Advertisement
E-Paper

‘আপনি বাঙালি হচ্ছেন! আমিও বাঙালি হচ্ছি’

কলকাতার ছেলে আমি। খড়গপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার কয়েকটা বছর বাদ দিলে নিজের শহরের বাইরে থাকিনি কখনও। সেই আমি চাকরি নিয়ে এলাম উত্তরপ্রদেশে, মেরঠ জেলার রাজনগরে। চিফ ইঞ্জিনিয়ার বোস সাহেব খুশি হলেন— কলকাতার ছেলেরা নাকি বেরোতেই চায় না কলকাতা ছেড়ে।

শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:১৬

কলকাতার ছেলে আমি। খড়গপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার কয়েকটা বছর বাদ দিলে নিজের শহরের বাইরে থাকিনি কখনও। সেই আমি চাকরি নিয়ে এলাম উত্তরপ্রদেশে, মেরঠ জেলার রাজনগরে। চিফ ইঞ্জিনিয়ার বোস সাহেব খুশি হলেন— কলকাতার ছেলেরা নাকি বেরোতেই চায় না কলকাতা ছেড়ে। উনি ভেবেছিলেন এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় আমিও হয়ত আসব না।

রাজদের অনেক রকমের কলকারখানা এখানে। দুর্দান্ত নাইলন প্ল্যান্ট, ফ্ল্যাগশিপ কোম্পানি— আমার চাকরি ওই ফ্ল্যাগশিপ কোম্পানিতেই। কন্ট্রোল ইঞ্জিনিয়র হিসেবে। বোস সাহেব বললেন, এখানে আর এক জন বাঙালি আছেন, এই অঞ্চলের পুরনো বাসিন্দা। আলাপ হবে তোমার সঙ্গে।

সবচেয়ে বেশি অসুবিধা হল ভাষার। হিন্দিতে আমি এমনিতেই দুর্বল, তায় এ আবার জাঠ-হিন্দি। পুরো গলদঘর্ম অবস্থা। এখানকার লোকের খাওয়াদাওয়াও— স্বাদে, উপকরণে ও পরিবেশনে— আমার মতন পেটরোগা মানুষের কাছে ভয়াবহ। ভাবলাম, চিড়ে, মুড়ি, খই দিয়ে ক’টা দিন ম্যানেজ করি, পরে দেখা যাবে। দোকানে গিয়ে ‘খই হ্যায়?’ বলাতে দোকানসুদ্ধ লোক হেসে উঠল। বুঝলাম গন্ডগোল হয়েছে। হয়তো ‘কই হ্যায়’ শুনেছে, কিংবা খই এখানে অন্য নামে পরিচিত। আর এক দিন, বাজারটা কোন দিকে জিজ্ঞেস করাতে এক জন বলেছিল ‘শনি মাহল কি পাস’। অনেক ক্ষণ ধরে ‘শনি মহল’ খুঁজে ছিলাম। না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে আর এক জনকে জিজ্ঞেস করলাম, সে আমাকে ‘সিনেমা হল’টা দেখিয়ে দিল, তার পাশেই বাজার!

এক বিকেলে এক জন আলাপ করতে এল। হাসি হাসি মুখ করে বলল, ‘স্যর,আপনি বাঙালি হচ্ছেন! আমিও বাঙালি হচ্ছি। রানা ব্যানার্জি, সুপারভাইজর।’ রানা অনেক সাহায্য করেছিল। পছন্দের খাবারদাবারের প্রাপ্তিস্থান, এখানকার ভাষায় তারা কী নামে পরিচিত— বলে দিয়েছিল। তত দিনে আমার হিন্দির জ্ঞান নিয়ে এখানকার কর্মীদের মধ্যে ফিসফাস শুরু হয়েছে, এবং সবাই এই ব্যাপারে আমার শিক্ষক হয়ে ধন্য হতে চাইছে। এক বার কী একটা ব্যাপারে সব মেকানিক, সুপারভাইজররা একটা আবেদনপত্র নিয়ে এল আমার কাছে, ইংরেজিতে লেখা। চিঠিটার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। এক জন এক গাল হেসে বলল: সাহেব, আপনি যেমন হিন্দিতে কাঁচা, আমরাও তেমনি ইংরেজিতে।

কয়েক দিন পরে এমন একটা ঘটনা ঘটল, যার জেরে সারা রাজনগরে আমি পরিচিত হয়ে গেলাম। ব্যাপারটা এই রকম: খুব দামি একটা ডিজিটাল সিস্টেম বিদেশ থেকে আনা হয়েছে। আমি তার টেস্টিং আর কমিশনিং-এর দায়িত্বে। সব ঠিকঠাক করতে সারা দিন কেটে গেল। কখন যে সন্ধে হয়ে গেছে, সবাই বাড়ি চলে গেছে, বুঝতেও পারিনি। প্ল্যান্টের ভেতর নানান মেশিনারি আর পাইপলাইনের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে শর্ট কাট করছি, মাথায় একরাশ চিন্তা। একটু ফাঁকা জায়গায় এসে দেখি, এক জন মাঝবয়সি লোক, পরনে দুধসাদা সাফারি স্যুট, সাদা জুতো, একটা হাত পকেটে ঢুকিয়ে হিরোর মতন দাঁড়িয়ে। অন্যমনস্ক ছিলাম, পাত্তা না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেছি। পিছন থেকে শুনি, অভদ্রের মতন কেউ কাউকে ডাকছে হিন্দিতে। ঘুরে তাকিয়ে দেখি, সেই সাদা পোশাকের লোকটা। আমাকেই বলছে, ‘এই, কোথায় কাজ করিস? কী নাম তোর?’ খুব রাগ হল। ওর কাছে গিয়ে বললাম, ‘আওয়াজ নিচু করে ভদ্র ভাষায় কথা বলো। তুমি কে? তোমার কী নাম?’ আমার আক্রমণাত্মক মেজাজ দেখে নার্ভাস হয়ে লোকটা বলল, ‘আমি সুনীল রাজ, এই কোম্পানির সিএমডি।’

ধারে পাশে লোকজন নেই, জায়গাটা একটু নির্জন। আমি মনে মনে বললাম, কাম সারসে। বললাম, ‘খুব সরি... আপনার সঙ্গে তো পরিচয় হয়নি আগে... তাই...’ ‘বলো, কী নাম?’ বললাম। ‘কোন কলেজ?’ বললাম। ‘বোস সাহেবের ডিপার্টমেন্ট?’ হ্যাঁ। উনি চলে গেলেন।

ঘটনাটা কাউকে বলিনি। ঠিক করলাম, বোস সাহেব বিদেশ থেকে ফিরলেই ওঁকে বলব। আমার কাছে এখনও দুটো জব অফার আছে, সময়ও পেরিয়ে যায়নি।

দিন দুয়েক পর, এক সকালে বোস সাহেব উত্তেজিত হয়ে প্রায় দৌড়তে দৌড়তে হাজির। ‘এটা কি সত্যি যে তুমি সিএমডি স্যরকে বলেছ ভদ্র ভাষায় আওয়াজ নিচু করে কথা বলতে?’ ‘হ্যাঁ স্যর। আমি কি রেজিগনেশন লেটারটা এখনই দিয়ে দেব?’

‘না না, সব ঠিকঠাক আছে। উনি বললেন তোমাকে ওঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া আমার উচিত ছিল। যাকগে।’

আশেপাশের সব মেকানিক, সুপারভাইজররা সব কথা গিলছে, বুঝতে পারলাম। অচিরেই ঘটনাটা রংচং লাগিয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে গেল। সারা অফিসে ফিসফিস, গুজগুজ। এখানে-ওখানে, রাস্তাঘাটে যার সঙ্গে দেখা হয়, বলে, বেশ হয়েছে। এখন থেকে ‘ওর’ ব্যবহারটা ভাল হবে, একা একা ঘুরবে না... চামচা-পরিবৃত থাকবে... ব্যাটার খুব শিক্ষে হয়েছে, ইত্যাদি।

একদিন সন্ধেবেলা বাজারের রাস্তার পাশে সোধিজির সঙ্গে দেখা। অফিসের সুপারভাইজর। ফিকফিক করে হাসলেন আমাকে দেখে। বললাম, ‘আপনি এখানে?’

‘চুপ চুপ! আমি এখন কোচিতে।’ তার মানে!

‘ট্রাভেল অ্যালাওয়েন্স নিয়ে আমি এখন কোচিতে। গত কাল টেলিগ্রাম পৌঁছে গিয়েছে...’ এক বার চার দিক দেখে নিয়ে, ফের বলা শুরু করলেন: ‘এই কোম্পানির নিয়ম, বছরে এক বার ভারতের যে কোনও জায়গায় যেতে পারো। আপ-ডাউন ট্রেন ফেয়ার পাবে। শুধু পৌঁছনোর খবরটা অফিসে পাঠাতে হবে।’ আমি হাঁ করে শুনছি। ‘কোচিতে এক জনকে ঠিক করা আছে। তিরিশ টাকা মানি অর্ডার পাঠালে ‘রিচ্‌ড সেফলি’ টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দেন, ব্যস। দেখছ না, এই কোম্পানির সবাই কোচিতে যায়! যাকগে, তুমি যেন অফিসের কাউকে বোলো না আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তুমিও কোচি ঘুরে এসো। ঠিকানা দিয়ে দেব।’ বলেই ফের ফিকফিক হেসে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন।

তপন চক্রবর্তী পর্ণশ্রী, বেহালা

tchakrabarti@gmail.com

যেখানেই কাজ করুন, ব্যাংক, রেস্তরাঁ, আইটি, অন্য কোথাও— আপনার অফিসের পরিবেশ পিএনপিসি হুল্লোড় কোঁদল বস কলিগ ছাদ ক্যান্টিন— সব কিছু নিয়ে ৭০০ শব্দ লিখে পাঠান।
ঠিকানা: অফিসফিস, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy