Advertisement
E-Paper

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৬ ০০:০৩

গ রিব মানুষরা চিরদিনই চায় ধনী হতে। কিন্তু ধনীরা কখনওই গরিব হতে চায় না। অথচ এ কালের দাবি একটু অন্য রকম। বড়লোকেরা গরিব হতে না চাইলেও, গরিব সেজে থাকতে চাইছে। তাই তারা প্রচুর দাম দিয়ে ছেঁড়া-ফাটা, রংচটা জামা-প্যান্ট কিনে পরছে। প্যান্টের ফুটো দিয়ে হাঁটু বেরিয়ে থাকবে, এটাই আধুনিকতম ফ্যাশন। ছেঁড়া, তাপ্পি, সেলাইয়ের দাগ প্যান্টটার গায়ে দগদগ না করলে, যথেষ্ট ফ্যাশনদুরস্ত হওয়া অসম্ভব। তকতকে ইস্তিরি করা পরিচ্ছন্ন জামাকাপড় পরে শুধু সেকেলেরা। এ দিকে কাপড় কোম্পানিগুলির দাবি, নিখুঁত নতুন জামাকে ছেঁড়া ও রংচটা করতে খরচ বেশি পড়ে। তাই একটি ইন্টারন্যাশনাল জামাকাপড়ের কোম্পানি এই বার ভারতের বাজারে অভিনব এক কৌশলের কথা জানাল। কাল এক প্রেস কনফারেন্সে কোম্পানির সিইও জানালেন, এ বার থেকে তাঁরা ভিখারিদের কাছ থেকে তাদের ব্যবহার করা শতচ্ছিন্ন, রংজ্বলা, মলিন জামা-প্যান্ট সংগ্রহ করবেন এবং তার বদলে তাদের একদম ব্র্যান্ড নিউ নিখুঁত জামা দেওয়া হবে। এর পর ভিখারিদের কাছ থেকে নেওয়া জামাগুলো ধুয়ে, জীবাণুমুক্ত করে বিক্রির জন্য বাজারে আনা হবে। আবার ক’বছর পর যখন গরিব মানুষদের দেওয়া নতুন জামা পুরনো হয়ে ছিঁড়ে যাবে, তখন সেগুলো ফেরত নিয়ে আবার তাঁদের নতুন ব্র্যান্ডেড জামা পরতে দেওয়া হবে। এ ভাবে চললে ফ্যাশনেব্‌ল জামা বানাতে খরচ কম পড়বে, গরিবদের উপকারও করা হবে। আরও সুবিধে আছে। নতুন জামাকে ‘ব্যবহৃত’ দেখাতে চাইলে কৃত্রিমতা ধরা পড়ে যায়। কিন্তু নতুন ব্যবস্থায় ন্যাচারাল ‘রদ্দি’ লুক’টা আসবে। এ ছাড়া, ভিখারিদের কাছ থেকে জামা কালেকশনের জন্য প্রচুর এজেন্ট নিয়োগ করা হবে, এতে চাকরির সুযোগ বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী টুইট করেছেন, ‘এ বার ভারত হবে একমাত্র দেশ যেখানে অসম্ভব ফ্যাশনদুরস্ত ভিখিরিরা রাস্তায় ঝলমল করবে।’

সুজন কুমার দাস, মাস্টারপাড়া, জিয়াগঞ্জ

লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা:
টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

সুইচ টিপতেই অটোমেটিক আনন্দ

সা লটা ১৯৭৮। স্কুলে পড়ি। স্কুলব্যাগ জলের বোতলহীন, আর টিফিন বক্স ভরা থাকত রুটি-তরকারি বা পাঁউরুটিতে। গ্রীষ্ম-বর্ষার জন্য লম্বা হাতলওলা একটা কালো ছাতা ছিল। শুধু আমি নই, স্কুলের সব মেয়েদের। সেই লম্বা ছাতা স্কুলব্যাগের সঙ্গে নিতে অসুবিধে বলে কখনওই মনে হয়নি। ছাতা যে শুধু মাথা ঢাকত তা নয়। বয়স্কদের লাঠিরও কাজ করত, আঁকশি হিসেবেও ব্যবহৃত হত মাঝেমধ্যে। আর ছাতার পিটুনি খায়নি, এমন ছেলে তো পাড়ায় হাতে গোনা। তখন রঙিন লেডিস ছাতাও পাওয়া যেত, কিন্তু তা শুধু কলেজ-পড়ুয়া ছোটপিসি, মানে ওই বয়সি মেয়েদের হাতে। ও রকম ছাতার শখ আমিও বহু বার মুখ ফুটে জানিয়েছি, লাভ হয়নি। আমাদের ছোটবেলায় বাচ্চাদের সমস্ত আবদারই অন্যায় বলে মনে করা হত।

ওই বছরেই দাদা ওর বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গেল দার্জিলিং। মিরিক ঘুরতে গিয়ে কী ভাবে নেপালের বর্ডার পার হয়েছিল, ফিরে তার বর্ণনা দিচ্ছিল। তার পর ওর সুটকেস খুলে পশুপতিনগর মার্কেট থেকে কিনে আনা গুপ্তধনগুলো একে একে বার করতে লাগল। উইংসাং পেন। ব্ল্যাংক ক্যাসেট। মাউথ অর্গান। ওয়াকম্যান। সব শেষে বেরল সবচেয়ে দুর্দান্ত জিনিসটা। একটা সুইচ-টেপা, অটোমেটিক, ফোল্ডিং ছাতা। ‘মেড ইন চায়না’ লেখা কোনও জিনিস সেই প্রথম দেখা।

মাউথ অর্গানটা দাদা নিজের জন্য কিনেছে। ভাই তো সেই মুহূর্তেই গলার জোরে ওয়াকম্যানের মালিক হয়ে গেল। ক্যাসেটটা বাবার, জানা কথা। বাবা গিটার বাজাতেন, মনের সুখে ব্ল্যাংক ক্যাসেটে রেকর্ড করতে পারবেন। বাকি রইল পেন আর ছাতা। লাল-হলুদ-সবুজ মেশানো ছাতাটা নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। সবারই আক্ষেপ, ইস, আরও দুটো তো আনবি অন্তত। ছাতা কাজের জিনিস, পড়ে থাকত না। ছাতার দাবিদার অনেক।

আমি সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে আছি, যদিও পাল্লা ভারী ছোটপিসির দিকেই। কিন্তু বাবা-ই সমস্যার সমাধান করে দিলেন। ছোটপিসির তো রঙিন ছাতা আছেই। তাই এ বার ও পেল উইংসাং পেন। আর ছাতা? আমি! অ্যাদ্দিন লেডিস ছাতা না-পাওয়াটাকে দুর্ভাগ্য বলে মনে হত। এখন আশীর্বাদ বলে মনে হচ্ছিল।

‘শ্রী ৪২০’ ছবির আইকনিক দৃশ্য। নার্গিস-রাজ কপূর, বৃষ্টি, আর ছাতা। এ ছবিটা যদিও ১৯৫৫-র,
সত্তরের দশকে হলে নির্ঘাত সুইচ-টেপা চাইনিজ ফোল্ডিং ছাতা থাকত ওঁদের হাতে।

ছাতা হাতে পেলাম ঠিকই, কিন্তু স্কুলে নিয়ে যাওয়ার পারমিশন পেলাম না। ছাতা পথে নিয়ে বেরিয়েও হারায়নি, এমন মানুষ আছে নাকি? কিন্তু মুশকিল হল, ছাতাটার কথা সব বন্ধুদের বলা হয়ে গেছে। এমন আশ্চর্য ছাতা তারা নিজের চোখে দেখে, হাতে ছুঁয়ে পরখ করতে চায়। না দেখাতে পারলে আমাকে মিথ্যুক ভাববে। অনেক বলেকয়ে বাবার কাছ থেকে ছাতাটা স্কুলে নিয়ে যাওয়ার ছাড়পত্র মিলল।

স্কুলে গিয়ে তো হুলুস্থুল! ক্লাসে আমার খাতিরই বেড়ে গেল। শুধু ক্লাসে কেন, ছাতার কল্যাণে ক’দিনের মধ্যেই সারা স্কুলে আমি পরিচিত হয়ে গেলাম। এক দিন ডাক পড়ল টিচার্স রুমেও। আমার হাতে যেন সাত রাজার ধন এক মানিক! পাড়াতেও সবার কৌতূহল, কারও চোখে ঈর্ষার ঝলকও দেখতাম। বন্ধুর বাড়িতে যাওয়ার থাকলে সে আগেই বলে দিত, অ্যাই, ছাতাটা সঙ্গে নিয়ে যাবি কিন্তু, সবাইকে দেখাব! ছাতা হাতে নিয়ে একটাই কথা সবাই বলত, এত কায়দার ছাতা, টিকবে তো? তখন তো ‘ইউজ অ্যান্ড থ্রো’ কথাটা জানতাম না!

আমার এক বন্ধু তো সদর্পে ঘোষণাই করে বসল, এ বারের গরমের ছুটিতে ওরা দার্জিলিং যাবে, সেখান থেকে মিরিক হয়ে পশুপতিনগর মার্কেট। যত না ঘুরতে যাওয়া, তারও বেশি ‘মেড ইন চায়না’ জিনিসপত্র কিনতে। ব্যস, শোনামাত্র কয়েক জনের অনুরোধ, ছাতা এনে দিতে হবে। এত ছাতা আনা সম্ভব না, জানিয়েও কাজ হল না। বন্ধুবিচ্ছেদের ভয়ও তো আছে। এক জন আবার জোর দিয়ে বলল, সামনেই আমার দিদির বিয়ে। মা বলে দিয়েছে, ওই রকম ছাতা তত্ত্বে দেওয়া হবে। আর কারও জন্যে আনিস না আনিস, আমার জন্যে অবশ্যই আনবি!

ছুটি পড়ে গিয়েছিল, তাই আর বন্ধুর ছাতা দেখা হয়নি। স্কুল খোলামাত্র সব্বাই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম ওর কাছে। ছলছল চোখে সে জানাল, অনেকগুলো ছাতাই কিনেছিল, সঙ্গে আরও অনেক জিনিস। কিন্তু গেটে ব্যাগ সার্চ করার ফলে সব দিয়ে দিতে হয়েছে। শুনে সবাই এমন হা-হুতাশ করতে লাগল, যেন প্রিয়জনের দুর্ঘটনা ঘটেছে।

কয়েক মাস পরেই আমাদের ইতিহাসের দিদিমণির হাতে দেখি আমার মতন ছাতা! আমার না ওঁর, কার ছাতাটা বেশি ভাল, সে নিয়ে তুলনামূলক আলোচনাও কানে এল। আরও কিছু দিন যেতে দেখি, স্কুলের দুই সিনিয়র দিদির হাতেও ওই ছাতা। এমনকী আমার পিসতুতো দিদিও এক দিন অবিকল ওই ছাতা নিয়ে হাজির। মুচকি হেসে জানাল, কলকাতায় চাইলে বাঘের দুধও মেলে, ছাতা তো কোন ছার। দিন যায়। বুঝতে পারি, আগের মতো কেউ আর বিশেষ দৃষ্টিতে আমার ছাতার দিকে তাকাচ্ছে না। ছাতাটাও কেমন যেন মলিন ঠেকে।

হঠাৎ এক দিন, স্কুল থেকে ফেরার পথে, ছাতা ফোটাতে গিয়ে সেটা আর খুলল না। সবার হাতে হাতে ঘুরল, সুইচের ওপর নানান কেরামতি প্রয়োগ করা হল। কিন্তু তবু খুলল না। অ্যাদ্দিন যাদের চোখে ছিল ঈর্ষার নজর, আজ দেখি স্পষ্ট করুণা।

বাবা এক ছাতা-সারাইওলাকে ডাকলেন। ছাতাওলা ছাতা নেড়েচেড়ে গম্ভীর মুখে জানাল, এর যন্ত্রপাতি আলাদা, ওর কাছে নেই। আর ও একেবারে নিশ্চিত, সেগুলো পাওয়াও যাবে না।

এ বার আর কালো ছাতা না। ছোটপিসির রঙিন লেডিস ছাতাটাই আমি পেয়ে গেছি, কারণ ও এরই মধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে মেট্রো গলি গিয়ে অটোমেটিক ছাতা কিনে এনেছে। ক’দিন পরেই দেখি, বাজারে ভ্যারাইটি স্টোরে ঝুলছে অটোমেটিক ফোল্ডিং ছাতা। আর কী আশ্চর্য, ভেতরের শো-কেসে সব ‘মেড ইন চায়না’র জিনিস!

মধুমিতা ঘোষ, ডিভিসি, এমটিপিএস, বাঁকুড়া

madhumita294@gmail.com

সৎতরের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 70’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy