দু’টি ‘সত্যি গল্প’ দিয়ে শুরু করা যাক। স্বাভাবিক কারণেই পরিচয় বদলে দিতে হল। আশা করি তাতেও চিনতে অসুবিধেহবে না। গল্প দু’টিতে এক আশ্চর্য মিল রয়েছে। পাঠকরা নিশ্চয় দেখে নেবেন।
সত্যি গল্প ১
শ্রীসরিৎশেখর সেন আর শ্রীমতী মালিনী সেনের পরিবারটি বড়। একটু বেশিই বড়। তাঁদের তিন পুত্র এবং দুই কন্যা। আগেকার দিনে বলেই এমন, এখন তো এত বড় পরিবার দেখাই যায় না। সবাই বলত, ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস সেন’-এর চিন্তা নেই। বুড়ো হলে এতগুলো ছেলেমেয়ে মিলে দেখাশোনা করবে। পাঁচ দু’গুণে দশ হাতের সেবা-যত্ন কাদের কপালে জোটে?
সরিৎশেখরবাবু সরকারি চাকরি করতেন। মালিনী রায় ছিলেন মেয়েদের স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। ছেলেমেয়ে বড় করবেন বলে চাকরি ছাড়লেন। ছেলেমেয়ে বড় হল। লেখাপড়া শিখে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হল। আলাদা আলাদা সংসার তৈরি হল। দুই ছেলে আর এক মেয়ে নিজের পছন্দমতো বিয়ে করেছে। প্রেমের বিয়ে। প্রথমে করল বড় ছেলে। সরিৎবাবু এবং মালিনীদেবীর পুত্রবধূকে খুবই পছন্দ।
সরিৎবাবু স্ত্রীকে বলেছিলেন, “তুমি খামোকাই ভয় পাচ্ছিলে। দেখছ তো মেয়েটি কত ভাল!”
মালিনীদেবী কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, “কী করব বলো, ভয় হবে না? চার পাশে যা দেখছি... শাশুড়ি আর ছেলের বৌতে খুনোখুনি হয়ে যাচ্ছে। শ্বশুর-শাশুড়িকে টেনে জেলে পুরছে। বড় খোকা যদি সে রকম কাউকে ঘরে নিয়ে আসত?”
সরিৎবাবু বললেন, “আমাদের ছেলে অমন মেয়ের সঙ্গে মিশবে কেন? আমাদের প্রতি শ্রদ্ধা, দরদ দুই-ই আছে।”
সেই বড় ছেলে বদলি হয়ে শিলিগুড়ি গেল। পুত্রবধূ শাশুড়িকে জড়িয়ে কাঁদল।
মালিনীদেবী বললেন, “কাঁদিস না, শিলিগুড়ি তো ঘরের কাছে।”
পুত্রবধূ বলল, “আমি কোনও কথা শুনব না, আগে বলো তুমি আর বাপি গিয়ে আমার কাছে থাকবে? বলো, কথা দাও।”
মালিনী কথা দিলেন, রাখলেনও। শিলিগুড়ি গেলেই ছেলের বৌ বোরোলি মাছ এনে খাওয়াত।
বড় মেয়ে প্রেমে পড়ল এবং এক কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারকে বিয়ে করে নয়ডাতে পাড়ি দিল। বড় ফ্ল্যাট। দুটো গাড়ি। বাবা-মা গেলে, অফিসে ছুটি নিয়ে গাড়ি চালিয়ে এ দিক-ও দিক বেড়াতে বেরোয়। মালিনীদেবী গদগদ মুখে বলতে থাকেন, “এই ছেলে নিশ্চয়ই গত জন্মে আমার নিজের পেটেরসন্তান ছিল।”
বাকি দুই পুত্র এবং এক কন্যার বিয়ে সরিৎবাবুরা নিজেরা দেখেশুনে দিলেন। দুই বৌমার মতোই ছোট জামাইটি চমৎকার। মেজছেলেকে ক’দিনের মধ্যেই অফিস প্রোমোশন দিয়ে বিলেতের ব্রাঞ্চে পাঠিয়ে দিল। বছর ঘুরতেই প্লেনের টিকিট পাঠিয়ে ছেলে বাবা-মাকে বিলেত নিয়ে গেল। ইতিমধ্যে ছোট বাড়ি কিনে ফেলেছে। মালিনীদেবী সেখানে গাউন পরলেন, সরিৎশেখর দু’দিন ওয়াইন পান করলেন।
ছোট পুত্র অধ্যাপক। বিয়ে করে সে পেল শান্তশিষ্ট অধ্যাপিকা আর নিউ টাউনের থ্রি-বিএইচকে ফ্ল্যাট। সেই মেয়ে মাঝেমধ্যেই শনিবার করে শাশুড়ি, শ্বশুরকে সেই ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দেয়।
“মা, দুটো দিন সংসার ভুলে ঝাড়া হাত-পায়ে কাটিয়ে আসুন দেখি। কাজের লোক, রান্নার লোক সব ঠিক করে এসেছি। ব্যালকনিতে সকাল-বিকেল বসে চা খাবেন। আমি আপনাদের জন্য বেতের চেয়ার-টেবিল কিনেছি।”
ছোট মেয়ের বিয়ে হল হাতিবাগানের ব্যবসায়ী পরিবারে। বনেদি একান্নবর্তী পরিবার। রোজ পাত পড়ে তেইশ জনের। ছেলের বয়স কম। বিনয়ী, নম্র। নিজের বিয়ে নিয়ে ছোট মেয়ে গদগদ।
“সত্যি মা, তোমরা আমার বিয়েটা বড্ডভাল দিয়েছ।”
মালিনীদেবী বলেন, “অমন বলে না, নজর লেগে যাবে। বাঁ হাতের কড়ে আঙুলটা দে দেখি, কামড় দিই।”
সরিৎশেখর, মালিনী তাঁদের সন্তানদের সুখে গর্বিত, সুখী। দুই মেয়ে নিজেদের সংসারে, এক ছেলে বিদেশে, এক ছেলে প্রবাসে। স্ত্রী এক ফুটফুটে শিশুপুত্রের জন্ম দেওয়ায় ছোট পুত্র পাকাপাকি ভাবে নিউ টাউনের ফ্ল্যাটে থাকে। ঠিকই করে। তেরো তলায় পলিউশন কম। বাকিদেরও ছেলেপুলে হয়েছে। সময় ভাগ করে বিলেত, নয়ডা, শিলিগুড়ি, নিউটাউনে গিয়ে নাতিনাতনি সামলান সেন কর্তা-গিন্নি। সবাই খুব যত্ন করে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় মুখের সামনে চা, ফ্রুট জুস। ছোট মেয়ে মা হওয়ার সময় একেবারে বরকে বগলদাবা করে নিয়ে হাতিবাগান থেকে চলে এসেছিল।
“কী করব মা? এমন ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছ যে, এক দিনও ওকে ছাড়া থাকতে পারি না।”
এই কর্তব্য, স্নেহ, ভালবাসার পালা শেষ হলে বাগুইআটির বাড়িতে থিতু হলেন সেন-দম্পতি। বয়স বেড়ে গিয়েছে। সরিৎশেখর বিরাশি, মালিনীর বয়স সাতাত্তর ছুঁই-ছুঁই। তিনতলা বাড়িটা হা-হা করে। এত বড় বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ করাও কঠিন। বিলেত, শিলিগুড়ি, নয়ডা, নিউ টাউন, হাতিবাগান থেকে সকাল-বিকেল ফোনে নানা রকমইনস্ট্রাকশন আসে।
“বিজয় মালিকে দিয়ে প্রতি শনিবার বাগান ঝাঁট দেওয়াবে। বাবা তো একটু দাঁড়িয়ে দেখতে পারে।”
“খুকুর মাকে খাটের তলাগুলো মুছতে বলবে। গত বার দেখেছিলাম, ইস! কী ধুলোই না জমেছিল! মা আপনি ভয় দেখাবেন, বলবেন, বৌমারা এসে দেখলে খুব রাগ করবে।”
“খবরদার ডেবিট কার্ড বের করবে না। ক্যাশ যা আছে তাই দিয়ে চালাবে। অচেনা নম্বরের ফোন ধরবে না। ওটিপি নম্বর বলবে না কখনও।”
“বাবা যেন লাঠি হাতে দুমদাম রাস্তায় না বেরোয়। পড়ে গেলে খুব ঝামেলা হবে। ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে পরীক্ষা চলছে। যেতে পারব না কিন্তু। অভাব তো কিছু নেই, যখন যা লাগবে ফোন করবে। অ্যাপে কিনে দেব।”
সত্যি দুই বুড়োবুড়ির অভাব কিছু নেই। বরং বেশিই হয়ে যায়। ছেলেমেয়ে, পুত্রবধূ, জামাইরা ঢেলে জিনিসপত্র পাঠায়। খাবারে ফ্রিজ উপচে পড়ে। জামাকাপড় আলমারিতে ধরে না। তবে এত ইনস্ট্রাকশনের পরেও নানা ভুল হয়ে যায়। মালি কাজে ফাঁকি দেয়, খুকুর মা খাটের তলায় ধুলো জমিয়ে রাখে, অচেনা ফোন নম্বরে সরিৎশেখর ভুল করে ব্যাঙ্কের ওটিপি নম্বর বলে ফেলেন। ছেলেমেয়েরা বকাবকি করে। দুনিয়ার সঙ্গে নিজেদের মানানসই করতে হবে না? কার্ড, পাসওয়ার্ড, অ্যাপ, ওটিপি নম্বরের সঙ্গে কি চশমা, লাঠি, মাঙ্কি ক্যাপ দিয়ে লড়াই চলে? সরিৎশেখর, মালিনী ফোন কানে চুপ করে বকুনি শোনেন।
এক আলো না-ফোটা ভোরে সরিৎশেখর হার্ট অ্যাটাকে নিঃশব্দে মারা গেলেন। এর পর যেমনটি হওয়ার, হল তেমনটিই। ছেলেমেয়েরা ছুটে এল। কর্তব্যকর্ম যা করার সবই করল অতি যত্নে, কোনও কার্পণ্য ছাড়াই। ভাইবোনেরা সবাই বসে সিদ্ধান্ত নিল, বসতবাড়ি বিক্রি হবে। এ বাড়ি রাখা অর্থহীন, দেখাশোনা অসম্ভব। বৃদ্ধা মায়ের একা থাকাও অসম্ভব। বাড়ি বিক্রির টাকা মায়ের নামেই ব্যাঙ্কে জমানো থাকবে। কিন্তু মাকে রাখা হবে কোথায়?
অবশ্যই ছেলেমেয়েদের কাছে থাকবেন।কিন্তু কোন ছেলেমেয়ে? পাঁচ জনেই বলল,“আমার কাছে।”
তাদের সঙ্গে হাত তুলল জামাই আর পুত্রবধূরা। এমনকি হাতিবাগানের জামাই পর্যন্ত জানাল, পরিবারে সদস্য কমে যাওয়ায় তার বাড়িতে ঘর ফাঁকা হয়েছে। কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু এত জনের কাছে তো এক সঙ্গে থাকা যাবে না। ভাগ করে থাকতে হবে। সেই ভাগ হবে কী করে? এক-এক জন এক-এক রকম বলতে শুরু করল।
“ডিসেম্বর-জানুয়ারিটা কিন্তু আমাদের হবে না। ওই সময়টা আমরা একটু বেড়াতে যাই।”
“অক্টোবর থেকে তো ও দেশে বিরাট ঠান্ডা। মা পারবে না।”
“ফ্রেরুয়ারি থেকে মার্চ আমি আর তোমাদের দাদা দু’জনেই অফিসে খুব ব্যস্ত থাকি। ইয়ারএন্ডিং কি না!”
“এপ্রিল থেকে জুন বাবাই আর বাকুলির এগজ়াম। পাগল-পাগল করে। মায়ের দিকে একটুও খেয়াল রাখতে পারব না।”
“অগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর জানোই তো হাতিবাগানের বাড়ির সবাই তিড়িং-বিড়িং করে লাফায়। পুজো এসে যায় না, কাপড়ের ব্যবসা যে! ওই ক’টা মাস বাড়িতে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ। ঘরে ঘরে জামাকাপড় ডাঁই করা হয়। গোটা বাড়িটাই যেন গোডাউন। আমাদের অন্য মাসের কথা বলো।”
“জুলাই মাস আমার ওখানে নয়। আমরা কমিউনিটি থেকে রেন ফেস্টিভাল করি। নিজেরা তো নাচগান করিই, বাইরে থেকেও আর্টিস্টরা আসেন। ক্লাসিকাল মিউজ়িক। এ বার সন্তুরবাজাতে আসবেন...”
তা হলে কী হবে? সবাই রাখতে চায়, কিন্তু নিজের নিজের সুবিধে মতো। শেষ পর্যন্ত স্থির হল, এত অসুবিধে শোনা যাবে না, লটারি হবে। বাক্সে বারো মাসের নাম লেখা কাগজের টুকরো রাখা হবে। সেটাকে নাড়ানো ঝাঁকানো হবে আচ্ছা করে। সব যেন মিলেমিশে, ঘেঁটেঘুঁটে যায়। তার পর ছেলেমেয়েরা চোখ বন্ধ করে কাগজ তুলবে। যার ভাগ্যে যে মাস পড়বে, তাকে সেই মাসের জন্য মায়ের দায়িত্ব নিতে হবে। পরের বছরআবার লটারি।
লটারির আয়োজন শুরু হল। মাকেরাখার লটারি।
সত্যি গল্প ২
নিরাপদ পাইন আটাত্তরে পা দিয়েছেন। রাজ্যের অসুখবিসুখ চেপে ধরেছে। দুটো চোখেই জোর কমেছে। ছেলে হরিশঙ্কর দু’বছর আগে ফ্রি ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে ছানি কাটিয়ে এনেছিল। তাতে লাভ বিশেষ হয়নি। সমস্যা শুধু ছানি নয়, আরও নাকি জটিলতা রয়েছে। বাপের অত জটিল চিকিৎসা করানোর মতো টাকা পয়সা একমাত্র পুত্র হরিশঙ্করের নেই। থাকবে কী করে? তার রোজগার বলতে মুদির দোকানে কাজ। ক’টা টাকাই বা বেতন পায়? বৌ, দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার চালানোই দায়। জিনিসের দাম যে ভাবে বাড়ছে, চিকিৎসার খরচ সামলাবে কী করে? তা ছাড়া বুড়ো বাপের অসুখ তো আর একটা নয়। হাঁটুতে গোলমাল। বসলে, হাঁটলে, শুলে সবেতেই কষ্ট। শিরদাঁড়াতে হাড় নড়েছে। কুঁজো হয়ে চলতে হয়। কানেও সর্বক্ষণ ভোঁ-ভোঁ আওয়াজ। স্ত্রী কমলা বেঁচে থাকতে তাও বার কয়েক হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তিন বছর হল সে মারা যেতে সে সব পাট চুকেছে। হরিশঙ্করের বৌ নীতা বুদ্ধমতী। সে অভাব-অনটনের মধ্যে কী ভাবে পয়সা বাঁচাতে হয়, জানে। স্বামীকে সে কথা বলেও।
“বাবার অসুখবিসুখের পেছনে পয়সা খরচে লাভটা কী? বয়সটা দেখো, বাঁচবে ক’দিন?”
