Advertisement
E-Paper

শংকর মাছের চাবুক চলল

আমাদের স্কুলে ছিলেন তিন জন দাড়িওয়ালা ব্রহ্মচারী টিচার। তাঁরা নিজেদের ব্রহ্মচারী প্রমাণ করার জন্য নানা রকম কাণ্ড করতেন। কোনও দিন চাল আলু সেদ্ধ করে স্বপাক আহার। কোনও দিন, ধুতি উত্তরীয় খড়ম পরে তিন জনের বৈকালিক ভ্রমণ।

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৬ ০০:০০

আমাদের স্কুলে ছিলেন তিন জন দাড়িওয়ালা ব্রহ্মচারী টিচার। তাঁরা নিজেদের ব্রহ্মচারী প্রমাণ করার জন্য নানা রকম কাণ্ড করতেন। কোনও দিন চাল আলু সেদ্ধ করে স্বপাক আহার। কোনও দিন, ধুতি উত্তরীয় খড়ম পরে তিন জনের বৈকালিক ভ্রমণ। তাঁরা মনে মনে নিজেদের শরীরে তেজঃপ্রভা কল্পনা করে নিয়েছিলেন, ভীষণ তাচ্ছিল্য করতেন সক্কলকে। এঁদের মধ্যে, অঙ্কের হৃষীকেশবাবু ছিলেন সব থেকে হিংস্র। ছাত্রদের ওপর নানা ধরনের বেতের পরীক্ষা প্রতি দিনই করতেন। পাতলা বেত, বেঁকা কঞ্চি, তেঁতুল ছড়ি, নিম ছড়ি ইত্যাদি তাঁর খাটের নীচে মজুত থাকত। এতে হাতের সুখ করেও তৃপ্ত হতেন না। এক বার জুনপুটের মেলায় গিয়ে কিনে আনলেন শংকর মাছের লেজ। প্রায় চার ফুটের পাতলা কাঁটাওয়ালা চাবুক। আমার তখন ক্লাস এইট এবং মাস খানেক হল বোর্ডিংয়ে ভর্তি হয়েছি। বাস রাস্তা থেকে ছ’মাইল হাঁটা পথের পরে ফাঁকা মাঠের মধ্যে বোর্ডিং আর স্কুল। বাবা রেখে গেছেন মানুষ করার জন্য। হৃষিকেশবাবু ক্লাস নাইনের ওপরে পড়ান, তাই আমার ভয়ের কারণ ছিল না। যদিও ছাত্ররা উদ্বিগ্ন থাকত কবে ওই চাবুকের উদ্বোধন হবে।

আমাদের সকাল সন্ধ্যা প্রেয়ার হত। একটা বেল পড়লে খেলা বন্ধ। আধ ঘণ্টার মধ্যে পুকুরে হাত-পা ধুয়ে বোর্ডিঙে ফিরে প্রেয়ারে যেতে হত। এক শান্ত শীতসন্ধ্যায়, প্রথম ঘণ্টা পড়ার পরে, বোর্ডিঙের গণ্ডির মধ্যে ফুটবল হাতে না নিয়ে পায়ে পায়ে গড়িয়ে নিয়ে আসছিলাম। ব্রহ্মচারী হৃষীবাবু কলাইয়ের জামবাটিতে জল ঢালা গুড়-মুড়ি খাচ্ছিলেন। আমার ‘বেআদবি’ তাঁকে শংকর মাছের চাবুক প্রয়োগে উদ্বুদ্ধ করল। তিনি আমাকে কঠোর স্বরে নিজের রুমের সামনে ডাকলেন এবং আমি কিছু বোঝার আগেই নির্মম ভাবে আমার শরীর চিত্রিত করে চললেন। প্রথমটায় অবাক হয়ে কাঁদতে অবধি ভুলে গেলাম। প্রায় ৫০ জন নানা শ্রেণির ছাত্র দাঁড়িয়ে দেখল ব্রহ্মচারীর আস্ফালন। দশ-বারো ঘা’র পর আমি পড়ে গেলাম। তিনি তখনও চিবিয়ে চিবিয়ে বলে চলেছেন, ‘ঘণ্টা বাজার পরেও খেলা!’ মিনমিন করে বলছিলাম, ‘আমি খেলিনি। হাতে আনার বদলে পায়ে গড়িয়ে আনছিলাম।’ হুংকার দিয়ে বললেন, ‘আবার মুখে মুখে কথা? কোন ক্লাসে পড়িস তুই?’ কয়েক জন বলে উঠল, ‘স্যর, এইট। নতুন এসেছে।’

তার পর নিজের মাদুরে পড়ে পড়ে মায়ের জন্য মন গুমরে উঠল। ঘরের অন্য বন্ধুরা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে চুপচাপ বসে রইল। বোধহয় বারো জন ছিলাম এক রুমে। তখন একটা মাদুর, বিছানা আর মাথার কাছে মুড়ির টিন, দুটো জামা দুটো হাফপ্যান্ট, কয়েকটা অন্তর্বাস ইত্যাদি নিয়ে ছিল আমাদের বোর্ডিং জীবন। আমি কাঁদতে লাগলাম। রাত আটটার দিকে জনা চারেক এগারো ক্লাসের দাদা এসে সারা গায়ে বোরোলিন লাগিয়ে দিল। রাতে ওঠার ক্ষমতা ছিল না, তাই প্রায় কোলে করে খেতে নিয়ে গেল। আমি বলতে থাকলাম, ‘কালকে বাড়ি যাব, আর আসব না।’

পরে শুনেছিলাম, হেডস্যর বলেছিলেন, ‘মাস্টার, ছেলেটির কাছে অন্যায় স্বীকার করো। ব্রহ্মচর্য পালন করছ, রাগ দমন করতে শেখোনি। ছেলেটি বাড়ি ফিরে গেলে তোমার খুব একটা সুনাম হবে না।’ হৃষীবাবু বুঝেছিলেন। এগারো ক্লাস অবধি তাঁর কাছে পড়েছিলাম, কিন্তু শংকর মাছের চাবুক আর দেখিনি। আমার গায়ে কখনও আর হাত তোলেননি। কেবল বেশি নরম করে কথা বললেই আমার চোয়াল শক্ত হয়ে যেত। পরে অন্য স্কুলে বদলি হতে শুনেছিলাম, তাঁর ব্রহ্মচর্যের ইতি ঘটেছে।

অসীম কুমার, মুম্বই

স্কুলের শিক্ষক/শিক্ষিকা কি নিষ্ঠুর বা উদ্ভট ছিলেন?
বিবরণ লিখে পাঠান ৪০০ শব্দে এই ঠিকানায়:
গাঁট্টা, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy