Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Authors

লেখকদের বিচিত্র অভ্যেস

লিখতে লিখতে টুকটাক মুখ চালাতেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখার কাগজ গরম না হলে লিখতে পারতেন না বিমল কর। কারও দরকার ছিল টেবিল চেয়ার, কেউ বা বিছানায় আধশোয়া, কোলে বালিশ। কারও কঠিন রুটিন, কারও একটু আলসেমি না হলে চলে না। নির্দিষ্ট কোম্পানির কাগজ-কালি না হলে কলমই সরত না অনেকের। রাত আটটার মধ্যে খাওয়াদাওয়া সেরে ফের রাত এগারোটা পর্যন্ত লেখাপড়া, নিজের কাজ— প্রতিভার সঙ্গে হয়তো এমন রুটিনও রবীন্দ্রনাথের মতো এক নিখাদ ‘এনসাইক্লোপিডিক জিনিয়াস’-কে তৈরি করেছিল।

অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

রান্নাঘরে ডাল চাপিয়েছেন প্র.ব। পিঠে এক ঢাল চুল খুলে ফোল্ডিং ডেস্কে লিখতে শুরু করলেন। ঠিকমতো হচ্ছে না লেখাটা। কিন্তু তা বলে কি আর কাটাকুটি করতে মন সরে। তাই ফের প্রথম থেকে গল্প লেখা শুরু। কন্যা মীনাক্ষীদেবী জানিয়েছিলেন, মায়ের আলমারিতে এমন অনেক না-হওয়া গল্পের পাতা জমে যায়। আবার সত্তরের দশকে, সে সময় কলকাতা শহরে বিদ্যুৎ বিভ্রাট এক নিত্যকার সমস্যা। সেই সময়ে গুনে গুনে মোট ২১টি মোমবাতি জ্বালিয়ে লেখালিখি করেছেন প্রতিভা বসু।

মোমবাতিরও তো এক রকম ওম আছে। সাধের লেখার প্যাডে হয়তো বা সেই ওমটুকুরই সন্ধান করতেন বিমল কর। তাই শীত নামলেই পাইকপাড়ার ঘরে রোদ-বারান্দায় টেবিলে লিখতে বসতেন তিনি। তবে লেখার আগে স্ত্রী গীতাদেবীকে অনুরোধ, ‘...লেখার প্যাডটা একটু সেঁকে দাও না!’ অমনি রান্নাঘরে আগুনের উপরে প্যাডটা ধরে কায়দা করে মোচড় দিতেন গীতাদেবী। উষ্ণ পাতা পেয়ে খুশি হয়ে লেখকের প্রতিক্রিয়া, ‘এই বার কালিটা ভাল সরবে।’ লেখা সরতে শুরু করত ঠিকই। তবে সে লেখা পুজোর মরসুমে হলে, লেখা শুরুর আগে একটি নতুন কলম কেনা চাই-ই তাঁর। তার পরে, নির্দিষ্ট কোম্পানির কাগজে লাল, কালো, নীল, সবুজ আখরে ফুটে উঠত নতুন গল্প, উপন্যাস।

সঙ্গে লেখার টেবিলের পাশে রাখা বেতের ঝুড়িটা ভরে উঠত, না-পছন্দ, বাতিল লেখাগুলির ছেঁড়া পাতায়। মগ্ন সাহিত্যিকের আঙুলের ফাঁকে ধরা সিগারেটে তখন লম্বা ছাই। আঙুলে ছেঁকা খেলে ধ্যান ভাঙত।

২২এ পটলডাঙা স্ট্রিট বা পঞ্চাননতলায় ঢুঁ দিলেও দেখা মিলত বিমলবাবুর মতোই সিগারেট-সঙ্গতে অভ্যস্ত আরও এক জনের। তিনি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। ছেলে অরিজিৎবাবুর স্মৃতিতে রয়েছে, বিছানায় আধশোয়া হয়ে, বুকের নীচে বালিশ রেখে মঁ ব্লাঁ, পেলিকান বা শেফার্স পেনে ছোট ছোট মুক্তাক্ষরে লম্বা ফুলস্ক্যাপ সাইজের কাগজের এক পিঠে সৃষ্টিতে ব্যস্ত বাবার লিখন-ভঙ্গিমাটি। ওই ভঙ্গিমাতেই সৃষ্টি ‘উপনিবেশ’, ‘শিলালিপি’, ‘মহানন্দা’র মতো উপন্যাস। ‘হাড়’, ‘টোপ’, ‘ডিনার’-এর মতো অবিস্মরণীয় ছোটগল্প। লেখালিখিতে নারায়ণবাবুকে সঙ্গ দিয়েছে অবিরাম চা আর গোল্ড ফ্লেক।

নারায়ণবাবুর বন্ধু নরেন্দ্রনাথ মিত্রের লেখালেখি প্রধানত টেবিল-চেয়ারে। একেবারে শুরুতে ‘বাজে কাঠের তৈরি’ এক টেবিলে। মূলত পার্কার কলমে লিখতে অভ্যস্ত নরেন্দ্রনাথবাবুর লেখার সময়ের একটি অভ্যেসের কথা শুনিয়েছেন ছেলে অভিজিৎবাবু। তিনি জানান, বাবা সকাল থেকে নাগাড়ে লিখছেন। সঙ্গত দিচ্ছে দুধ-চা। হঠাৎ বাড়ির লোক দেখলেন, বেলা দশটা-সাড়ে দশটায় লেখক বেপাত্তা। আসলে ওই সময়ে লেখক বোধহয় সামান্য হলেও বিরতি নিতেন। আবার বাড়ি ফিরতেন দুপুর দেড়টা নাগাদ!

এ দিকে, রং-কালির প্রতি বেশ দুর্বলতা ছিল দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারেরও। তবে, তা আঁকার ক্ষেত্রে। গল্পটা শুনিয়েছিলেন সবিতেন্দ্রনাথ রায়। তিনি জানাচ্ছেন, দক্ষিণারঞ্জনের পূর্ণ দাস রোডের বাড়ির দেওয়ালে চুনের রঙে ফাটল ধরেছিল। সেই ফাটল দিয়ে দেওয়াল জুড়ে নকশা তৈরি করেছিলেন দক্ষিণারঞ্জন। বাড়ি চুনকাম হওয়ার সময়ে সে সব ‘দেওয়াল-চিত্র’-ও অবশ্য হারিয়ে যায়।

টালা পার্কের বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়, অর্থাৎ তারাশঙ্করের অবশ্য খানিক সাধকের ভঙ্গিমা। বাড়িতে উঁকি দিলে দেখা মিলত, আঁধার থাকতেই উঠে পড়েছেন লেখক। বাগান থেকে ফুল তুলে এনে সংক্ষিপ্ত পুজো আর গরম চায়ে চুমুক দেওয়ার পরে কাছেই ‘শৈলজা’ অর্থাৎ শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়-সাক্ষাতে চলে যান তিনি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফিরে টালা পার্কে নিজের ‘লাইব্রেরি ঘরে’র মেঝেয় ডেস্ক রেখে গদি দেওয়া আসনে বসে লেখা শুরু করতেন। লিখতে লিখতে কখনও-কখনও গড়িয়ে যেত দুপুরও। তারাশঙ্কর বসে লিখলেও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আবার পছন্দ করতেন উপুড় হয়ে লেখা। কখনও কখনও কোলের উপরে বালিশ রেখেও লিখতে দেখা গিয়েছে তাঁকে।

আর এক বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক অবশ্য লেখা নিয়ে কোনও রকম শখ-শৌখিনতার ধার ধারেননি। লিখতেন সস্তার টেবিল-চেয়ারে। টেবিল জোড়া মাসিকপত্র, বই, পাণ্ডুলিপি। লেখা আর জীবিকা তাঁকে বার বার বাধ্যবাধ্যকতায় উপনীত করেছে। তাই কখনও বলছেন, ‘আজ এখন ওষুধ খেয়ে ঘুমোলে কাল হাঁড়ি চড়বে না।’ কখনও বা লিখছেন, ‘‘প্রথমদিকে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ প্রভৃতি কয়েকটা বই লিখতে মেতে গিয়ে যখন আমি নিজেও ভুলে গিয়েছিলাম যে আমার একটা শরীর আছে এবং আমার পরিবারের মানুষরাও নিষ্ঠুর ভাবে উদাসীন হয়ে গিয়েছিলেন। তখন একদিন হঠাৎ আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। একমাস থেকে দু’-তিন মাস অন্তর এটা ঘটতে থাকে। তখন আমার বয়স ২৮/২৯, ৪/৫ বছরের প্রাণান্তকর সাহিত্যসাধনা হয়ে গেছে।’’ জীবনভর অর্থকষ্ট তাড়া করেছে মানিকবাবুকে। তাঁর সঙ্গী একটি কলম দেখলেও তা বোঝা যায়। এক বার সোয়ান কলম উপহার পান। তা দিয়ে প্রচুর লিখলে কলমের নিব-জিপ সব বেরিয়ে আসে। সুতো দিয়ে সে নিব-জিপ এঁটেই লেখা চালিয়ে যান এই কিংবদন্তি সাহিত্যিক।

লিখতে লিখতে বাহ্যজ্ঞান থাকত না প্রবোধ সান্যালেরও। মেঝেয় মাদুর বিছিয়ে মাদুরে শুয়ে লিখছেন হয়তো, আচমকা তেঁতুলেবিছের কামড় খেলেন। তার পরেও লেখা থামল না। তাঁর লেখার সময়, সকাল ন’টা থেকে বেলা একটা এবং বিকেল চারটে থেকে রাত দশটা। ছ’মাস ধরে ‘হাসুবানু’ লিখলেন। তার পরে যখন উঠে দাঁড়াতে গেলেন, পড়ে গেলেন। পা থেকে কোমর পর্যন্ত অবশ হয়ে গিয়েছে যে!

নাগাড়ে লেখা অভ্যেস ছিল আশাপূর্ণা দেবীরও। তাঁর লেখায় প্রবেশের মুহূর্তটি চমৎকার। হয়তো সদ্য রাতের রান্নাটা সেরেছেন। আঁচলে হাত মুছতে মুছতেই সটান বসে গেলেন লিখতে। বসে গেলেন বলা ভুল, উপুড় হয়ে আধশোয়া অবস্থায় ছোট্ট কাঠের ডেস্কে নিজের প্যাডে কুইঙ্ক কালিতে লেখা শুরু করতেন তিনি। পছন্দ করতেন বঙ্কিম-শরৎ-রবীন্দ্রনাথের লেখা। বার বার তাই বলেছেন: ‘‘ওঁদের প্রণাম করে লেখা শুরু করি।’’— লেখা রাতে শুরু হলেও শেষ হতে হতে দেখা যেত, রাস্তায় জল দিচ্ছেন পুরসভার কর্মীরা। সকাল হয়ে গিয়েছে।

আশাপূর্ণার প্রিয় কুইঙ্ক কালি আর এক জন বিখ্যাত বাঙালির সঙ্গেও জড়িয়ে। তিনি সত্যজিৎ রায়। নানা রকম দামি ঝরনা কলমে লিখতে অভ্যস্ত সত্যজিৎ তখন বিজ্ঞাপন সংস্থায় কর্মরত। সে সময়ে এই কালির বিজ্ঞাপন দিতে গিয়ে দু’জন বাঙালির ছবি আঁকেন তিনি, বিভূতিভূষণ ও রাজশেখর বসুর।

লেখার সঙ্গে বোধহয় খাবারের একটা যোগও আছে। আর তাই বাড়িতে থাকলে কিরীটী-জনক নীহাররঞ্জন গুপ্ত লিখতেন দুপুরে। তাঁর উল্কাবাড়ির মেজেনাইন ফ্লোরে এক চিলতে একটা ঘর ছিল। দুপুরে খাওয়ার পর ঘুমোতেন না। ওটাই তাঁর লেখার সময়। লিখতে লিখতে অবিরাম চা, আর উঠে বয়াম খুলে হালকা কিছু মুখে দেওয়ার অভ্যেস ছিল শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়েরও।

এ দিকে, বুদ্ধদেব বসু দু’টি বোতল নিয়ে খুবই শশব্যস্ত থাকতেন। বোতলবন্দি তরলটি ফুরিয়ে বা নষ্ট হয়ে যায়, এই আশঙ্কায়। বোতল দু’টির নেপথ্যে একটি গল্প আছে। শিবনারায়ণ রায় এক বার অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে বোতল দু’টি সংগ্রহ করেন। এয়ারপোর্টে বিস্তর হ্যাপা। শেষমেশ, নিরাপত্তা আধিকারিকদের বোঝানো গেল, এ সুরার বোতল নয়। কালির বোতল! তা-ই দিলেন বুদ্ধদেবকে। এই কালো কালির বোতল দু’টি নিয়েই শশব্যস্ত থাকতেন প্রধানত শেফার্স কলমে লিখতে অভ্যস্ত বুদ্ধদেব।

বুদ্ধদেবের মতোই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়েরও পছন্দ কালো কালি। তিনি এক সাক্ষাৎকারেই তা জানিয়েছেন। পাশাপাশি, এ-ও জানান, তাঁর অনেক কালের অভ্যেস ছিল মেট্রো সিনেমার লাগোয়া একটি ছোট্ট দোকান থেকেই নানা রকম পুরনো, মঁ ব্লাঁ-পার্কারের মতো নামী কোম্পানির কলম কেনার। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দামি কলমের নেশা ছিল না তেমন। তবে দামি কাগজে লিখতে পছন্দ করতেন। যদিও অবচেতনে কলমের সঙ্গেও তাঁর নিবিড় যোগ। তাই, এক বার নাকি এক আসরে হাতের সায়মা ঘড়িটা খোয়া যায়। কিন্তু থানায় রিপোর্ট লেখানোর সময়ে ঘড়ির ব্র্যান্ড বলতে গিয়ে বলে চললেন, ‘শেফার্স...পাইলট... পার্কার...!’

আসলে কলমের সঙ্গে লেখকদের যেন প্রিয়ার সম্পর্ক। সেই প্রিয়ার অভিমানের সন্ধান দিয়েছেন বিভূতিভূষণ। ‘পথের পাঁচালী’ তিনি লিখতে শুরু করেন পাইলট কলমে। কিন্তু হঠাৎই ছন্দপতন... উপন্যাসটি শেষ করলেন সদ্য কেনা পার্কার দিয়ে। এর ফলে পাইলট-প্রিয়া অভিমান করে বসল! নিজের ডায়েরিতে উপন্যাসের প্রসঙ্গটি অবশ্য লিখলেন ওই পাইলট দিয়েই। শেষে লিখলেন, ‘এই কথাগুলো লিখলুম আমার পুরনো কলমটা দিয়ে। যেটা দিয়ে বইখানা লেখার শুরু। শেষ দিকটাতে পার্কার ফাউন্টেন পেন কিনে নতুনের মোহে একে অনাদর করেছিলুম। ওর অভিমান আজ আর থাকতে দিলুম না।’

নানা রকম সব অভ্যেস ছিল বিলিতি লেখকদেরও। প্রথমেই ভিক্টর হুগোর কথা। প্রতিদিন সকালে তাঁর নিবাসের কাছাকাছি একটি দুর্গ থেকে তোপধ্বনি হত। জানান দিত, ভোর হয়েছে। তা শুনে উঠে পড়তেন লেখক। নিজেই কফি তৈরি করতেন। আর প্রতিদিন দরজার কাছে পড়ে থাকা প্রিয়া ‘জোজো’-র (জুলিয়েট ড্রোয়েট) চিঠিটি সংগ্রহ করতেন। এর পরে দু’টি কাঁচা ডিম খেয়ে বেলা এগারোটা পর্যন্ত একটি আয়নার সামনে থাকা ছোট্ট ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে চলত লেখালিখি!

সকালে লেখার অভ্যেস ছিল আর্নেস্ট হেমিংওয়েরও। কিন্তু তাঁর বিষয়টা খানিক দার্শনিক। ১৯৫৮-য় জর্জ প্লিম্পটনকে ‘দ্য প্যারিস রিভিউ’-তে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানাচ্ছেন, সকালে লেখাটাই তিনি পছন্দ করেন। কারণ, সকালে কেউ বিরক্ত করার মতো থাকে না। তা ছাড়া, চারদিকে একটা শীতল-পরশ থাকে। লিখতে লিখতে তিনি তেতে ওঠেন। একটা রেশ ধরে লেখা কখনও কখনও চলে দুপুর পর্যন্ত। আর যখন লেখা শেষ হয়, ‘আপনার নিজের মধ্যে শূন্যতাবোধ কাজ করতে পারে, আবার না-ও পারে। কিন্তু একটা অনুভূতি মেলে, আপনি তাকেই আদর করলেন, যাকে আপনি ভালবাসেন’! এই পরিস্থিতিতে দিনভর কাটতে থাকে। কিন্তু এমন অবস্থায় পরের দিনের জন্য অপেক্ষা করাটা কষ্টকর— মনে হয় যেন নিজের লেখাকেই প্রিয়তমা ভেবে প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া এক মানুষ কথাগুলো বলছেন।

এ সব দর্শন-চেতনা আসলে অনেক সময়েই লুকিয়ে থাকে বাঙালির অতি প্রিয় এবং বাড়ির মায়েদের অতি অপ্রিয় ‘ল্যাদ’ শব্দটির নেপথ্যে। ভ্লাদিমির নবোকভের প্রতিদিনের রুটিনটার দিকে তাকালেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়। শীতের সকালে সাতটা নাগাদ ঘরের ব্যালকনিতে এসে হাজির এক কাক। তার স্বরটি বেশ মধুর ঠেকে লেখকের! ঘুমটিও ভাঙে। কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠতে কী আর ইচ্ছে যায়। মোটামুটি এক ঘণ্টা ধরে বিছানাতেই তাই গড়াগড়ি। আমাদের চোখে তা ল্যাদ হলেও লেখকের মতে, ‘‘ওই সময়ে আমি বিভিন্ন জিনিসের পরিকল্পনা করি।’’ তার পরে শেভিং, ব্রেকফাস্ট, যোগাভ্যাস এবং স্নান সেরে লিখতে বসা। দুপুর একটা পর্যন্ত চলত লেখালিখি। কিন্তু সকালের ওই ল্যাদটি না খেলে লেখা হত না তাঁর!

তবে বাঙালি মায়েদের পক্ষেও লোক আছেন। ডব্লিউ এইচ অডেন। এই ভদ্র মহাশয় জীবনে ‘ল্যাদ’ বলে কিছু জানতেন না। তাঁর কাছে জীবন পুরোটাই ছকে বাঁধা। ভোর ছ’টায় উঠে কফি বানিয়ে, ক্রসওয়ার্ড খেলে ঠিক সকাল সাতটা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত লিখতেন। সকালে একটি মাল্টিভিটামিন জাতীয় বড়িও খেতেন। দুপুরের খাওয়ার পরে আবার লেখা, সন্ধ্যা পর্যন্ত। ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় নানা রকম ভদকা দিয়ে তৈরি ককটেল-পান। তার পরে ওয়াইন-সহ রাতের খাওয়া। মোটামুটি এগারোটার মধ্যে ঘুম। ‘মনের রান্নাঘর’ এমন রুটিন ছাড়া তাজা থাকে না, জীবন দিয়ে বুঝিয়ে গিয়েছেন অডেন।

চার্লস ডিকেন্সের জীবনও ছিল ছকে বাঁধা। সকাল সাতটায় ঘুম ভাঙে, আটটায় ব্রেকফাস্ট, ন’টায় লেখার ঘরে ঢোকা। এই লেখার ঘরটির একটু বর্ণনা দেওয়া যেতে পারে। ঘরে যাতে কোনও রকম শব্দ না ঢোকে সে জন্য ডিকেন্স একটা অতিরিক্ত দরজা বসান! লেখার টেবিলটি ঠিক জানলার ধারে। ডেস্কে পরিপাটি করে সাজানো খাগের কলম, নীল কালির দোয়াত। কাছেই ফুলদানিতে রাখা তাজা ফুল, একটি বড় কাগজ কাটার ছুরি ইত্যাদি। এখানেই দুপুর দুটো পর্যন্ত লেখায় অভিনিবেশ। কিন্তু এর পরেই একটা কাণ্ড ঘটাতেন ডিকেন্স। বেরিয়ে পড়তেন। লন্ডনের রাস্তায়-রাস্তায় তিন ঘণ্টা ধরে ঘুরে বেড়াতেন। কেন এমনটা? ওই লেখার প্রয়োজনেই— ‘ছবির খোঁজ করি, যার উপরে আমি কাজ করব’, বলতেন ডিকেন্স।

সব কথা হল সারা। কিন্তু তাঁর কথা না হলে বাঙালির সব কিছু ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’। তবে তাঁর, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রুটিনটি শুধু বাঙালি কেন, অ-সাধারণ মানুষদের পক্ষেও হজম করা কঠিন। শান্তিনিকেতনে থাকলে ভোর চারটে থেকে দু’ঘণ্টা উপাসনার জন্য বরাদ্দ তাঁর। তার পরে পড়াশোনা চলত টানা ন’টা পর্যন্ত। মাঝে মিনিট দশ-পনেরোর জন্য জলখাবার খাওয়ার বিরতি। এর পরে ফের বারোটা পর্যন্ত লেখাপড়া। দুপুরের খাওয়া সেরে আধ ঘণ্টার মতো বিশ্রাম নেওয়া তাঁর দীর্ঘ দিনের অভ্যেস। কিন্তু ওই পর্যন্তই। দুপুর একটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত ফের কাজ। এর পরে ঘণ্টা দুয়েক গান শেখানো বা আড্ডা-গল্প। রাত আটটার মধ্যে খাওয়াদাওয়া সেরে ফের রাত এগারোটা পর্যন্ত লেখাপড়া, নিজের কাজ— প্রতিভার সঙ্গে হয়তো এমন রুটিনও রবীন্দ্রনাথের মতো এক নিখাদ ‘এনসাইক্লোপিডিক জিনিয়াস’-কে তৈরি করেছিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Authors Routine
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE