রিহার্সাল। শুনলেই মনটা হাঁকুপাঁকু করে ওঠে— উঠত। যখন আমি একদম ছোট, ক্লাস থ্রি-ফোরে পড়ি, মনে আছে, বাবার (জোছন দস্তিদার) কোলে বসে অবাক হয়ে দেখতাম— মা (চন্দ্রা দস্তিদার), কাকু (সুজিত ঘোষ), সব আপন লোকেরা কেমন ‘অন্য’ লোক হয়ে কথা বলছে। হাসছে। কাঁদছে। বাবা এক বার কোল থেকে নামিয়ে উঠে যাচ্ছে, ওদের দেখাচ্ছে, আবার আমায় কোলে নিয়ে বসে দেখছে।
কিছু বলতে গেলেই বলত, ‘শ্-শ্-শ্ মুকু, কথা না— দ্যাখো।’ দেখতে দেখতে কী রকম যেন লাগত। পরে বুঝেছি ওটা নেশা। মহড়া দেখার নেশা। মহড়া ঘরের নেশা।
বয়স যখন দশ— প্রথম অভিনয়। একটা বাচ্চা মেয়ে দুলে দুলে গানের সুরে পড়ছে আর ঘুমন্ত মাস্টারমশাইকে ভ্যাঙাচ্ছে। কী আনন্দ! আমিও এ বার ‘অন্য’ লোক হয়ে উঠব। এই আনন্দ বেশি দিন থাকেনি। মায়ের কড়া হুকুম: বারো ক্লাস পাশ না করে আর অভিনয় নয়।
এই শুরু হল আমার চোরা টান। ভেতরের ঘরে পড়াশোনা করছি, আর বাইরের বড় ঘরে দুদ্দাড় করে চলছে রিহার্সাল। কে কী ডায়ালগ বলছে, শুনতে শুনতেই মুখস্থ। সামনে খোলা বিচ্ছিরি পড়ার বই। কান তো মহড়া ঘরে। আর মাঝখানে বন্ধ দরজা। মনটা ছটফট করে উঠত, কবে যাব বন্ধ ঘরের ও-দিকটায়।
অবশেষে সেই দরজা এক দিন খুলল। বসলাম মহড়া ঘরে— ‘চার্বাক’-এর মেম্বার হয়ে। যে চরিত্রে অভিনয় করতে হবে, সে দেহাতি। ভালবাসে এক জনকে। অর্থাৎ, প্রেমের অভিনয়। ডায়ালগ তো মুখস্থই ছিল— উঠে পড়লাম। ‘যা, তুর সাথে হামি অউর বাত করব না’— অভিমান মিশিয়ে বলতে হবে সেই ছেলেটিকে। বলেও দিলাম।
‘দাঁড়াও’— বাবার গলায় থমকে গেলাম।
কী হল? ভুল তো বলিনি? তা হলে?
‘এই ভাবে ডায়ালগ বললে, যে এসেছে, সে বলবে— বাঁচা গেল। তোমাকে আর কথা বলতে হবে না— বলে পালাবে।’
সবাই হেসে উঠল। আমি লজ্জায় পাথর।
‘এটা প্রেম হচ্ছে?’
—‘হচ্ছে না?’
—‘না। এই ভাবে বলবে।’ শুরু হল দেখানো। এটা এ ভাবে বলতে হবে। ওই সময় মুখটা নামানো থাকবে। গলার স্বর চড়বে না।
হঠাৎ থেমে গিয়ে বাবা বলল, ‘ভাবা যায়! বাপ হয়ে মেয়েকে দেখাচ্ছি কী করে প্রেম করতে হয়!’ আবার হাসির হুল্লোড়। আমিও যোগ দিলাম। বুঝলাম মহড়ার মানে।
ঠিক সাতটায় শুরু হবে রিহার্সাল। সাতটা মানে সাতটা-ই। সাতটা বেজে দু’মিনিটও নয়, সাতটা বাজতে দু’মিনিটও নয়। খাতা খুলে নাম ডেকে হাজিরা নেওয়া হত।
কিন্তু, এক জন ছিলেন, যিনি এই নিয়মের ঘড়ি মানতেন না— সন্তোষবাবু। দশ-পনেরো মিনিট দেরি হতই। আসতেন গড়িয়া থেকে। বাসে-ট্রামে জ্যাম। হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকতেন রোজই। বয়সে প্রায় বাবার কাছাকাছি বলে বাবাও মেনে নিত।
হঠাৎ এক দিন আমাদের সেক্রেটারি সুবীরদাকে বাবা বলল, ‘কাল সাড়ে ছ’টায় বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকবি তো। আড়ালে থাকবি। দেখবি তো, সন্তোষ রোজ লেট করে কেন?’
পর দিন সেই একই ঘটনা— সন্তোষবাবু পনেরো মিনিট লেট। ঘাম মুছে বসতেই পিছনে হাজির সুবীরদা।
—‘জোছনদা, উনি সাড়ে ছ’টায় নেমে, পান-চা খেয়ে আরামে আসেন, আর দরজার একটু দূর থেকেই ছুটে ঢোকেন ভেতরে, ঘাম মুছতে মুছতে।’
দমফাটা হাসিতে গড়িয়ে পড়ল সবাই। বাবা গম্ভীর। ‘অভিনয়টা তো ভালই করেন, তা এই হাঁপানোটা স্টেজে হয় না কেন?’ বাবার কথার উত্তরে কাঁচুমাচু সন্তোষবাবু কী বলেছিলেন তা হাসির চোটে শুনতে পাইনি।
‘১৩ পার্বণ’ সিরিয়াল তখন হয়ে গেছে। লোকজন চিনতে শুরু করেছে। শুটিং সেরে রিহার্সালে যেতাম, আমি আর বেণু (সব্যসাচী চক্রবর্তী)। পর পর দু’দিন দেরি হয়েছে একটু। সাতটা বেজে গেলে পিছনের দরজা দিয়ে চুপি চুপি এসে দাঁড়িয়ে পড়তাম।
সে দিনও দাঁড়িয়ে হাঁপ ছেড়েছি, বজ্রহুংকার আছড়ে পড়ল— ‘বন্ধ করো রিহার্সাল। সবাই উঠে দাঁড়াও। দ্যাখো দ্যাখো, বিখ্যাত হিরো-হিরোইন এসেছেন। উলু দাও, হাত জোড় করে বসতে বলো।’
বাবাকে বেণু নাম ধরে ডাকে ছোট থেকেই। যত বার বলতে যায়, ‘জোছন, আমরা মেক-আপও তুলিনি, সোজা আসছি’, কে শোনে কার কথা। হাত জোড় করে নিচু হয়ে বলেই চলেছে, ‘সাড়ে সাতটা বেজে গেছে তো কী হয়েছে? আপনারা এসেছেন এটাই সবার ভাগ্য।’
বেণু আরও নরম করে বলে, ‘আমরা তো তোমার শুটিংয়েই ছিলাম। শেষ দুটো শট দিয়েই চলে এসেছি।’
‘আমি যদি ওই একই শুটিং থেকে ফিরে এসে ঠিক সাতটায় পৌঁছে যেতে পারি, তা হলে তোমরা পারবে না কেন?’ সেই বজ্রহুংকার।
কী মুশকিল! শুটিংটা তো ওঁরই শিডিউল করা। ওঁরই বলে আসা শট নিচ্ছিল অ্যাসিস্ট্যান্ট। আমরা কী করলাম? কিন্তু কে বলবে? আর কে-ই বা শুনবে?
এক দিন সবাই মন দিয়ে রিহার্সাল দিচ্ছে, হঠাৎ পাশের ঘর থেকে একটা শব্দ। কাচ ও কাঠের একটা হাফ পার্টিশন। জায়গা কম হলে ও-ঘরেও বসা হত। কী ব্যাপার? তাকিয়ে দেখি, আমাদের গ্রুপের ভবদা ঘুমিয়ে পড়েছে। নাক ডাকছে।
সবাইকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে বাবা একটা বালিশ নিয়ে এল ভিতর থেকে। আলতো করে ভবদার মাথার নীচে বালিশটা রাখতেই ভবদা ধড়মড় করে উঠে বসে, ‘এ বাবা, না না জোছনদা, ছি ছি! বালিশ, মানে...’ —‘আপনার বালিশ ছাড়া ঘুমোতে অসুবিধে হচ্ছিল, তাই এনে দিলাম।’ আবার হাসির ছর্রা।
আর এক দিন, বেণুকে মিউজিক চালানো নিয়ে বাবা কিছু বলেছে। বেণু উত্তর দিতেও পারছে না, চুপ করেও থাকতে পারছে না। সে দিন বাবা একটু রেগেই ছিল। দেখি কী, বেণুর হাতে একটা মোটা পেতলের চাবি। সেটা এক বার বেঁকাচ্ছে আর এক বার সোজা করছে। ফিসফিস করে বললাম, ‘তোর গায়ে কী জোর!’ বেণু অবাক! ‘কেন?’ চাবিটা দেখালাম— ‘কী করে বেঁকাচ্ছিলি রে?’ বিশ্বাস করুন, এক বারের জন্যও চাবিটা আর বেঁকানো যায়নি। বুঝেছিলাম, রাগলে শক্তি বাড়ে। দুজনে খুব একচোট হেসেছিলাম।
রিহার্সাল ভাল করে দেওয়াটা এক বার বুমেরাং হয়ে গিয়েছিল। নাটকের নাম ‘কুমীরের কান্না’। কল শো ছিল। কিন্তু নাটকের কিছু দিন আগেই জানা গেল, একটা কাজে মাকে দিল্লি যেতেই হবে। এ দিকে কল শো’টা মোটেও ছাড়া যাচ্ছে না, টাকা আসবে। মা বললেন, ‘মুকু করবে। কী আছে?’ আমিও এক পায়ে রাজি। নাটকটা ছিল মজার। রিহার্সালটাও ভারী মজা করে হত। ক’দিনের পরিশ্রমে আমি রেডি। ড্রেস গোছানো শেষ। আগামী কালই নাটক। ও মা! রাতের ফ্লাইটে দেখি, মা ফিরে এসেছেন।
—‘কাজটা হয়ে গেল আগে। তাই চলে এলাম।’ আমি থ।
—‘কেন এলে? কাল শো আমি করব।’ আমিও ছাড়ব না।
—‘তুমি পরের শো করবে।’ মাও নাছোড়বান্দা।
—‘না। কালই করব।
নাটকটায় অভিনয় করতে এত মজা লাগত, মা-মেয়ে আমরা কেউই ছাড়ব না। ঠিক হল মা করবেন। পরের শো আমি করব। তা-ই হল। কিন্তু আবার বিপদ তার পরের শো’তে। যেই শো-ডেট ঠিক হত— আমি আর মা দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলতাম। ‘তুমি না আমি?’
‘কর্ণিক’ নাটকে একটা সর্দারজির চরিত্র ছিল— রাশভারী চরিত্র। ডায়ালগ কম, কিন্তু হাবেভাবে ওই ‘ব্যাপার’টা থাকতে হবে। যাকে বাছা হল, সে সাধারণ চেহারার। মোটামুটি বোঝানো হল, কিন্তু যেই হাঁটছে-চলছে— ‘ওরে তুই অম্বলে ভোগা বাঙালি নোস। ডাল-রুটি খাওয়া তাগড়া সর্দারজি।’
—‘কী করব জোছনদা? আমিও কি তা হলে ডাল-রুটি খাব?’
না, তাকে ডাল-রুটি খেতে হয়নি। হাত রাখার ধরন আর হাঁটার স্টাইলটা বদলে দেওয়াতেই কাজ হয়েছিল। কিন্তু এই উত্তরটা রিহার্সালে খুব ‘চালু’ কথা হয়ে গিয়েছিল। কেউ না পারলেই, বলা হত, ‘কী আর করবে? ডাল-রুটি খাবে!’
সবারই কোনও না কোনও দিন কাজ পড়ে যেত। রিহার্সালে আসতে পারত না। এ ছাড়া সত্যিকারের যানজটের কারণেও (সন্তোষদার যানজট নয়) দেরি হত আসতে। আমার উপায় ছিল না। বসার ঘরের দরজাটা একটু ঠেললেই— বাইরের ঘরেই তো রিহার্সাল। রোজই সাতটা বাজতে পাঁচে ঢুকে পড়তাম। আমারও এক দিন ইচ্ছে হল, লেটে যাব।
‘চলে এসো’— রিহার্সালে বসার আগে কথাটা আমার উদ্দেশে ছুড়ে দিয়ে ঘরে ঢুকত বাবা। শুনতে পাচ্ছি, নাম ডাকা চলছে। আমার নামটা এক বার ডাকল— দু’বার— তিন বারেরটা চেঁচিয়ে। কিন্তু আমি তো ঠিক করেছি, লেটে ঢুকব। শোওয়ার ঘরে বসে আছি। মিনিট দশেক পরে যাব। হঠাৎ আর কোনও শব্দ নেই রিহার্সাল রুমে। কী মনে হতে ঘুরে তাকিয়ে দেখি, আমার পাশে বাবা।
—‘সাতটা বেজে গেছে।’ আমিও সুড়সুড় করে চলে গেলাম। আবার আমার নাম ডাকা হল। বললাম, ‘আছি।’ যেমন সবাই বলে। প্রশ্ন এল, ‘লেট কেন?’ আমিও উঠে দাঁড়িয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললাম, ‘ঢাকুরিয়া মিনিবাসটা লেট করে এসেছে আজ।’।
— ‘মানে?’ কলম থামিয়ে পরিচালক আমার দিকে তাকিয়ে।
— ‘আমারও এক দিন লেট করতে ইচ্ছে করছিল। তাই বললাম।’
এক মুহূর্ত চুপ। তার পর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বলেছিলেন, ‘ঠিক। ঠিক ইচ্ছে। বোসো।’
আমার প্রথম লেখা নাটক ‘কান্দে কেন বেহুলা সোন্দরী’-তে প্রায় বারোটা ছোট-বড় গান ছিল। সুর শুনে বলেছিলাম অরিন্দমকে (অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়), ‘গান রেকর্ড হবে, আমার মেয়েরা শুধু ঠোঁট নাড়বে।’ আমি জানি, মেয়েরা ওই শক্ত গান গাইতে পারবে না।
অরিন্দম কোনও উত্তর তো দিলই না, বরং একটা হারমোনিয়াম নিয়ে জাঁকিয়ে বসেই পড়ল। মেয়েরা তো কাঠ। আমার দিকে করুণ মুখে তাকিয়ে। ইশারায় অভয় দিলাম। ভেসে এল সুর— ‘গাঙরীর গহীন জলে/ বেহুলা ভেসে চলে/ চোখে যে তার অথৈ পারাবার/ একা দিন কাটে বেহুলার।’
—‘না, না, আমার মেয়েরা গাইতে পারে না।’ আবার উত্তর নেই। মেয়েদের দিকে তাকিয়ে শুধু বলল, ‘কী রে, তোরা পারবি না?’ আঁতকে উঠি, শুনি সবাই বলছে— ‘হ্যাঁ...অ্যা...অ্যা, পারব।’ ভুল শুনছি নাকি?
অরিন্দম হেসে এ বার বলল, ‘কৃষ্ণ বাঁশি বাজাবে আর গোপিনীরা নাচবে না, তাই কি হয়?’ অর্থাৎ, অরিন্দম হারমোনিয়াম ধরলে কাকও কোকিল? হতে পারে না। কিন্তু হয়েছিল। চার্বাকের মেয়েরাই দাপিয়ে গেয়েছিল সব ক’টা গান। মহড়া ঘর গমগম করছিল বেহুলা নাটকের গানে।
‘চলো, পটল তুলি’ নাটক থেকে অরিন্দমের পরিচালনা শুরু চার্বাকে। আন্তরিক, সাবলীল শেখানোর পদ্ধতি। ঠান্ডা মাথা, কোনও রাগ নেই। যত বার না হবে, দেখিয়ে দেবে। এক দিন বার বার দেখানো সত্ত্বেও এক জন পারছে না। রাগ হচ্ছে ভেতরে। অরিন্দম শান্ত। শান্তি-হাসি মুখে উঠেই তার কাছে গেল। না, দেখাতে নয়— লাথি মারতে। আলতো লাথি। আর এক জন শুনল বাংলা গালি। সেটাও হাসি মুখে। ধীরে ধীরে জমে উঠল রিহার্সাল। পরিচালক হয়ে উঠল আরও সাবলীল। এক-একটা বাংলা গালিতে ডাকে এক-এক জনকে। মেয়েরাও বাদ নেই।
আড়ালে বোঝালাম— ‘জিভে রাশ টানো।’
পর দিন থেকে নো লাথি, নো গালি। রিহার্সাল চলছে, যেমন চলে। না পারলেও কিছু বলছে না। লক্ষ করছিলাম, সবাই যেন কেমন ভাবে আড়ষ্ট হয়ে রিহার্সাল করছে।
এক জন বলেই ফেলল, ‘তুমি আর গালি দিচ্ছ না কেন?’
আর এক জন বলে, ‘তোমার মুখে গালিটা ভারী মিষ্টি শোনায়।’
কয়েক জন নিশ্চিত, ‘পারছি না বলে দাদা রাগ করেছে।’
‘লাথি না মারলে ডায়ালগ-ই বলব না।’ ছেলে-মেয়েদের সোচ্চার প্রতিবাদ।
অরিন্দমের নির্বিকার উত্তর— ‘বউ বারণ করেছে।’
সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল একসঙ্গে— ‘কেন? কেন বলেছ? আমরা তো রাগ করি-ই না, দাদা আমাদের নিজের নামে ডাকলেই তো বরং আমরা চমকে উঠি।’
আমি হাসব না কাঁদব? যাদের জন্য বলতে গেলাম, তারাই তো দেখি আমার বিরুদ্ধে।
রিহার্সাল রুমে এর পর থেকে আনন্দ আর মহড়া। মহড়া আর গালি। গালি আর আমরা। আমরা আর আমাদের মহড়া।
kheyali.dastidar@gmail.com