হরিশঙ্কর ভেবেও দেখেছে, সত্যি এই বয়সে রোগ সারিয়ে কাজ নেই। ছোটাছুটি তো নেই, হাত-পা নাড়াতেও হয় না। নাড়ানোর জায়গাই বা কই? এক সময় এক ফালি জমিতে যে দুটো ঘর তুলেছিল নিরাপদ, সে সব তো ছেলে, ছেলের বৌ আর তাদের দুই কন্যার দখলে। তার জন্য প্লাস্টিক দিয়ে বারান্দা ঢেকে ঢুকে দিয়েছে নীতা। তার নীচেই বুড়ো ঘর বেঁধেছে। প্লাস্টিকই জানলা, প্লাস্টিকই দরজা। সারা দিন থুম মেরে থাকা। চোখ, হাঁটু গোল্লায় যাক। এই দুনিয়ায় নিরাপদর আর দেখারও কিছু নেই, কোথাও যাওয়ারও নেই। শুধু পেটটাই যা ঝামেলা করে। খালি খিদে-খিদে পায়। নীতা বলে, তার বুড়ো শ্বশুরের এটাই নাকি অসুখ। বরের উপর রাগারাগিও করেছে।
“তোমাদের বংশটাই খাই-খাইয়ের বংশ। মেয়েদুটোও ও রকম হয়েছে। তাও ওদেরটা বুঝলাম। তোমার বাবার এ কী ছোঁচা অভ্যেস গো! এই বয়েসে কেউ অমন গিলতে চায়! বিছানা নোংরা করে পড়ে থাকলে, তোমাকেই পরিষ্কার করতে হবে।”
হরিশঙ্কর মাথা নেড়ে বলে, “ঠিকই বলেছ।”
নীতা ধমকে ওঠে, “বৌয়ের কথায় বার বার ঘাড় না নেড়ে একটা কিছু করো। মানুষটাকে দিনের মধ্যে কিছু সময় বাইরে রাখার ব্যবস্থা করো দেখি। খাই-খাই শুনতে হবে না।”
ব্যবস্থা হয়েছে। সুব্যবস্থা। হরিশঙ্কর-নীতা দু’জনে ভেবেচিন্তেই করেছে। এতে নিরাপদর একটু বেরোনোও হবে, সংসারে দুটো পয়সাও আসবে।
আটাত্তর বছরের এক বৃদ্ধ বাজারের কাছে প্লাস্টিকের টেবিল-চেয়ার পেতে বসেছে। সামনের নড়বড়ে টেবিলে সাজানো কতগুলো সস্তার লটারি টিকিট। কুঁজো মানুষটা বিড়বিড় করে কিছু বলছে, শোনা যাচ্ছে না। তবে বোঝা যাচ্ছে, সে লটারির টিকিট বেচতে চায়। তাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে। চিন্তিত কেন? পরিবারের আপনজনেরা কি তাকে টিকিট বিক্রির টার্গেট বেঁধে দিয়েছে? হতে পারে।
অবশিষ্ট জীবনটুকু
এই দুই গল্প জেনে কেউ যদি মনে করে, দুনিয়ায় বয়স্ক মানুষদের অবশিষ্ট জীবনটুকু আসলে ‘লটারি নির্ধারিত’, তা হলে কি খুব ভুল হবে? কার জন্য জীবনের শেষ পরিচ্ছেদটি কী নিয়ে অপেক্ষা করে সেটা বলা মুশকিল। শেষটুকু যেন ‘ভাগ্যনিয়ন্ত্রিত’। টাকাপয়সা, বাড়ি গাড়ি থাকলেও যে এক জন প্রবীণ সুখে থাকবেন, আনন্দে থাকবেন, নিজের মতো থাকতে পারবেন, এমনটা ভাবার কারণ নেই। বয়স তাকে বাধ্যতামূলক পরাধীনতার দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। উত্তরাধিকারী, নয়তো শরীরের রোগ, অথবা পারিপার্শ্বিক অবস্থার হাতে তাঁকে বন্দি হতে হবেই। আর যদি তিনি ‘অর্থহীন’ হন, তা হলে তো সেই বেঁচে থাকাটা বেশির ভাগ সময়েই অর্থহীন।
অপমানের বয়স
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তাঁর ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ উপন্যাসে যে বৃদ্ধ জেলের গল্প বলেছিলেন, তিনি শেষ পর্যন্ত একটি দানব মাছের মস্ত কঙ্কাল নিয়ে এসে জাহাজঘাটায় পৌঁছন। বিধ্বস্ত, পরাজিত, অসহায় এক মানুষ। আজকের দুনিয়ায় কোনও বয়স্ক মানুষ জীবনের উপান্তে এসে নিজেকে উপন্যাসের সেই বৃদ্ধের সঙ্গে যদি খানিকটা তুলনা করে বসেন, তা হলে কি তিনি খুব ভুল করবেন? তাঁর যদি মনে হয়, ‘এত দিন পরম মায়ায় যে জীবন টেনে আনলাম শেষ পর্বে এসে সে শুধুই ঠকিয়ে দেওয়া, কৃতজ্ঞতাহীন এক কঙ্কাল’— তা কি একেবারই উড়িয়ে দেওয়ার মতো কথা হবে?
মনে হয় না। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, শিক্ষা-চেতনা নিয়ে দুনিয়া যত এগোচ্ছে, ‘সভ্য’ হচ্ছে যত, এই সমাজে প্রবীণ (সিনিয়র সিটিজ়েন) মানু্ষের জন্য অপমান, নিষ্ঠুরতা, অপরাধ বাড়চ্ছে ততটাই। প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে ঘটনার পর ঘটনা। উদাহরণ শেষ করা যাবে না। শুধু সংবাদ নয়, সমাজমাধ্যমেও ঘোরে শিউরে দেওয়া কাহিনি। কখনও বৃদ্ধ নিজের বাড়ির কোণে ঠাঁই পেয়ে অভুক্ত, অসুস্থ হয়ে পূতিগন্ধে দিন কাটাচ্ছেন। কেউ ফিরে দেখার নেই, কেউ নালিশ শোনার নেই। কখনও বৃদ্ধার হাতে মুড়ির টিন ধরিয়ে আপনজন ঘরের তালা বন্ধ করে চলে যাচ্ছে তিন দিনের আমোদ-সফরে। খিদের কান্না শুনে প্রতিবেশীরা এসে দরজা ভাঙছে। কখনও বৃদ্ধা শাশুড়ির পায়ে শিকল, বুকে পাথর দিয়ে পুত্রবধূ মোবাইলে গল্প ফেঁদেছে। কখনও বৃদ্ধ বাথরুম সামলাতে না পারায় ছেলের বেদম পেটানির ছবি মোবাইলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বৃদ্ধা ঠাকুমা, পিসিমা, মাকে অচেনা রেলস্টেশনে বসিয়ে চলে আসার ঘটনা তো আকছার ঘটে। আদালতে প্রায়ই নালিশ, ছেলে খেতে দেয় না, পুত্রবধূ বাড়িতে থাকতে দেয় না, সম্পত্তি লিখে দেওয়ার জন্য ভাইপোরা ভয় দেখাচ্ছে, ভাগনি গরম খুন্তির ছেঁকা দিচ্ছে। সংবাদে বা সমাজমাধ্যমেই যদি এত নৃশংসতার কাহিনি ছড়ায়, আড়ালে ঘটছে যে কত তা তো আঁচ করাই যাচ্ছে। পুলিশ থানায় নালিশ গেলে, আদালতে উঠলে তবেই সামনে আসে। সে আর ক’জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পেরে ওঠেন? পারবেনই বা কী করে! এই বয়স তো শরীরে, অর্থে, সাহসে অক্ষম হয়ে পড়ার বয়স। গোপন মোবাইলে কত জনই বা প্রতিবেশীর বাড়ির পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে লাথি, ঝাঁটা, শিকলের ফোটো তুলতে পারে? যদি বা পাড়াগাঁয়ে, ছোট মফস্সল শহরে, বস্তি এলাকায় পাশের বাড়ি, পাড়ার লোক, পথচারী কান্না শুনলে ছুটে যায়, ক’দিন দোকানে-বাজারে, চায়ের দোকানে, দাওয়ায় বসে থাকতে না দেখলে খবর জানতে চায়, ঝাঁ-চকচকে শহরের আরও চকচকে বাড়ির বা ফ্ল্যাটবাড়ির ‘শিক্ষিত’দের সেই স্বভাব নেই মোটে। তারা ফিরেও তাকায় না। পাশের বাড়ির ‘বুড়োবুড়ি’র মারধর নিয়ে কৌতূহল রুচিবহির্ভূত। চিৎকার শুনলে জানলা আটকে দেওয়াটাই সৌজন্য। স্মার্ট সিটিতে থাকতে গেলে স্মার্ট নিয়ম মানতে হয়। খেতে না দেওয়া, গায়ে ছেঁকা দেওয়া, এক বারের বেশি দু’বার জলের কল খুললে ‘রে রে’ করে ছুটে গিয়ে দু’ঘা দিয়ে সবক শেখানোটা পারিবারিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। শিশুকে যেমন কঠোর শাসনে রাখতে হয়, মনে রাখতে হবে, বেশি বয়সও হল দ্বিতীয় শৈশব, তাই সেখানেও চাই কঠোর শাসন।
যতই পাঠ্য বইতে লেখা থাকুক এবং কম বয়সে শেখানো হোক, বয়স্করা হলেন গুরুজন, বৃদ্ধ মানুষ হলেন মহীরুহের মতো, তাঁদের প্রতি সম্ভ্রম দেখানোটা শিক্ষা, যত্নশীল হওয়াটাই কর্তব্য, হাত ধরাটা খানিকটা যেন ঋণ শোধ, এই দুনিয়ায় কোনও কোনও ঘটনা দেখলে, শুনলে মনে হয়, বয়স হওয়াটাই সব থেকে অপমানের। বইয়ে যা-ই থাকুক, ব্যস্ত পৃথিবী মহাকাশে উড়ে যাওয়ার, সমুদ্রের অতলে ডুব দেওয়ার জন্য সময় রেখেছে, বয়স্ক মানুষের পাশে বসার জন্য দু’দণ্ড সময় বার করতে পারেনি। যে ঠাকুমা-ঠাকুরদা, দাদু-দিদারা নাতিনাতনিদের গোটা রাত কোলে নিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে, দুপুরবেলা পাশে শুইয়ে গল্প বলেছে, ভাত মেখে খাইয়েছে, হাত ধরে পার্কে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছে, বাবা-মায়ের বকুনি থেকে আগলে রেখেছে দু’হাতে, তাদের দিকে ফিরে তাকানোর ফুরসতটুকুও এই জগৎ রাখল কই? নাতিনাতনি বেচারিরা করবে কী, পৃথিবীর তিন ভাগ জলের মতোই এই লেখাপড়া জানা, হাই-টেক জীবনের তিন ভাগে যে শুধু কেরিয়ার, কেরিয়ার আর কেরিয়ার। ব্যস্ততা কম? দাদু-ঠাকুমার অসুস্থতার খোঁজ নেওয়ার সময় কোথায়? ঠাকুমার উপহার দেওয়া পাঁচ ভরির হারটি যে নাতবৌ ব্যাঙ্কের লকারে রেখে আসার সময় পেয়েছে, তা-ই কি যথেষ্ট নয়? অফিসে ছুটি নিয়ে ঠাকুরদার মৃত্যুশয্যার পাশে বসে থাকা কি সম্ভব? না কি যুক্তিযুক্ত? আরে সম্পত্তি ভাগ-বাঁটোয়ারার সময় আসতে হবে না! ঠাকুরদা, ঠাকুরমার সঙ্গে জেনারেশন গ্যাপ হতে পারে, তাদের জমি-বাড়ির সঙ্গে হয় না।
নাই ভেদাভেদ
বয়সের কাছে ধনী-দরিদ্রে ভেদাভেদ নেই। টাকাপয়সা থাকলে বয়সের অসুখ কিছু দিনের জন্য সামলানো যায়। ব্যয়বহুল বিশেষ চিকিৎসা, নতুন নতুন ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা এসেছে। যাঁর সামর্থ্য আছে, তিনি বহু টাকায় তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসছেন। অনেক সময় পুত্রকন্যা বিদেশ থেকে ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। তবে আমাদের দেশে, রাজ্যে, শহরে এই সংখ্যা এতটাই নগণ্য যে শতকরা হিসাবেও আসবে না। তাও কেউ কেউ তো পান। দু’মুঠো খাবারের খোঁজে ন্যুব্জ হয়ে পথের পাশ ধরে হাঁটতে তো হয় না। তবে টাকা থাকলেও বৃদ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা সবার। কারও পেটের খিদেয়, কারও হাঁটুর ব্যথায়, কারও একাকিত্বে। আলিপুরে আঠারো তলার উপর যে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সকাল বিকেল সন্ধে বসে রয়েছেন, তাদের একাকিত্বের যন্ত্রণা হাঁটু বা কোমরের ব্যথার থেকে কম কিছু নয়। যতই বয়স্কদের জন্য ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি থেকে ভাড়া করা সঙ্গী গল্প করতে, দাবা খেলতে আসুক না কেন, খানিক পর থেকে তাকে রোবটের মতো মনে হয়। শেষ রাতে ভেঙে যাওয়া ঘুমের পর দিনকে মনে হয় দীর্ঘ, একঘেয়ে।
গোটা শহরটাই বৃদ্ধাবাস
সে ছিল এক সময়, যখন কলকাতা শহরের এলাকা এলাকা, পাড়া থেকে খুব বেশি হলে একটি বা দু’টি পরিবারের সন্তান বিদেশে বা প্রবাসে যাত্রা করত। হয় উপার্জনের জন্য, নয় লেখাপড়া। লেখাপড়া কমই হত। বিলেত-আমেরিকায় স্কলারশিপ নিয়ে উচ্চশিক্ষায় যেতে পারার যোগ্যতা ছিল সামান্য কয়েক জনেরই। চলও ছিল না। ভাল রেজ়াল্ট করে অনেকে এখানেই থেকে যেত। ‘পিতৃদেবের পয়সা’ খরচ করে বিদেশে পড়তে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল নামমাত্র। কেউ বিদেশে গেলে আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী দল বেঁধে এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে যেত। তখন কলকাতা এয়ারপোর্টে ভিউয়িং গ্যালারি ছিল, সমুদ্র পেরিয়ে দূর দেশে উড়ে যাওয়ার জন্য অনেক এয়ারলাইন ছিল। সে পাট উঠেছে। কিন্তু প্রবাসে, বিদেশে যাওয়ার চল বেড়েছে কয়েকশো গুণ। খোদ কলকাতা তো বটেই, বালিগঞ্জ, টালিগঞ্জ, লেক টাউন, সল্টলেক, নিউ টাউন থেকে দলে দলে ছেলেমেয়েরা ট্রলিব্যাগ গড়িয়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। ঘরে ঘরে বিদেশ যাওয়ার ঢল। ‘ছেলে বিলেতে, পুত্র আমেরিকায়’— এ কথা আর কেউ বলে না, কেউ শুনতেও চায় না। বলে লাভ কী? যাদের বলা তাদের পুত্র, কন্যা, ভাইঝি, বোনপো, জায়ের কন্যা, শ্যালক, শ্যালিকারাও তো বাইরে। বিলেত, আমেরিকা না হলে বেঙ্গালুরু, পুণে, নয়ডা তো বটেই। প্রথমে লেখাপড়া, তার পরেই চাকরি। তার সঙ্গে বৈবাহিক কারণ তো রয়েছেই। একটু যোগ্যতা, একটু সুযোগ, একটু যোগাযোগ থাকলেই এখন ‘পালাও, পালাও’। পাড়ার পর পাড়া ছেলেমেয়ে-শূন্য। এমন পাড়া রয়েছে, যেখানে এখন একটি বাড়িতেও ছেলেমেয়েরা থাকে না। বারান্দায়, বারান্দায় শূন্যদৃষ্টি, ভাবলেশহীন মুখে বসে থাকা প্রবীণ-প্রবীণারা ঘরবাড়ি আগলে বসে থাকেন। সন্তান বাইরে পড়তে যাওয়ার সময় আনন্দ, গর্ব, চাকরি পেলে মন ভাল। যাক, সন্তান থাকবে খাঁটি দুধে ভাতে। তার পর? তার পর যত দিন যেতে থাকে, একাকিত্ব ঘিরে ধরে কুয়াশার মতো। সেই কুয়াশা কেটে রোদ ওঠার সময় খবর আসে, ছেলে এ বছরও দেশে আসতে পারবে না। নাতনির স্কুলের পরীক্ষার জন্য মেয়েও গিয়েছে আটকে। ভাইপো বলেছিল, তিন বছর পর দেশে আসবে, কাকা-কাকিমার কাছে থাকবে ক’দিন। সে হঠাৎ চাকরি বদলাচ্ছে, দেশও বদলাচ্ছে। তারও আসা হল না। ওয়টস্যাপ কলে বাড়তি খরচ নেই, কিন্তু যাদের সঙ্গে কথা হবে, তাদের কথার বলার বাড়তি সময় নেই। ভিডিয়ো কলে নাতিনাতনিরা ‘হাই ডাডু!’ বলে হাত নেড়ে নিমেষে ফ্রেমের বাইরে পালায়। সব মিলিয়ে রোদ আর কিছুতেই উঠতে চায় না, মনখারাপের কুয়াশাও কাটে না। একাকী বুড়োবুড়ি কিছু দিনের জন্য পাড়ায়, গলিতে, আবাসনে প্রবীণদের নিয়ে দল বাঁধার চেষ্টা করেন। পার্কে আড্ডা, রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুল-সন্ধ্যা, সিনেমা, পিকনিক... একটা সময়ের পর থেকে ক্লান্ত লাগে, হাসি, উচ্ছ্বাস মেকি মনে হয়। সারা ক্ষণ ভিতরে এক ‘অপেক্ষা’ জেগে থাকে। ভয় হয়, নানা রকম ভয়। রাতবিরেতে বুকে ব্যথার ভয়, বাথরুমে পা পিছলে যাওয়ার ভয়, ঘরে ডাকাত পড়ার ভয়। চিৎকারে কে সাড়া দেবে? পাশের বাড়ি, তার পাশের বাড়ি, তারও পাশের বাড়িতেও যে অসুস্থ প্রবীণ প্রহর গুনছে। মোবাইলের এমারজেন্সি নম্বর কি মনে পড়বে? মনে মন খারাপ আর ভয় নিয়ে দিনরাত মন্থর গতিতে চলে। চোখ সামলে, পিঠের ব্যথা সামলে নতুন করে বইয়ে মন বসানো কঠিন, টিভি সিরিয়ালে একই দৃশ্য, ওটিটি-র সিনেমার রমরম প্রেম, গমগম গুলিগোলায় মাথা ঝমঝম করে। তাও স্বামী-স্ত্রী দু’জনে থাকলে টুকটাক কিছু ভালবাসা, কিছু ঝগড়া, কিছু স্মৃতিচারণ। একা হলে তো ভয়ঙ্কর।
ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম হলে তাও ভাল
গায়ক এক সময় ‘আমার ঠিকানা এখন বৃদ্ধাশ্রম’ গেয়ে শ্রোতাদের মন আর্দ্র করেছিলেন বটে, নিজের বাড়ির ছদ্ম‘বৃদ্ধাশ্রম’টি থেকে সত্যি বৃদ্ধাশ্রম যে অনেকটাই ভাল, অনেকে তখন জানতেন না। এক সময় এখানে সরকার পরিচালিত বৃদ্ধাশ্রম ছিল জেলায় জেলায়। সেই সব বৃদ্ধাশ্রমে কম খরচে প্রবীণ-প্রবীণারা আশ্রয় পেতেন। ব্যবস্থাও ছিল বেশ ভাল। এখন বেসরকারি বৃদ্ধাশ্রমের রমরমা। এই সভ্য দুনিয়ায় প্রবীণদের স্পেস কম, আরও কমবে জেনে এই ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ছে। কম খরচের এক ঘরে গাদাগাদি করে ভাঙা তক্তপোশের তেল-চিটচিটে বিছানায় শুয়ে-বসে থাকার ব্যবস্থা যেমন আছে, তেমন ফাইভ স্টার সুবিধেতে লক্ষ লক্ষ টাকার আয়োজনও হয়েছে। যারা ‘একা’, যারা বুঝে গিয়েছে শেষ পর্যন্ত পরিবার নয়, জীবন একারই, যাদের টাকাপয়সার সমস্যা নেই, যাদের ছেলেমেয়ে, জামাই, পুত্রবধূ, ভাইপো, বোনপোর ভালবাসা অফুরন্ত, টাকাও অঢেল, কিন্তু ‘গেস্ট রুম’-এ ‘স্পেস ক্রাঞ্চ’, তাদের জন্য বিলাসবহল সুটেড-বুটেড বৃদ্ধাশ্রম সেলাম ঠুকে হাজির। মোটা অঙ্কের বিনিময়ে এখানে আপ্যায়ন, সেবা সবই মেলে। আধুনিক পৃথিবী যুক্তি সাজায়, এটাই বিজ্ঞানসম্মত, বাস্তবোচিত। হয়তো তা-ই। একই বয়সের মানুষজন পাশাপাশি থাকবে, সেটাই উচিত, অন্যের একাকিত্বে নিজের একাকিত্ব কমবে। আজকাল দিনে পরিবারের সঙ্গে, প্রিয়জনের সঙ্গে, আদরে আহ্লাদের শেষ ক’টা দিন কাটানোর ইচ্ছে নেহাতই একটা বোকা-বোকা আবেগ।
মনখারাপ, শুধু মনখারাপ, প্রবীণ, তোমার আত্মমর্যাদা নেই?
ব্যতিক্রমের কথা না বললে ভুল
ব্যতিক্রম রয়েছে। এখনও সেই ছেলেমেয়ে, সেই জামাই -পুত্রবধূ, এমনকি সেই টেক-স্যাভি নাতিনাতনিরা রয়েছে যারা বাবা-মা, ঠাকুরদা-ঠাকুমা, এমনকি সহায়-সম্বলহীন আত্মীয়-পরিজনকেও প্রাণ ঢেলে ভালবাসে। ভাত মেখে খাইয়ে দেয়। মায়ের অসুখ হলে ধেড়ে ছেলে আজও রাত জাগে। ঠাকুমাকে দেখতে নাতি বেঙ্গালুরু থেকে উড়ে আসে ভোরবেলা। বাড়ির বৌমা সংসারের কাজ ফেলে মাসিশাশুড়িকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যায়। আজও ভবঘুরেদের বৃদ্ধাশ্রমে গোপনে নতুন কাপড় দিয়ে আসার মতো মানুষ আছে। এবং তারা মোবাইলে ফোটো তুলে ফেসবুকে দেয় না।আছে, আছে, তারা আছে। আর আছে বলেইএই নির্মম বৃদ্ধাশ্রমের পৃথিবীতে কুয়াশা কেটে রোদ ওঠে আজও।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)