ে অপেক্ষা করছি, চার-পাঁচ জন প্যাসেঞ্জারও বসেছে। গাড়ি ছাড়তে গিয়ে দেখা গেল ‘ফুয়েল পাম্প’-এ হাওয়া ঢুকে গেছে। হিন্দুস্তান মেক-এর গাড়ির এই এক দোষ। পাম্পে হাওয়া ঢুকলে গাড়ি স্টার্ট নেবে না, যত ক্ষণ না হাওয়ার সবটুকু বের করে দেওয়া হচ্ছে।

পাম্পের স্ক্রু ঢিলে করে হাওয়া বের করার চেষ্টা করতে থাকল ড্রাইভার সুবলদা, পরে আমি এবং শেষে হেল্পার গোপাল। গাড়ি আর স্টার্ট হয় না। এ দিকে রাত প্রায় বারোটা, সকলে ক্লান্ত।

ঠিক হল, রাতটা গাড়িতেই কাটুক। সকালে মিস্ত্রি এনে কিছু একটা করা যাবে। মশার কামড় খেয়ে এক রাশ অস্বস্তি নিয়ে আধাঘুমে যখন, জানলার বাইরে থেকে আওয়াজ এল, ‘বেটা, দোঠো রুপিয়া দে, চায় কে লিয়ে।’

তাকিয়ে দেখি, লম্বা আলখাল্লা টাইপের রঙিন পোশাক পরা, চুলদাড়িওলা এক ফকির। তার বিগলিত হাসিটা দেখে পিত্তি চটকে গেল। মাছি তাড়াবার মতো হাত নেড়ে বললাম, ‘যাও তো বাপু, ভোরবেলা জ্বালিও না। গাড়ি স্টার্ট হচ্ছে না, এমনিই মাথার ঠিক নেই।’ ফকির না ভেকধারী, জানি না। হেসে বলে, ‘কোই চিন্তা নহি বেটা, যা স্টিয়ারিং পে বৈঠ, গাড়ি স্টার্ট হো যায়েগা। পর বেটা দোঠো রুপিয়া দে। চায় পিনা হ্যায়।’ সংস্কার না খড়কুটোর আশায় জানি না, ব্যাগ খুলে দুটো টাকা জানলা দিয়ে বাড়িয়ে দিই। সে বলে, ‘যা বেটা, স্টার্ট কর—’

কী রকম যেন ভ্যাবলা মেরে গিয়ে স্টিয়ারিংয়ে বসি। এ কী, এক বারেই গাড়ি স্টার্ট! পাছে বন্ধ হয়ে যায় এই ভয়ে অ্যাক্সিলারেটর থেকে পা না তুলেই পাশের দরজা খুলে ফকিরকে ডাকতে গিয়ে দেখি, কোথায় কে! হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে!

ইঞ্জিনের শব্দে সুবলদা ও গোপাল উঠে পড়েছে। দুজনের সমবেত জিজ্ঞাসা— ‘কী করে হল?’ আমি নিজেই কি ছাই কিছু জানি?

কালকের কথা ভাবতে ভাবতে একটু ঝিমুনি এসেছিল, সুবলদা গাড়ি স্টার্ট করতেই চটক ভাঙে, ট্রিপে যাওয়ার সময় এসে গেছে।

নিত্যযাত্রীদের মধ্যে কোথা থেকে কে ওঠে জানাই ছিল। অনেক বিখ্যাত মানুষ যাতায়াত করেন। বনহুগলি থেকে অভিনেতা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, আইএসআই থেকে বিজ্ঞানী শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, আইনজীবী সুকুমার চৌধুরী। ডানলপ ব্রিজ থেকে পুলিশের বড়কর্তা সমীর গঙ্গোপাধ্যায়, আর বি ট্রেডিং স্টপ থেকে ক্লাসিকাল নৃত্যশিল্পী মিস সেন। অনেকের সঙ্গেই এক রকম সৌহার্দ্য গড়ে উঠেছে। এই তো রুদ্রদার বদান্যতায় ক’দিন আগে অ্যাকাডেমিতে ‘ফুটবল’ নাটকটা দেখে এলাম।

শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় অবশ্য মিনিবাসে হয়নি। হয়েছিল দার্জিলিং থেকে ফেরার পথে রেলগাড়িতে। শঙ্করদা ভুটান বেড়িয়ে ফিরছিলেন। সঙ্গে শিবানী বউদি এবং ওঁর মা ছিলেন। শঙ্করদার সঙ্গে দারুণ জমে গিয়েছিল। তিনি অনেক গান শুনিয়েছিলেন।

আইএসআই স্টপ থেকে প্রথম যেদিন আমাদের মিনিবাসে উঠলেন, দেখেই চিনতে পেরেছিলাম, কিন্তু পরিচয় দিইনি। দেখতে চাইছিলাম, উনি রেলগাড়ির পরিচয় মনে রেখেছেন, না কি ভুলে গেছেন। টিকিট কাটতে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই এক পলক দেখে সে কী অনাবিল মিষ্টি হাসি!

আর বি ট্রেডিং স্টপ থেকে বিকেলের দিকে প্রায়ই কুড়ি-বাইশ বছরের এক সুতনুকা উঠতেন আমাদের মিনিবাসে। চোরা চাউনি দিয়ে তাকে দেখতাম, কিন্তু যেচে আলাপ করার সাহস হয়নি।

গত পরশু রবিবার একটু বেলা করে ট্রিপে বেরিয়েছি, স্টপ থেকে উঠলেন সেই নাম-না-জানা কন্যে— যিনি উঠলেই এক অচেনা সুগন্ধির ঘ্রাণ পেতাম। ও মা, সঙ্গে দেখি পরিচিত অন্য রুটের এক মিনিবাসের মালিক সেনকাকু। কুশল বিনিময়ের পর জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোথায় চললেন কাকু?’ আসলে ইচ্ছে, কন্যাটির সঙ্গে আলাপ করি। পরনে ইটরঙা শাড়ি, তার উপর একটা কালো বুকখোলা সোয়েটার, কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ। ভারী সুন্দর গড়ন!

সেনকাকু বললেন, ‘একটু ম্যাক্সমুলার ভবনে যাব গো। এই মেয়েটির নাচের প্রোগ্রামের জন্য ওদের অডিটোরিয়ামটা ভাড়া নেওয়ার ইচ্ছে। ...তারিখে ওর প্রথম প্রোগ্রাম লঞ্চ করব। জানি না পাব কি না।’

মনের মধ্যে ঘন্টি বেজে উঠল। সব দ্বিধা ঝেড়ে সেনকাকুকে বললাম, ‘আমি কি আপনার সঙ্গে যাব? ওখানে এক জনকে আমি চিনি, হয়তো সাহায্য করতে পারেন।’

ভুল দেখলাম না তো! কন্যে ডাগর কালো চোখ তুলে তাকালেন। সে দৃষ্টি যেন বলল, ‘প্লিজ চলুন না!’ সেনকাকুর চোখে বিস্ময়! বলে উঠলেন, ‘ওখানে তোমার চেনা-জানা! তা হলে তো ভালই হয়। তবে তোমার ডিউটি...’ বলে উঠি, ‘চিন্তা করবেন না, এক ট্রিপ গোপাল সামলে দেবে।’

ম্যাক্সমুলার ভবনে আমার চেনা-জানা— অবাক হওয়ারই কথা। কে সি দাস স্ট্যান্ডে নামার পর সেনকাকু একটা ট্যাক্সি নিলেন। আমি ড্রাইভারদার পাশে বসলাম, ওঁরা দুজনে পিছনে। ম্যাক্সমুলার ভবনে পৌঁছে, ভিজিটর্স স্লিপ নিয়ে এক ভদ্রলোকের নাম, আর ভিজিটর হিসেবে আমার নাম লিখে পাঠালাম। দুরুদুরু বুকে মিনিট দু-তিন অপেক্ষার পর দেখি, সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলেন সেই ভদ্রলোক। এসেই আমায় বুকে জড়িয়ে ধরে সে কী উল্লাস! ‘হোয়াট আ প্লেজ্যান্ট সারপ্রাইজ’, খুশি-মাখা গলায় বলে ওঠেন তিনি। আমার মতো আমার সঙ্গীরাও দেখি খানিকটা ভ্যাবলা মেরে গেছেন। আমাদের তিন জনকে সাদরে নিয়ে গেলেন ওঁর নিজস্ব অফিসে।

সহকর্মীকে ডেকে সমস্ত ব্যবস্থা করে দিলেন, এমনকী অডিটোরিয়াম ভাড়াতেও কিছুটা ছাড় পেয়ে গেলাম। কফি খেয়ে আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যখন ছাড়া পেলাম, কন্যার চোখে দেখি অচেনা এক মুগ্ধতা। সেনকাকু বিস্ময়-ভরা দৃষ্টি মেলে আমায় দেখছেন। গেটের বাইরে এসে কাকুর প্রশ্ন, ‘কী করে হল বলো তো! উনি কে?’ কী জবাব দেব! গোনাগুনতি তিন দিনের পরিচয়ে যিনি এমনতর বন্ধু হয়ে উঠেছেন, তাঁর পরিচয় দু’কথায় কী করে বোঝাই।

‘উনি মিঃ হাইকে বেল্‌স, ম্যাক্সমুলার ভবনের ডেপুটি ডিরেক্টর।’ তার পর বললাম প্রথম আলাপের গল্প—

সে দিন গাড়ি প্রায় ফাঁকাই। এক সাহেব-যাত্রীর টিকিট চাইতে গিয়ে দেখি, নিবিষ্ট মনে ম্যাপ দেখছেন। ‘টিকেট প্লিজ’ বলতে, একটি পাঁচ টাকার নোট দিয়ে বললেন, ‘ডানলপ ব্রিজ প্লিজ।’ টিকিট এবং খুচরো ফেরত দিয়ে চলে আসছি, পিছন থেকে শুনি— ‘এক্সকিউজ মি, কুড য়্যু টেল মি দ্য ওয়ে টু দক্ষিণেশ্বর অ্যান্ড ‌বেলুড় মথ?’ আমার ভাঙা-ভাঙা ইংরাজি দিয়ে ওঁকে যথাসাধ্য বোঝালাম। ফাঁকা গাড়িতে হেল্পারকে ব্যাগ দিয়ে পাশে বসে গল্প করতে শুরু করলাম। গন্তব্যে পৌঁছনোর আগেই দেখা গেল, আমাদের বেশ জমে উঠেছে। স্ট্যান্ডে পৌঁছে ওঁর সঙ্গ নেওয়ার লোভ সামলানো গেল না। বললাম, ‘আমি কি তোমায় সঙ্গ দিতে পারি?’ খুশি হয়ে বলে উঠলেন, ‘সো নাইস অফ য়্যু।’ পরের গল্প সংক্ষিপ্ত। দু’দিন ছুটি নিয়ে ওঁর সঙ্গে সারা কলকাতা আর আশপাশের এলাকা চষে বেড়িয়েছি।

আর এক দিন। টবিন রোড থেকে উঠলেন সুকুমার চৌধুরী। আলিপুর জজ কোর্টের আইনজীবী। টিকিট কাটার সময় বললেন, ‘কাল সকালে ছুটি, বাড়িতে দেখা করবে, জরুরি কাজ আছে।’ অবাক হলাম।

সকাল সকাল তৈরি হয়ে তাঁর বাড়িতে পৌঁছলাম। চেম্বার দেখে চক্ষু চড়কগাছ! বিশাল ঘরের চতুর্দিকে নীচ থেকে উপর পর্যন্ত বইয়ে ঠাসা। ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা দীর্ঘদেহী মানুষটি বসে আছেন বিশাল টেবিলের পিছনে। আমায় দেখে স্মিত হেসে বললেন, ‘বোসো, চা খাবে তো?’ ইন্টারকমে কাকে যেন দু-কাপ চা দিতে বললেন।

আমি উসখুস করছি, হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘পরশু তোমার মিনিবাসের মালিক এসেছিলেন। গাড়ি নিয়ে মামলার বিষয়ে কাগজপত্র দেখলাম, আর জানলাম তোমার ব্যাপারে সব কিছু। ব্যাংক-কে যত চিঠিপত্র লেখা হয়েছে, সব তোমার লেখা, তাই তো? তুমি যোগেশচন্দ্র চৌধুরী ল’ কলেজ থেকে পাশ করেছ। কো-অপারেটিভ ব্যাংকে চাকরি করতে। চাকরি ছেড়েছিলে প্র্যাকটিস করবে বলে। তা হলে প্র্যাকটিস করছ না কেন? কোনও কাজ ছোট নয়— এটা যেমন ঠিক, তেমনই নিজের জ্ঞান বা প্রতিভার প্রতি সুবিচার না করাটা অন্যায়। তোমার সঠিক জায়গা আদালত, মিনিবাস নয়। কাল থেকে আমার সঙ্গে কোর্টে বেরোবে।’

আমি নির্বাক বিস্ময়ে ওঁর দিকে চেয়ে থাকি। উনি একটা খাম আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘ধরো, আজই ধর্মতলায় গজকুমারে গিয়ে কোর্ট-গাউন কিনে আনবে। এটা অ্যাডভান্স, পরে কেটে নেব।’

চাকরি ছেড়েছিলাম প্র্যাকটিস করব বলে, কিন্তু বাবার মারাত্মক অসুস্থতা আমায় বাধ্য করে সংসারের হাল ধরতে। অন্য চাকরি পাওয়া সহজ ছিল না। সামান্য পরিচয়ের সূত্র ধরে মিনিবাস মালিকের দেওয়া কাজটা আমি নিই।

না, স্যরকে আমি কিছুই বলিনি। নিঃশব্দে একটা প্রণাম করি। সেই প্রণাম গত তিরিশ বছর ধরেই প্রতি দিন জানাচ্ছি, কলকাতা হাইকোর্টে অ্যাডভোকেটের চেয়ারটায় বসার সময়।

rebatiraman.biswas@gmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy