ছো টবেলা থেকে বুক ঢিপঢিপ আমার চিরসঙ্গী। এই রে, খেলতে গিয়ে দেরি হল, এ বার মা বকবে। ওই যাহ্! আজ ক্লাসে অঙ্ক খাতা আনতে ভুলে গিয়েছি, এ বার জব্বর বকুনি কিংবা প্রচণ্ড শাস্তি। বন্ধুদের সামনে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক, তারা আবার ফিকফিক। এখানেই কি শেষ! বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে ভাল মেয়ে হয়ে ওঠার বাঁশ। মনে প্রেম পেলে চলবে না, কারণ প্রেম করা খারাপ। মা অসম্ভব বকবে। বেচাল হলে তো কথাই নেই।
অতএব ছোট থেকেই যথাযথ’র মাপকাঠি থেকে এক চিলতে পিছলে গেছ কী ভয় বুমেরাং হয়ে ফিরবে, যত ক্ষণ না তোমার কৃতকর্মের একটা হেস্তনেস্ত হচ্ছে। তার সঙ্গে মধ্যবিত্তের মরাল সায়েন্সের ক্লাস চলে দিবারাত্র। তুমি ভাল মেয়ে হবে, তুমি কাউকে আঘাত দেবে না। তুমি যদি ভাল ব্যবহার না করো, তা হলে আমাদের শিক্ষা মিথ্যে হয়ে যাবে। কাঁধে যে কত বড় বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়!
এর পর কখন যে ওই ব্রতকথাগুলোই নিজের সিস্টেমে ঢুকে যায়, জানতে পারা যায় না। এবং সেই ছকে দেওয়া পথেই চলতে থাকে মেয়ে। আর ভয়, বুক ঢিপঢিপ হয়ে ওঠে তার সঙ্গী। নিজের আগে সে অন্যের কথা ভাবে।
সে যথাযথকে নিজের সঙ্গে নিয়ে ঘোরে, ফেরে, বসে, শোয়। নিজের ব্যবহারকে সর্ব ক্ষণ কাটা ছেঁড়া করে। কোথাও এক চুল মনগড়া ভুলচুক পেলেই নিজেকেই শাস্তি দেয়, বাজে কথা বলে, বকে, সমালোচনা করে, আর পরের দিনের জন্য যথাযথ’র সিলেবাস ভাল করে মুখস্থ করে নেয়।
অথচ, এই ভাল হয়ে উঠতে গিয়ে একটা সময় নজরে আসে যে সে কারও কাছেই তেমন করে পাত্তা পায় না। সবাই যেন কেমন আড়ে আড়ে চলে। কাল অবধি যারা ভারী বন্ধু ছিল, আজ তারা কেন কে জানে ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলে। আবার সে পড়ে যায় ভয়-ফেরতার মধ্যে। দোষটা তার মানে আমারই। আমি নিশ্চয়ই ঠিক করে কথা বলিনি। আমি নিশ্চয়ই খবর নিইনি। আমি নিশ্চয়ই তেমন ইন্টারেস্টিং নই। আমার ব্যবহার নিশ্চয়ই ভাল নয়। পেটের ভেতর মোচড় মারে। আমার ঠিক কোনখানটায় ভুল হয়ে যাচ্ছে, কেউ প্লিজ বলে দেবে? আমি ধোঁয়াশা নিতে পারি না। কেউ যদি বলে দেয়, আমার মধ্যে এই এই জিনিসগুলো খারাপ, তা হলে আমার স্বস্তি লাগে। কিন্তু কেউ বলে না। মুখ টিপে এড়িয়ে যায়।
কিন্তু আমি তো ওদের কিছু খারাপ করিনি। তা হলে কি কেউ বলল আমার নামে কিছু? চুকলি? কিন্তু কেনই বা বলবে? নিজেই মনকে বোঝাই, ধুর, এই সব কনস্পিরেসি থিয়োরিতে বিশ্বাস করিস না তো। তোর যত হাবিজাবি চিন্তা। লোকে তোকে এ বার বলবে, মেয়েটা এত ইনসিকিয়োর যে এই সব কথা ভাবছে। এটা কেউ বলবে না, কেন বা কোথা থেকে এই ইনসিকিয়োরিটি আসে। কেউ ভাববেও না যে তুই হারানোর ভয় থেকে, যথাযথ না হয়ে উঠতে পারার ভয় থেকে, মনকে নিয়ে এই তোলপাড়ের খেলা খেলছিস। কিন্তু খুব ভুল বলবে কি? সত্যিই তো আমি ইনসিকিয়োর। ঠিক করে যে ‘ঠিক মতো’ হয়ে উঠতে পারলাম না। আর সেই জন্যই তো এই দশা।
তবুও, এক এক সময় দম বন্ধ লাগে। যদি অন্যের চোখে ঠিকঠাক ভাল হতে না পারি, তা হলে কি সত্যিই নির্বান্ধব হয়ে যাব? আর জানলার পাশে বসে এই চিন্তা নিয়ে কাটাছেঁড়া করে আমার সময় আর কাটবে না?