Advertisement
E-Paper

রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

দাঁতের ডাক্তারকে ব্যথাময় দাঁতটির অবস্থান জানাতে গিয়ে শংকর সরকার বলেছিল, ‘আপার ব্যালকনির ডান দিকে তিনটে ছেড়ে।’ শংকর মৃণালিনী সিনেমা হলে সিট দেখানোর চাকরি করত।

শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০০

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

দাঁতের ডাক্তারকে ব্যথাময় দাঁতটির অবস্থান জানাতে গিয়ে শংকর সরকার বলেছিল, ‘আপার ব্যালকনির ডান দিকে তিনটে ছেড়ে।’ শংকর মৃণালিনী সিনেমা হলে সিট দেখানোর চাকরি করত। কবিতাপাঠের সভাতে ও বলত, ‘শো চলাকালীন যাওয়া-আসা করবেন না।’ শংকর কবি সম্মেলনও বসাত— একটা লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিল কিনা। কবি-সভায় মোবাইল বেজে উঠলে ও বলত, ‘বাচ্চা কেঁদে উঠলে দয়া করে বাইরে যান।’ সিনেমা হলে যেমন বলতে হয়। মৃণালিনী হলটা উঠে গেল। কিন্তু নামটা রয়ে গেল বাস কন্ডাক্টরদের মুখে। সামনে দিয়ে যাবার সময় ‘মৃণালিনী মৃণালিনী’ হাঁকে।

হলটা উঠে যাওয়ার পর শংকর উলটো দিকের ফুটপাতে ছোট্ট একটা পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান দিল। টিনের পাতে সাইনবোর্ড— ‘অতএব’। নামটা শুনে মনে হতে পারে চাকরি নেই, তাই, অগত্যা এই পান-দোকান। তা নয়। ওর পত্রিকাটার নাম ‘অতএব’। বলেছিল, মৃণালিনীকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য বাস কন্ডাক্টর আছে, কিন্তু পত্রিকাটার জন্য তো আমি ছাড়া কেউ নেই। পানের দোকানেই পত্রিকার নামটাকে বাঁচিয়ে রাখলাম।

সামান্য চাকরি করে স্ত্রী-সন্তানকে কষ্টে ফেলে ও দীর্ঘ দিন ধরে পত্রিকাটা চালিয়েছিল। বেশ উন্নত মানের পত্রিকা। গল্প-কবিতা ছাড়াও ভাল মানের প্রবন্ধও ছাপত। ‘তন্ত্র ও তান্ত্রিকতা’ থেকে ‘যন্ত্র ও যান্ত্রিকতা’। রবীন্দ্রনাথের নস্য চলত কি না, সিন্ধু সভ্যতায় রবিশস্য ফলত কি না, এ রকম নানাবিধ কূট প্রবন্ধ ছাপত। মাঝে মাঝে বলত, সামনের সংখ্যায় জগদীশ গুপ্তকে একটু টর্চ ফেলব। সিট দেখাতে টর্চ ফেলতে হত যে। ওর অগামগা ব্যাক্তিত্ব নিয়ে কী করে আগা-বাঘাদের থেকে লেখা বাগাত সেটা রহস্যই। বছরে দু’-তিনটে সংখ্যা বের করত। দুটো বিজ্ঞাপন নিয়মিতই থাকত। ‘সারস্বত সমাজকে বিনম্র প্রণতি জানায় গণা ঘোষ’ আর ‘ছোট ছোট প্লটে ছোট জমি, দামটাও বেশ কম। যোগাযোগ: হাবুলেশ্বর মণ্ডল।’ বোঝাই যাচ্ছে, শংকরই লিখে দিয়েছে। শংকরের কল্যাণে এদের চিনতাম। গণা ঘোষ সিনেমা লাইনেরই লোক। টিকিট ব্ল্যাক করত। আর হাবুল ওর নামের সঙ্গে ঈশ্বর যুক্ত করেছিল বন্ধ সাবান কারখানার জমিটা হাতিয়ে নেবার পর। শংকর ওদের থেকে এই মহৎ কাজের জন্য বিজ্ঞাপন তোলাবাজি করত। শুধু কবিতার জন্য এই খেলা।

সিনেমা হলটা বন্ধ হবার পর গণা ঘোষ সিনেমাচ্যুত হল। হাবুলের সব প্লট বিক্রি হয়ে যায়, অতএব আর বিজ্ঞাপন পেত না শংকর, তবুও নিজের সামান্য উপার্জনেই পত্রিকা চালাতে লাগল। কিছু দিন পর, রাস্তা চওড়া করার কারণে ওই পান-দোকানটা ভাঙা পড়ল। ‘অতএব’ উঠে গেল। শংকরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।

বহু দিন পরে ওকে আবিষ্কার করলাম পুরীর সমুদ্র সৈকতে। ও জানাল, পুরীতেই ছোট্ট একটা গেস্ট হাউসে ম্যানেজারি করছে। মেয়ের একটা বিয়ে দিতে পেরেছে, ঘরের চালটা আজও টালিরই রয়ে গেছে। স্ত্রী পুরীতেই থাকে বেশির ভাগ। এবং জানাল, পত্রিকাটা বেঁচে উঠেছে আবার। এখন ওড়িয়া ভাষায়। ‘অতএব’ শব্দটি ওড়িয়াতেও একই অর্থ বহন করে। শংকরের সঙ্গী এক জন তখন চিনেবাদামের খোসা ছাড়াচ্ছিল। একমুঠো বাদাম নিয়ে ওড়িয়াতে যা বলল তার অর্থ দাঁড়ায়— ‘এত দিন বন্দি ছিলে হে শিশুগণ, তোমাদের কয়েদির পোশাক ছাড়িয়ে দিলাম। হে বাতাস, নিয়ে যাও।’ বোঝাই যাচ্ছে, কবি।

শংকর জানাল, ও পত্রিকাটা চালাচ্ছে, কিন্তু একটি সুরা বিপণির মালিককে সম্পাদক করা হয়েছে। বাংলায় ‘সুরা’ শব্দটির প্রতিশব্দ হল ‘কারণ’। সুরার কারণেই অনেক কবি-লেখকের সঙ্গে সম্পাদকের যোগাযোগ আছে। ওড়িয়া ভাষাতেও কবি-লেখকের অভাব নেই। শংকর সম্পাদক না-ই বা থাকল নিজে, ‘অতএব’ তো বেঁচে রইল।

‘বেশ আনন্দে আছি’— ও যখন এই হর্ষ নিবেদন করছিল, আমি তখন আমার ব্যথা নিবেদন করছিলাম। ব্যথাটা ছিল, দীর্ঘ দিন কলকাতার বাইরে বদলি ছিলাম। আমার বদলির নিয়ন্ত্রক ছিলেন এক জন ওড়িয়া অফিসার। উনি কবিও বটেন। আমার অনেক আবেদন-নিবেদনেও কাজ হয়নি। শুনে শংকর বলেছিল, নামধাম দিয়ে যা, আর কী সব দরখাস্ত করেছিস, তার একটা কপি পাঠিয়ে দিস।

শংকর কিছু দিন পর ফোনে জানাল, কবিতা সব পারে। ঝোড়ো হাওয়া আর ভাঙা দরজাটা, ইডলি সম্বর আর আলুর পরোটা— সব মিলিয়ে দিতে পারে। ‘তোর অফিসারের লেখা কবিতার বইয়ের সন্ধান পেয়ে গেছি।’

শংকর আমার সেই কবি-অফিসারের একগুচ্ছ প্রেমের কবিতা আর ওঁর সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ নিয়ে উচ্ছ্বাস ছাপাতে মাস পাঁচেক সময় নিয়েছিল। সাত মাসের মাথায় আমি কলকাতা ফিরে আসার অর্ডার পেয়ে যাই।

‘শুধু কবিতার জন্য এই খেলা’— বলতেই হয় অতএব।

swapnoc@rediffmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy