Advertisement
E-Paper

তাঁরা সবাই তখনও নেতাজিময়

বাংলায় টেলিভিশনের সূত্রপাতের সময় থেকেই নেতাজিকে নিয়ে অসংখ্য অনুষ্ঠান, তথ্যচিত্র করেছি। অনুষ্ঠানে পেয়েছি আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্যদের; একেবারে ছোটদের নিয়ে নেতাজি যে ‘বালসেনা’ গড়েছিলেন তার সদস্যদের; জনা পঁয়তাল্লিশ কিশোর নিয়ে গড়েছিলেন এক বাহিনী— বলা হত ‘নেতাজি’স ক্যাডেট্‌স’— তাঁদের মধ্যে যে বাঙালি সদস্য ছিলেন, তাঁকে।

পঙ্কজ সাহা

শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০০
আজাদ হিন্দ ফৌজ-এর ‘রানি অব ঝাঁসি রেজিমেন্ট’-এর গার্ড অব অনার নিচ্ছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।

আজাদ হিন্দ ফৌজ-এর ‘রানি অব ঝাঁসি রেজিমেন্ট’-এর গার্ড অব অনার নিচ্ছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।

বাংলায় টেলিভিশনের সূত্রপাতের সময় থেকেই নেতাজিকে নিয়ে অসংখ্য অনুষ্ঠান, তথ্যচিত্র করেছি। অনুষ্ঠানে পেয়েছি আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্যদের; একেবারে ছোটদের নিয়ে নেতাজি যে ‘বালসেনা’ গড়েছিলেন তার সদস্যদের; জনা পঁয়তাল্লিশ কিশোর নিয়ে গড়েছিলেন এক বাহিনী— বলা হত ‘নেতাজি’স ক্যাডেট্‌স’— তাঁদের মধ্যে যে বাঙালি সদস্য ছিলেন, তাঁকে। আজাদ হিন্দ ফৌজের বেতার সম্প্রচারের সঙ্গে যুক্ত অজয় দাস জানিয়েছিলেন নানা অজানা তথ্য। প্রথম বছর, ফিল্মে ধরে রাখা নেতাজির বিভিন্ন সময়ের ভাষণ, আর আজাদ হিন্দ ফৌজের নানা কর্মধারার অংশ ব্যবহার করে তথ্যচিত্র তৈরি করি। সেই থেকে টিভিতে নেতাজিকে নিয়ে তথ্যচিত্র, অনুষ্ঠানের একটা ধারা তৈরি হয়ে গেল।

নেতাজির পরিবারের সদস্য ড. শিশির কুমার বসু, কৃষ্ণা বসু, ললিতা বসু, চিত্রা ঘোষ, পরের প্রজন্মের সুগত বসু, আশিস রায় এবং অন্যরা নেতাজিকে নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। ‘আজও এক অগ্নিশিখা’ তথ্যচিত্রটি নির্মাণের সময় এডিটিং-এ সুগত বসু তো আমাদের সঙ্গে সারা রাত জেগেছেন। শিশির বসু এক অনুষ্ঠানে সবিস্তারে জানিয়েছিলেন, নেতাজির গোপনে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় কেমন ভাবে তিনি গাড়ি চালিয়ে নেতাজিকে পার করে দেন, যাতে নেতাজি গোমো স্টেশন থেকে ট্রেন ধরতে পারেন। গাড়িতে ছদ্মবেশী নেতাজি, কেউ গাড়ি থামালে কী করা হবে তার পূর্ব পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু নির্বিঘ্নেই মহানিষ্ক্রমণ পর্ব সম্পন্ন হয়েছিল।

মহিলাদের নিয়ে নেতাজি গড়েছিলেন ‘রানি অব ঝাঁসি রেজিমেন্ট’। প্রধানের দায়িত্ব দিলেন বীরাঙ্গনা লক্ষ্মী স্বামীনাথনকে। তাঁর সঙ্গে অনেক বার দেখা হয়েছে আমার। তিনি তখন লক্ষ্মী সেহগল। তিনি বলেছিলেন, কী ভাবে নেতাজির ফৌজে যোগ দিয়ে তাঁর লম্বা চুল কেটে ফেলে, সামরিক উর্দি পরলেন। এক বার একটা অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে কৃষ্ণা বসু তাঁর পনেরো মিনিটের একটা সাক্ষাৎকার নেবেন ঠিক হল। কিন্তু রেকর্ডিং শুরু হতে এমন সব আশ্চর্য তথ্য তিনি জানাতে থাকলেন, শেষে চল্লিশ মিনিটের পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার হিসেবে এটি প্রচারিত হয়।

জানকী অতিনাহাপ্পান জানিয়েছিলেন, কুয়ালা লামপুরে নেতাজির ভাষণ শুনে তিনি কানের দুল খুলে দিয়েছিলেন নেতাজির হাতে। জানিয়েছিলেন, রেঙ্গুন থেকে পায়ে হেঁটে নেতাজির সঙ্গে রিট্রিট করে আসার সেই দীর্ঘ পথের কষ্ট ও শৌর্যের কথা। জার্মানির কীল বন্দর থেকে এক ঐতিহাসিক সাবমেরিন-যাত্রায় নেতাজির সঙ্গী ছিলেন আবিদ হাসান। তিনি জানিয়েছিলেন, বিপজ্জনক যাত্রাপথে সারা ক্ষণ নেতাজি কেমন অকুতোভয় ছিলেন, কেমন ভাবে ভারত মহাসাগরে তাঁরা সাবমেরিন বদলে জাপানি সাবমেরিনে ওঠেন। এক বার একটি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ সেই সাবমেরিনটিকে দেখতে পেয়ে চার্জ করে। সাবমেরিনটিকে ইমার্জেন্সি ডুব দিতে হয় সমুদ্রের গভীরে। তখনও নেতাজি অবিচল। এঁদের সকলের সঙ্গে মিশে মনে হত, তাঁরা যেন নেতাজিময় হয়ে আছেন। যদি কোনও ইঙ্গিত আসে, তা হলে এক্ষুনি তাঁরা ‘সুভাষজি সুভাষজি’ গাইতে গাইতে প্রাণ দিতে প্রস্তুত।

আজাদ হিন্দ বাহিনীর সংগীত ছিল প্রেরণা আর উদ্দীপনার এক বড় উৎস। ক্যাপ্টেন রাম সিংহ গানগুলোতে সুরারোপ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, অনেক ক্ষেত্রে তখনকার জনপ্রিয় ফিল্মি গানের সুরকে ভেঙেও তিনি ব্যবহার করেছিলেন। এক বার আমাদের জাতীয় কার্যক্রমে ‘আইএনএ সংস’ নামে অনুষ্ঠানের জন্যে ক্যাপ্টেন রাম সিংহ এবং কর্নেল জি এস ধীলোঁকে স্টুডিয়োতে নিয়ে এলাম। দুজনে মুখোমুখি বসে স্মৃতিচারণ করতে করতে গানগুলো গেয়ে শোনাবেন ক্যাপ্টেন, এ রকম ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বললেন, কর্নেল তাঁর চেয়ে উচ্চপদাধিকারী, তিনি তাঁর সামনে বসতে পারবেন না। তখন দাঁড়ানোর জায়গা দেওয়া হল ক্যাপ্টেনকে। কর্নেল ধীলোঁ চেয়ারে বসে তাঁদের যুদ্ধকালীন অনেক স্মৃতি উসকে দিতে লাগলেন। আর নেতাজির উপহার দেওয়া বেহালাটি বাজিয়ে, আইএনএ অর্কেস্ট্রার সহশিল্পীদের যন্ত্রসংগীতের সঙ্গে, ক্যাপ্টেন রাম সিংহ আবেগমথিত কণ্ঠে গাইতে লাগলেন ‘কদম কদম বঢ়ায়ে যা’, ‘সুভাষজি সুভাষজি উয়ো জান-এ-হিন্দ আ গয়ে’, ‘সব সে উঁচা হ্যায় ঝান্ডা হমারা’। গান শুনতে শুনতে আবেগে উদ্দীপ্ত কর্নেল ধীলোঁ লাইটিং-এর ব্যবস্থা, মাইকের পজিশন, সব ভুলে গিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর লেখা নেতাজি-বন্দনার কবিতা উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করতে লাগলেন, আর তারই সঙ্গতে রাম সিংহ গেয়ে উঠলেন জনগণমন-র সুরে ‘শুভ সুখ চৈন কি বরখা বরসে’। এক আশ্চর্য মুহূর্ত তৈরি হল। নেতাজি জনগণমন’কেই আজাদ হিন্দ সরকারের জাতীয় সংগীত করেছিলেন, আর এই গানকে অবলম্বন করে রাম সিংহ তৈরি করেছিলেন তাঁদের ‘কৌমি তারানা’: শুভ সুখ চৈন কি বরখা বরসে।

pankajsaha.kolkata@gmail.com

doordarshan pankaj saha
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy