Advertisement
E-Paper

সমুদ্রের কাছে প্রার্থনা

খালেদ হোসেইনির নতুন কবিতার বইয়ে এক বাবা শিশুসন্তানকে নিয়ে উত্তাল সমুদ্র পার হতে চাইছেন। ও পারে নতুন জীবন। দেশ-কালের সীমানা পেরোনো কবিতায় একাকার হয়ে যায় স্বপ্ন, আশঙ্কা, বিপন্নতা। খালেদ হোসেইনির নতুন কবিতার বইয়ে এক বাবা শিশুসন্তানকে নিয়ে উত্তাল সমুদ্র পার হতে চাইছেন। ও পারে নতুন জীবন। দেশ-কালের সীমানা পেরোনো কবিতায় একাকার হয়ে যায় স্বপ্ন, আশঙ্কা, বিপন্নতা।

দেবাশিস ঘড়াই

শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৮:০০
স্বপ্ন: ‘সি প্রেয়ার’ বইয়ের ছবি। শিল্পী: ড্যান উইলিয়ামস

স্বপ্ন: ‘সি প্রেয়ার’ বইয়ের ছবি। শিল্পী: ড্যান উইলিয়ামস

অশান্ত উত্তাল সমুদ্র। তার পাড়ে একের পর এক ঢেউয়ের আছড়ে পড়া। সেখানে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে এক শিশুর দেহ। সমুদ্রসৈকত যে মৃত্যুভূমি হয়ে উঠতে পারে, হয়ে উঠতে পারে জীবন্ত কবরস্থান, সিরিয়ার উদ্বাস্তু পরিবারের তিন বছরের সন্তান আয়লান কুর্দির মৃত্যু তা প্রমাণ করে দিয়েছিল, যখন নিরাপত্তার খোঁজে ফুঁসতে থাকা সমুদ্র পার হওয়ার চেষ্টা করেছিল কুর্দির পরিবার। এই দৃশ্যের সামনে থমকে দাঁড়িয়েছিল সারা বিশ্ব। তার পর তা নিয়ে শোরগোল, প্রতিবাদ। কথা, পাল্টা কথা, বিতর্ক। পরে সব কিছুই আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে এসেছে অন্য সব ঘটনার মতোই।

তিন বছর পরে সেই সমুদ্রসৈকতে এসে দাঁড়িয়েছেন কবি খালেদ হোসেইনি। শুধু নিজেই না, সমুদ্রের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন পাঠকদেরও, নিজের সদ্য প্রকাশিত ‘সি প্রেয়ার’ বইয়ের মাধ্যমে। তিনি নিজে এক জন বাবা। এ বইও যুদ্ধক্ষত বুকে নিয়ে এক বাবার বয়ানেই লেখা, যিনি নিজের সন্তানকে নিয়ে নির্বিঘ্নে সমুদ্র পার হতে চাইছেন। ঘুমন্ত শিশুর মুখের দিকে চেয়ে বাবা বলছেন নিজেদের পুরনো জীবনের কথা, যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার কথা, পাল্টে যাওয়া জীবনের কথা! আর সমুদ্রের মাঝে জেগে ওঠা ঢেউয়ের মতো বইয়ের পাতাতেও জেগে উঠেছে একের পর এক ‘ম্যাজিক লাইন’! নিজের সন্তানকে ভরসা দিতে আবহমান কাল ধরে যেমন বাবারা বলে থাকেন, তেমন ভাবেই এখানে সেই ঠিকানা-হারানো বাবা বলছেন, ‘‘আমার হাত ধরো, বাজে কিছু হবে না।’’ নিজেদের পুরনো জীবন, যা যুদ্ধবিধ্বস্ত নয়, যখন জীবনে প্রাণ ছিল, সেই সময়ের কথা স্মরণ করে বাবা বলছেন, ‘‘সেই জীবন, সেই সময় এখন যেন স্বপ্নের মতো লাগে...’’

এ যেন প্রতিদিনের কথা, ভরসার কথা, বিশ্বাসের কথা জেগে উঠেছে প্রতিটি লাইনে। সেই সঙ্গে বিপন্নতার কথাও! এমনিতে সমুদ্রযাত্রার কথা এর আগেও লেখা হয়েছে কবিতায়। স্যামুয়েল কোলরিজই যেমন লিখেছিলেন, ‘ওয়াটার, ওয়াটার, এভরি হোয়্যার/ নর এনি ড্রপ টু ড্রিঙ্ক...’ জল মানেই তো আর জীবন নয়! কখনও কখনও তা যে মৃত্যুও। ‘সি প্রেয়ার’-এ সেই বাবাও চাইছেন সন্তানকে নিয়ে নির্বিঘ্নে প্রাণঘাতী জলরাশি পেরিয়ে যেতে। প্রার্থনামগ্ন বাবা তাই বলছেন, ‘‘কী ভাবে আমি প্রার্থনা করছি সমুদ্র তা জানে।’’ সমাধিস্থান হয়ে ওঠা সমুদ্রসৈকতে এ যেন এক ‘ম্যাজিক-লাইন’-এর জেগে ওঠা, যা মিলিয়ে দেয় সার্বিক বিপন্নতা, উদ্বাস্তু সমস্যাকে। কী অসম্ভব সরল, অথচ অমোঘ একটা লাইন— ‘‘কী ভাবে আমি প্রার্থনা করছি সমুদ্র তা জানে।’’ অথচ বিপন্নতার এই ক’টি শব্দই অনায়াসে মিশে যায় বিশ্বাসের সঙ্গে, ভালবাসা ও আমগ্ন প্রেমের সঙ্গে, যখন শক্তি চট্টোপাধ্যায় লেখেন, ‘আমি কী ভীষণ ভাবে তাকে চাই ভালবাসা জানে।’

এই ভাবে কবিতার নিজস্ব ভূখণ্ডে জেগে ওঠে ম্যাজিক লাইনেরা, তার পর তারা যেন হাত ধরাধরি করে চলে নিজেদের সঙ্গে। যে সম্মোহনে মিলেমিশে যান খালেদ হোসেইনি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়।

কিন্তু কাকে বলা যাবে ম্যাজিক লাইন? এ কী এমন শব্দগুচ্ছ, যার সামনে কবিতা পড়তে-পড়তে নতজানু হন পাঠক! এ কি একই কবিতার মধ্যে আর এক কবিতার জেগে ওঠা, যেমন ভাবে হঠাৎ করে জলরাশির মধ্যে জেগে ওঠে সবুজ দ্বীপ! আর কবিরাই বা কী ভাবে খুঁজে পান সেই অপ্রত্যাশিতকে, সেই ক্ষণিকের স্ফূলিঙ্গকে?

চেক-কবি য়ারোস্লাভ সাইফার্ট লিখছেন, ‘...প্রথম ম্যাজিক লাইনটা শোনার জন্য চোখ বন্ধ করলাম/ কিন্তু অন্ধকারে, শব্দের পরিবর্তে/ আমি দেখতে পেয়েছিলাম এক নারীর হাওয়ায় উড়ন্ত চুল ও হাসি।’ কবি শব্দজাদু-স্পর্শঘোরের সন্ধানে বেরোচ্ছেন, আর তার পরেই সমস্ত ঘটনা-দুর্ঘটনা ছাপিয়ে তাঁর কলমে ধরা পড়ছে সেই কাঙ্খিত! অথচ সাইফার্ট যখন ১৯৮৪ সালে নোবেল পেয়েছিলেন, তখন সেই খবর রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমে তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি! কিন্তু তাতে কী! তিনি তো আজীবন চোখ বন্ধ করে সেই অপ্রত্যাশিতের সন্ধান করেছেন। আর যে মুহূর্তে পাওয়া গিয়েছে, সেই মুহূর্তটুকুই হয়ে গিয়েছে অনন্ত!

যেমনটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘বাস স্টপে দেখা হলো তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল স্বপ্নে বহুক্ষণ দেখেছি...’

আসলে এ বোধহয় নিছকই সমাপতন নয়। আসলে শব্দেরা হয়ে ওঠে এক কবির মূল স্বর, তাঁর বেঁচে থাকা, ভরসার জায়গা। যেমনটা ভরসা জুগিয়েছে এই শব্দগুলো, ‘রাইট ডাউন!/ আই অ্যাম অ্যান অ্যারাব...’ প্যালেস্তাইনের কবি মাহমুদ দারউইশ-এর কবিতার এই পঙ্‌ক্তি ইজ়রায়েলের আগ্রাসনের মুখে প্যালেস্তাইনের সাধারণ মানুষের মুখে-মুখে গান হয়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল।

কারণ, ইজ়রায়েল-অধিকৃত ভূখণ্ডে যাতায়াতের জন্য প্যালেস্তাইনের অধিবাসীদের একটা করে পরিচয়পত্র দেওয়া হত। সেই পরিচয়পত্র নিয়েই তাঁর এই স্পর্ধিত উচ্চারণ! ১৯৪১ সালের মার্চ মাসে প্যালেস্তাইনের অল-বিরওয়ে নামের যে জায়গাটায় দারউইশ জন্মেছিলেন, ইজ়রায়েলের সেনারা হঠাৎ এক দিন তা দখল করে নিয়ে, পুরো ধ্বংস করে দিয়েছিল সেই জনপদ!

আবার তুরস্কের কবি নাজ়িম হিকমত, যাঁকে জীবনের একটা অধ্যায় কাটাতে হয়েছিল জেলখানায় আর নির্বাসনে, তিনিও তো নিজের যা কিছু বলার কবিতাতেই বলেছেন। লিখেছেন, ‘এখন ক’টা বাজে?/ আটটা।/ তার মানে সন্ধ্যা পর্যন্ত তুমি নিরাপদ আছো/ কারণ, পুলিশ/ কখনও দিনের আলোয় কারও বাড়িতে অভিযান চালায় না।’

অনেকে এ কবিতাকে বলেছেন আত্মহত্যাপ্রবণতা থেকে লেখা, অনেকের কাছে এ কবিতা এক প্রতিবাদ। সিলভিয়া প্লাথ-এর সেই ম্যাজিক-লাইন, ‘আউট অব দ্য অ্যাশ/ আই রাইজ় উইথ মাই রেড হেয়ার/ অ্যান্ড আই ইট মেন লাইক এয়ার।’ এই লাইনগুলো পাঠককে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয় আর একটি কবিতার সামনে, কবি মায়া অ্যাঞ্জেলু যেখানে বলেন,—‘আই অ্যাম দ্য ড্রিম অ্যান্ড দ্য হোপ অব দ্য স্লেভ/ আই রাইজ়/ আই রাইজ়/ আই রাইজ়।’ এই উত্থানকে আটকাবে কে?
এই স্বরকে?

কিন্তু কবি কি শুধুই বাইরে খোঁজেন? অন্তরে নয়? তা হলে কেন বুদ্ধদেব বসু লিখছেন, ‘শুধু তা-ই পবিত্র, যা ব্যক্তিগত।’ এ তো শাশ্বত উচ্চারণ, যা কিছু একান্ত-নিজস্ব, তাকে নিমেষে পবিত্র, শুদ্ধতম করে তুলেছে। কিন্তু সেই পবিত্র, অন্তরতম কিছু যদি চলে যায়, ভেসে যায়, তা হলে বোধহয় জন্ম নেয় সেই শব্দেরা, যা লিখেছেন জয় গোস্বামী— ‘হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে...’

কিন্তু এমনও তো হয়, অপ্রয়োজনীয় শব্দ-কথার ভিড়ে হারিয়ে যায় সৎ উচ্চারণ! কথা হচ্ছে শুধু, কিন্তু যে কথাটা বলার, সেটা কিছুতেই বলা হচ্ছে না। জন ডান লিখছেন, ‘ফর গড’স সেক হোল্ড ইয়োর টাং অ্যান্ড লেট মি লাভ।’ আবার ওই নৈঃশব্দ্যকেই শঙ্খ ঘোষ বলেছেন অন্য ভাবে, ‘বলিনি কখনো?/ আমি তো ভেবেছি বলা হয়ে গেছে কবে।’

কবিদের হাত ধরে পাঠক আসলে এমন এক কবিতা-অরণ্যে প্রবেশ করেন, যে কবিতাগাছের শেকড়েরা পরস্পরের সঙ্গে জড়াজড়ি করে রয়েছে। গভীরে, নিভৃতে। প্রতিটি ম্যাজিক-লাইন, প্রতিটি শব্দ পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছে। যেমনটা মানুষ কথা বলে মানুষের সঙ্গে। নিজের প্রিয় নারীর সঙ্গে কথা বলে পুরুষ!

সেই কথোপকথন চলতে-চলতেই শব্দ-উত্থানে জেগে ওঠেন কবি। যাবতীয় নৈঃশব্দ্য-মৃত্যু-দুর্ঘটনা-অপঘাত উড়িয়ে এ ভাবেই তো জেগে ওঠে শব্দ-উড়ান, ম্যাজিক-লাইনেরা! আর কবির কাছে এই তাঁর অস্তিত্ব, টিকে-থাকা, বেঁচে-থাকা! যেমনটা কবি অরুণ মিত্র লিখেছিলেন, ‘আমার চব্বিশ ঘণ্টার রক্ত ঝঙ্কারে এই আমার বাঁচা।’

Sea Prayer Khaled Hosseini Afghanistan Syria খালেদ হোসেইনি
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy