বুদ্ধ হেসেছেন”— ১৯৭৪ সালের ১৮ মে এ ভাবেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে ভারতের প্রথম সফল পারমাণবিক শক্তি-পরীক্ষার খবর পাঠালেন পরমাণু বিজ্ঞানী রাজা রমন্না। এই খবরে প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তাও বেড়েছিল বিপুল এবং উদ্বেগে ভুরু কুঁচকেছিল ভিন্ন রাষ্ট্র। কিন্তু বুদ্ধ কেন হাসবেন? বুদ্ধপূর্ণিমার দিন তাঁর কর্মভূমি ভারত মারণক্ষমতায় পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশ হয়ে উঠল বলে? প্রতিটি যুদ্ধই নাকি শান্তি প্রতিষ্ঠার নিরুপায় অস্ত্র, অন্তত যুদ্ধবাজেরা তাই বলেন। অথবা যেমন রাষ্ট্রনীতি বলে থাকে, পরমাণুশক্তিধর হয়ে ওঠা আসলে সম্ভাব্য আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রতিরোধ। সেই জন্যেই হয়তো পোখরানেই ১৯৯৮ সালের ১১ এবং ১৩ মে পাঁচটি ধারাবাহিক পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ঘোষিত হয়েছিল— বুদ্ধ আবার হেসেছেন। কিন্তু বুদ্ধ কি সত্যিই হাসতেন? শান্তি প্রতিষ্ঠার এই যুক্তি কি তাঁর গ্রাহ্য হত?
আনুমানিক ৫৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কপিলবস্তু রাজ্যের শাসক শাক্যবংশীয় শুদ্ধোদনের পুত্ররূপে মায়াদেবীর গর্ভে সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্ম হয়। সুদীর্ঘ অপেক্ষার পর রাজার পুত্রলাভের আকাঙ্ক্ষা সিদ্ধ হওয়ায় সদ্যোজাতের নাম রাখা হল সিদ্ধার্থ। জন্মের সাত দিনের মধ্যে মাতৃহারা হয়ে বিমাতা গৌতমীর কাছে পালিত হওয়ায় তিনি গৌতম। দেবল নামক মহর্ষির ভাগ্যগণনা— এই ছেলে সংসারে থাকলে রাজচক্রবর্তী হবে, গৃহত্যাগী হলে মানুষের পরিত্রাতা। ‘ললিতবিস্তার’ গ্রন্থ থেকে আমরা আরও জানতে পারি, বালক সিদ্ধার্থকে কপিলাবস্তু নগর থেকে দূরের এক গুরুগৃহে বিদ্যাশিক্ষার জন্য পাঠানো হয়। চৌষট্টির অধিক লিপির ব্যবহার তাঁর অধিগত হয়েছিল। এই তথ্য অন্তত আমাদের ভারতের ভাষাবৈচিত্রের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পুত্রের গৃহত্যাগের আশঙ্কার কথা মাথায় রেখে ত্রস্ত পিতা শাক্য বংশেরই অন্য এক ধারার কন্যা গোপা বা যশোধরার সঙ্গে সিদ্ধার্থের বিয়ে দিলেন। কুমারের ভ্রমণপথে সমস্ত অপ্রীতিকর বস্তু অপসারণের নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন শুদ্ধোদন। কিন্তু যেন নিয়তির নির্দেশেই ভ্রমণপথে জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুদৃশ্য সিদ্ধার্থকে সংসারে দুঃখের অস্তিত্ব বিষয়ে সচেতন করে তুলল। এবং গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীর প্রশান্ত মুখাবয়ব তাঁকে জানাল, দুঃখ-বিনাশের উপায়ও আছে। এক রাতে সিদ্ধার্থ, যশোধরা এবং পুত্র রাহুলকে ঘুমন্ত রেখে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করলেন। ইতিহাসে এই ঘটনা বুদ্ধের মহানিষ্ক্রমণ নামে খ্যাত। তখন সিদ্ধার্থের বয়স ঊনত্রিশ। তার পরের ঘটনাও আমাদের জানা। বহু পথ ও পন্থা ঘুরে অবশেষে মধ্যম পথে, গভীর ধ্যানে সিদ্ধার্থ আবিষ্কার করলেন প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্ব— বিশ্বের সব কিছুই কার্যকারণ শৃঙ্খলে আবদ্ধ, দুঃখও তার ব্যতিক্রম নয়। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে বোধিপ্রাপ্ত হয়ে বুদ্ধ হলেন তিনি। দ্বাদশ-নিদান-চক্রের আবর্তনে আদি-কারণ স্বরূপ কোনও ঈশ্বরের কল্পনার প্রয়োজন তিনি অনুভব করেননি। এই চক্র থেকে মুক্তির উপায় স্বরূপ নৈতিক পথেরও নির্দেশ করলেন তিনি, অষ্টাঙ্গিক মার্গ।
সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগের সঙ্গে চতুর্দৃশ্যের সম্বন্ধের এই আখ্যান পৃথিবীতে বিখ্যাত ও প্রিয়। বিশ্বাস্য কী? জীবনের আটাশটি বছর পার করে তবেই কি তিনি জানলেন জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুকে? না কি নিউটনের আপেলের মতোই চতুর্দৃশ্য কিংবদন্তি মাত্র? হতে পারে পরিচিত দৃশ্যও সহসা গভীরতর বোধে আমাদের অভিভূত করে কখনও কখনও, হতে পারে গৃহত্যাগের অব্যবহিত পূর্বে জরা-মরণের দৃশ্য সিদ্ধার্থের সিদ্ধান্তকে ত্বরান্বিত করেছিল, কিন্তু চতুর্দৃশ্যকেই গৌতমের বৈরাগ্যের একমাত্র কারণ হিসেবে গ্রহণ করা সঙ্গত নয়। ঊনত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত সিদ্ধার্থ তো গৃহবন্দি ছিলেন না। বরং অপর একটি আখ্যান অধিক যুক্তিসঙ্গত। এই আখ্যানে আছে শাক্য এবং কোলীয়, এই দুই জ্ঞাতি বংশের দ্বন্দ্বের ইতিহাস। পুরাণ-ধর্মগ্রন্থ-লোককথার মিশ্রণে নির্মিত এই কাহিনিতে নির্মোহ পাঠক কিছুটা ইতিহাসও খুঁজে পেতে পারেন।