Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Nilima Guha Thakurata

সিগনেটের ম্যাডাম

পরাধীন ভারতে তাঁর হাতেই কলকাতা থেকে প্রথম প্রকাশিত হল জওহরলাল নেহরুর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’। ভালবাসার প্রশ্নে সংসারে আপস করেননি। সেই প্যাশনই ফুটে উঠেছে তাঁর সমস্ত কর্মকাণ্ডে।  জামাতা ‘ডিকে’ অর্থাৎ দিলীপকুমার গুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে প্রকাশনার জগতে বিপ্লব এনেছিলেন নীলিমা গুহঠাকুরতা।

বর্ণময়ী: নীলিমা গুহঠাকুরতা। বিশ্বাস করতেন বই প্রকাশনা এক শিল্পকর্ম

বর্ণময়ী: নীলিমা গুহঠাকুরতা। বিশ্বাস করতেন বই প্রকাশনা এক শিল্পকর্ম

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৭:১৫
Share: Save:

দাদা জেলে বসে একটা বই লিখেছে। তোরা ছাপতে চাস?” বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত টেলিফোনে কথা বলছেন তাঁর প্রাণের বান্ধবীর সঙ্গে। বান্ধবী কিছু দিন আগে অবধিও ইলাহাবাদে নেহরু পরিবারের প্রতিবেশিনী ছিলেন। এখন কলকাতায় থিতু। একটা প্রকাশনা সংস্থা খুলেছেন বছর দুয়েক।

মার্চ, ১৯৪৬। জওহরলাল নেহরুর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ যে সত্যজিৎ রায়ের প্রচ্ছদ-সহ কলকাতার সিগনেট প্রেস থেকে বেরোল, তার নেপথ্যে বিজয়লক্ষ্মীর সেই বান্ধবী— নীলিমা গুহঠাকুরতা (১৯০৩-১৯৮২)। সিগনেটের কর্ণধার ‘ডিকে’ দিলীপকুমার গুপ্ত থেকে সিগনেটের কর্মিবর্গ, সকলেই তাঁকে এক নামে ডাকেন— ম্যাডাম! সম্পর্কে যদিও তিনি ডিকে-র শাশুড়ি!

সিগনেট আর ডিকে, দুটো নাম প্রায় সমার্থক হয়ে উঠে বাংলা প্রকাশনার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, এ কথা অজানা নয় কারও। তুলনায় নীলিমাকে নিয়ে চর্চা হয়েছে কমই। অথচ নীলিমাকে পাশে না পেলে ডিকে সিগনেট শুরু করতে পারতেন কি না সন্দেহ। কেবল শুরু করাই নয়, সিগনেটের কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পিছনেও ডিকে-র প্রধান সহযোগী নীলিমা। বঙ্গমহিলার পেশাদার জীবন, ব্যবসায় বঙ্গমহিলার অবদান, বঙ্গীয় প্রকাশনায় মহিলাদের সংযোগের ইতিহাস যদি লিখতে হয়, নীলিমার নাম সেখানে থাকবে প্রথম সারিতে। তাঁর নিজস্ব লেখালিখি, তাঁর কুশলী অনুবাদশৈলী, তাঁর ছকভাঙা জীবনযাপন, তাঁর বহুধাবিস্তৃত কর্মক্ষেত্র নিয়ে নীলিমা আক্ষরিক অর্থেই অনন্যা।

নীলিমাদের পরিবার অনেক দিন ধরেই ইলাহাবাদে। ঠাকুরদা প্রমদাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, পরে হাইকোর্টের বিচারপতি। বাবা ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ও হাইকোর্টের বিচারপতি। মোতিলাল নেহরুর বিশেষ বন্ধু এবং প্রতিবেশী। আনন্দভবন-স্বরাজভবনের পাশেই ললিতমোহনের বাংলো। নীলিমা বড় হয়েছিলেন বেশ সাহেবি আদবকায়দায়। এক স্কটিশ গভর্নেস ছিলেন তাঁর জন্য। তবে ইংরেজি শেখাতে গিয়ে বাংলা বা সংস্কৃতে অবহেলা করা হয়নি মোটেই। সংস্কৃত শেখানোর জন্য পণ্ডিত আসতেন। বাংলা সাহিত্যের পাঠ চলত নিয়মিত। ফলে কিশোরীবেলা থেকেই শেক্সপিয়র থেকে মধুসূদন, নীলিমার ঠোঁটের ডগায়। আর একটু বড় হয়ে হাতে পেলেন একটি হাল ফ্যাশনের টু-সিটার। সেইটি ঝড়ের বেগে চালিয়ে দাপিয়ে বেড়াতেন শহর। লোকে বলত ‘টেরর অব ইলাহাবাদ’!

এ হেন নীলিমার বিয়ে হল লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ভূপেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ভূপেন্দ্র তখন লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স থেকে পাশ করে এসেছেন, সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। ললিতমোহন ভেবেছিলেন, মেয়ের জন্য এমন সুপাত্র আর হয় না! ভাবনাটা আপাতদৃষ্টিতে খুব ভুলও নয়। সে আমলে অভিজাতবংশীয়া আর পাঁচ জন মহিলার জীবন যে ছন্দে অতিবাহিত হত, নীলিমার জীবনও তা-ই হতে পারত। কিন্তু হল না। অচিরেই হাঁপিয়ে উঠলেন তিনি। ভূপেন্দ্র খুবই ভাল মানুষ। চুপচাপ, একটু গুটিয়ে থাকা চরিত্র। নির্বিবাদী। ছটফটে, হইচইপ্রিয়, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে মাতোয়ারা নীলিমা তাঁর মধ্যে যেন প্রাণের দোসরকে খুঁজে পান না। এমতাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির নতুন অধ্যাপক হয়ে এলেন প্রভু গুহঠাকুরতা। অতুল বাগ্মিতা, গভীর বৈদগ্ধ্য এবং আকর্ষক ব্যক্তিত্বের অধিকারী।

স্বল্পায়ু প্রভুচরণকে (১৯০১-১৯৪৩) নিয়েও ইদানীং আলাপ-আলোচনা দেখা যায় না তেমন। বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিলিখনে তাঁর এই ‘বুদ্ধুদা’ কিন্তু আছেন অনেকখানি জায়গা জুড়ে। ঢাকায় বুদ্ধদেবের কৈশোরের দিনগুলিতে প্রায় আলোকবর্তিকার ভূমিকা নিয়েছিলেন প্রভু। গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। বিলিতি শিক্ষাব্যবস্থা বয়কটের কথাও ভাবছিলেন। কেরিয়ার পাছে ডোবে, প্রভুর ভাবগতিক দেখে বাড়ি থেকে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হল আমেরিকায় পড়াশোনা করতে। আমেরিকার সঙ্গে একটা যোগ আগে থেকেই ছিল ওঁদের। প্রভুচরণের কাকা ছিলেন বিবেকানন্দের শিষ্য, স্বামী পরমানন্দ। সন্ন্যাস নিয়ে তিনি আমেরিকায় বেদান্ত দর্শন প্রচারের কাজেই জীবনটা উৎসর্গ করেন। এমনকি প্রভু আমেরিকায় যাওয়ার কিছু দিন পরে তাঁর বিধবা বড় বোন শ্রীমাতা গায়ত্রী দেবীও সন্ন্যাস নিয়ে কাকার আশ্রমে যোগ দেন। প্রভু অবশ্য সে দিকে ঝোঁকেননি। হার্ভার্ড থেকে স্নাতকোত্তর পাঠ শেষ করে তিনি চলে গেলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলা নাটক নিয়ে পিএইচ ডি করলেন সেখানে। ‘বেঙ্গলি ড্রামা, ইটস অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ খুবই নামকরা বই সে আমলের। তার পর দেশে ফিরে লখনউয়ের চাকরি এবং নীলিমার সঙ্গে দেখা।

ফল যা হওয়ার তা-ই হল। যা হওয়া শক্ত, তা-ও হল। দুর্নিবার প্রেমের হাতছানি অনেকের জীবনেই আসে। কিন্তু সেই প্রেমের জন্য সব শেকল ভেঙে দরিয়ায় ভেসে পড়তে সকলে পারেন না। প্রভু-নীলিমা পারলেন। বিশ-তিরিশের দশকে যে সাহস, দৃঢ়তা আর স্বাধীনচিত্ততার পরিচয় নীলিমা দিয়েছিলেন, সে কথা ভাবলে আজকের দিনেও অবাক লাগে। প্রেমহীন সংসার ছেড়ে তিনি বেরিয়ে এলেন অল্প দিনের মধ্যেই। ১৯২৯ সালে তাঁর বড় মেয়ে নন্দিনীর জন্ম হল ইলাহাবাদে। এর কিছু দিন পর নীলিমা আর প্রভু মেয়েকে নিয়ে চলে যান দিল্লি। সেখানে প্রভু যোগ দিলেন হিন্দুস্থান টাইমস কাগজে। তৈরি হল নতুন জীবন, নতুন সংসার। দিল্লিতে থাকতেই নীলিমার দুই যমজ ছেলেমেয়ে হল। এ দিকে সাংবাদিকের চাকরি করতে করতেই প্র‌ভুর ডাক এল বিজ্ঞাপনের কাজে। টি বোর্ডের বিজ্ঞাপনী দায়িত্ব নিয়ে প্রভু চলে এলেন কলকাতায়। নীলিমার জীবনে শুরু হল আরও এক নতুন অধ্যায়। সেটা ১৯৩৫ সাল।

নতুনত্ব এ বার সব দিকেই। প্রভু-নীলিমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময়টা শুরু হয়েছে তখন। এক দিকে টি বোর্ডে দুরন্ত গতিতে কাজ করছেন প্রভু। কলকাতার বিজ্ঞাপনী দুনিয়া ‘পিজিটি’র ছটায় মোহিত। সে সময়কার পত্রপত্রিকা মানেই চা-এর পাতাজোড়া মনোহারী বিজ্ঞাপন। যুগের মাপকাঠিতে অত্যন্ত আধুনিক তার ভাষা এবং সামগ্রিক উপস্থাপনা। নীলিমার কলমও ছুটছে। ইংরেজি এবং বাংলা, দুই ভাষাতেই লিখে চলেছেন তিনি কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ। ‘দ্য স্টেটসম্যান’, ‘ইন্ডিয়ান স্টেট রেলওয়ে ম্যাগাজিন’, ‘দ্য হিন্দু’, ‘ম্যাড্রাস মেল’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’, ‘ক্যালকাটা মিউনিসিপাল গেজেট’— নীলিমার লেখা বেরোচ্ছে নিয়মিত। জোরকদমে চলছে বেঙ্গল স্কুল ঘরানায় ছবি আঁকাও। ১৯৩৬— প্রভু, নীলিমা দু’জনেরই বই বেরোল সুভো ঠাকুরের ‘ফিউচারিস্ট পাবলিকেশন’ থেকে। প্রভু লিখলেন ইউরোপীয় সাহিত্যের আলোচনা ‘এ ও তা’। নীলিমা লিখলেন মৌলিক ইংরেজি কবিতা, ‘দ্য হিডেন ফেস’। এটিই খুব সম্ভবত নীলিমার লেখা প্রথম বই। ওই একই বছর একই প্রকাশনা থেকেই নীলিমা ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন সুভো ঠাকুরের বাংলা কবিতার বই ‘কাঁকর’। বইটির ইংরেজি নাম দিলেন ‘রাবলস’।

যুগল: স্বামীর সঙ্গে নীলিমা গুহঠাকুরতা। ডান দিকে, তাঁর করা ‘ক্ষীরের পুতুল’-এর অনুবাদ ‘দ্য চিজ় ডল’ ও কাব্যগ্রন্থ ‘দ্য হিডেন ফেস’ এর প্রচ্ছদ

যুগল: স্বামীর সঙ্গে নীলিমা গুহঠাকুরতা। ডান দিকে, তাঁর করা ‘ক্ষীরের পুতুল’-এর অনুবাদ ‘দ্য চিজ় ডল’ ও কাব্যগ্রন্থ ‘দ্য হিডেন ফেস’ এর প্রচ্ছদ

কলকাতায় ওঁরা প্রথমে উঠেছিলেন শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের কাছে একটি ফ্ল্যাটে, তার পর রসা রোড। সেখান থেকে বাঁশদ্রোণী। বুদ্ধদেব বসু যখন নীলিমাকে দেখেন প্রথম, তখন ওঁরা ভবানীপুর পাড়াতেই। বুদ্ধদেব লিখছেন, “আমাদের এ কালের অর্থে মুক্ত মহিলা আমি প্রথম দেখেছিলাম প্রভুচরণের পত্নী নীলিমা দেবীকে...মনে হয়েছিল তাঁর বচনে বা ব্যবহারে কোথাও নেই সেই আড়ষ্টতা যা বাঙালি মেয়েদের মনটিকেও কুণ্ঠিত করে রাখত। তখনকার দিনে তিনি যেন খুব স্পষ্ট ভাবে প্রকাশিত হতে পেরেছেন। তাঁকে হঠাৎ মনে হতে পারত কিছুটা ইঙ্গভাবাপন্ন। তাঁর চুল হ্রস্ব, মুখের কথায় সাবলীল ভাবে ইংরেজি বেরিয়ে আসে। কিন্তু এদিকে তিনি বাংলা বলেন খাঁটি পশ্চিমবঙ্গীয় ইডিয়মে, লিপস্টিক সত্ত্বেও তাম্বুল চর্বণে বিমুখ নন...এবং যা আমার পক্ষে খুব সুখের কথা, তিনি তাঁর স্বামীর মতোই বাংলা সাহিত্যে উৎসাহী, অর্বাচীন আমাদের লেখাও পড়ে থাকেন। তাঁর অনুবাদে আমার ‘মেজাজ’ গল্পটা আর প্রভুচরণের অনুবাদে প্রেমেনের ‘হয়তো’— এ দু’টো লেখা সেই সময়েই মাদ্রাজে এক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল (দ্র. আমার যৌবন)।”

তত দিনে নীলিমা কলকাতার সাহিত্য জগতে একটি নাম হয়ে উঠেছেন। ‘দ্য স্টেটসম্যান’ কাগজের শিল্পসমালোচক হিসেবেও তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত। কলকাতা সাহিত্য সম্মেলনের মহিলা শাখার সভানেত্রী তিনিই মনোনীত হলেন সে বার (১৯৩৬)। মেয়েদের জীবন, মেয়েদের লড়াই নিয়ে তিনি যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেখানে, সেটা ‘দীপালি’ পত্রিকার নারীলোক বিভাগে ছাপা হয়েছিল। নীলিমা জোর দিয়েছিলেন মেয়েদের আত্মশক্তির উপরে। নিজেদের শেকল ভাঙতে যে মেয়েদেরই এগিয়ে আসতে হবে, সেটা খুব স্পষ্ট করে বলেছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, পুরুষের বিরোধিতা করা নয়, পুরুষের সঙ্গে সমান তালে চলাই হবে মেয়েদের লক্ষ্য।

১৯৩৮-এ সুখী দম্পতি বেরিয়ে পড়লেন বিশ্বভ্রমণে। ছেলেমেয়েরা প্রভুর পিসিমার (লাবণ্য গুহঠাকুরতা) কাছে রইল। গোটা পৃথিবীই ঘোরার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়াতে বর্মা না দেখেই ফিরতে হল দেশে। লেখালেখি চলতে থাকল। ১৯৪০ সালে নীলিমা আনন্দবাজার পত্রিকার ‘নারীর কথা’ বিভাগের দায়িত্ব নিলেন। সাহিত্য সম্মেলনের ভাষণে যে কথা বলেছিলেন, তাঁর সেই দৃষ্টিকোণ আরও ব্যাপ্ত ভাবে প্রকাশ পেল খবরের কাগজের পাতায়। স্বনামে নয়, নীলিমা পাতাটি পরিচালনা করতেন ‘সঙ্ঘমিত্রা’ ছদ্মনামের আড়ালে। ৪ জুলাই ১৯৪০-এর ‘নারীর কথা’র প্রথম সংস্করণের পাতায় ‘আমরা কি চাই’ শিরোনামে তিনি ঘোষণা করলেন, “পাশ্চাত্য শিক্ষার সঙ্গে পরিচয় লাভ করিয়া আমাদের বাহিরের পরিবর্তন কিছু কিছু না হইয়াছে এমন নয়। কিন্তু কি শিক্ষিত কি অশিক্ষিত, এ দেশের গোটা নারীসমাজ এখনও আত্মনির্ভরশীল হইতে শিখে নাই— আত্মমর্যাদার মর্ম এখনও ভাল করিয়া বোঝে নাই।...বহুকাল হইতে গৃহধর্ম্ম পালনের আদর্শ আমাদের সামনেই ধরা আছে। আজ চাই স্বধর্ম্ম পালনের আদর্শ। অন্যায় সহ্য করিবার মত সহিষ্ণুতা ও ধৈর্য্য আমাদের নাই, এ-অপবাদ আমাদের কেহ দিতে পারিবে না। কিন্তু দুঃখ সহ্য করিবার শক্তির অপেক্ষা আজ আমাদের অনেক বেশী প্রয়োজন— দুঃখ জয় করিবার সাহস।”

‘নারীর কথা’ বিভাগটিকে প্রথম থেকেই প্রগতিশীলতার এক উঁচু তারে বেঁধে দিয়েছিলেন ‘সঙ্ঘমিত্রা’ নীলিমা। সাংবাদিকতায় বাঙালিনির ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনাও তাঁকে বাদ দিয়ে তাই হতে পারে না। ঘরগেরস্থালির বিষয়আশয়— রান্নাবান্না-সেলাই-ফ্যাশন— যেমন থাকত সেই পাতায়, পাশাপাশি অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকত মেয়েদের কাজ, মেয়েদের লেখাপড়া, মেয়েদের রাজনীতি, মেয়েদের লেখালেখি নিয়ে আলোচনা। মেয়েদের নিয়ে খবরাখবর। থাকত ‘অল ইন্ডিয়া উইমেন্স কনফারেন্স’ নিয়ে নিবন্ধ, থাকত ছবি-সহ লন্ডনের রয়্যাল আর্ট সোসাইটিতে ভারতীয় মহিলা সদস্য নির্বাচিত হওয়ার খবর, নব্য রাশিয়ার নারীসমাজ
নিয়ে আলোচনা।

কিন্তু নির্মল আনন্দের সময়টা এ বার যেন ফুরিয়ে আসছিল। ১৯৪১-এই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন প্রভু। হৃদ্‌রোগ। ও দিকে তত দিনে রামময় রোড নিবাসী এক যুবক আত্মবিশ্বাসে টগবগ করছেন। সাহিত্যে অগাধ উৎসাহ। এক বন্ধুর সঙ্গে প্রকাশনার কাজে হাত পাকাচ্ছেন। একটা সিনেমা পত্রিকাও কিছু দিন সম্পাদনা করে ফেলেছেন। যে ‘খোকন’কে এক সময় বাড়িতে পড়িয়েছেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত-বুদ্ধদেব বসু, সে এ বার দিলীপকুমার গুপ্ত হয়ে আত্মপ্রকাশে উন্মুখ।

যে বছর প্রভু অসুস্থ হলেন, ওই বছরই, অর্থাৎ ১৯৪১-এই ডি জে কিমার-এ চাকরি নিলেন দিলীপকুমার ওরফে ডিকে। নিজ উৎসাহেই প্রভুর কাছে আসা-যাওয়া করতেন তিনি। বিজ্ঞাপনের জগতে প্রভু তখন বটগাছের মতো। ডিকে-র মতো তরুণেরা তাঁকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। এ বার শ্রদ্ধার দাবিদার হয়ে এলেন নীলিমাও— তিনিও যোগ দিলেন ডি জে কিমারে। বিজ্ঞাপন জগতে পেশাদার হিসাবে নীলিমাই কিন্তু ভবিষ্যতের তারা সিংহদের পূর্বসূরি। জরি পাড় দেওয়া জর্জেটের শাড়িতে অফিস যাওয়ার সময়ে আশ্চর্য সুন্দর দেখাত তাঁকে। কিমারে অ্যাকাউন্টস অফিসারের দায়িত্ব সামলাতেন নীলিমা। প্রথমে পার্টটাইম, পরে ফুলটাইম। টি বোর্ডও তাঁকে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু নীলিমা কিমারকেই বেছে নেন। প্রভুর চিকিৎসার সুবিধার জন্য ওঁরা তত দিনে চলে এসেছেন ১০/২ এলগিন রোডের বাড়িতে।

ডিকে-র মাথায় তখনই প্রকাশনা সংস্থার স্বপ্ন বড় করে ঘুরছে। কিন্তু তিনি যা যা ভাবছেন, তা করে উঠতে গেলে বড় পরিকাঠামো দরকার। দরকার টাকা। দরকার সাহায্য করার উপযুক্ত লোক। নীলিমার চেয়ে যোগ্যতর আর কে আছে? নীলিমার নিজের জীবন তখন টালমাটাল। ১৯৪৩-এ প্রভু পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন অকালে। নীলিমার উপরে পুরো সংসারের দায়িত্ব। নীলিমা দ্রুত নন্দিনীর সঙ্গে বিয়ে দিলেন ডিকে-র। কিমারের চাকরি ছাড়লেন আর সিগনেট প্রেসের প্রশাসনিক দায়িত্ব তুলে নিলেন নিজের কাঁধে। কিছু শেয়ার ছিল, আর ছিল জীবনবিমা। সে সব বেচে একত্র করা হল সিগনেটের জন্য। ডিকে আর ডিকে-র ‘ম্যাডাম’ পূর্ণ প্যাশনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কাজে। কিমার থেকেই অন্নদা মুন্সী, সত্যজিৎ রায়ের মতো শিল্পীদের তখন ওঁরা পেয়ে গিয়েছেন পাশে। বঙ্গীয় প্রকাশনার জগতে প্রায় একটা যুগান্তর ঘটিয়ে ফেলল সিগনেট। শুধু ভাল বই নয়, ভাল করে নির্মিত বই। লীলা মজুমদারের বর্ণনায়, ‘যার বানান অকাট্য, প্রচ্ছদ অতুলনীয়, ছবি অপূর্ব, বাঁধাই বলিষ্ঠ, দাম সর্বজননন্দিত’।

এলগিন রোডের বাড়িতে সিগনেট প্রকাশনার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের দিনটির কথা (৩০ অক্টোবর, ১৯৪৩) ধরা আছে প্রতিভা বসুর স্মৃতিলিখনে— ‘‘অত্যন্ত চিত্তাকর্ষী এক মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান।...সুকুমার রায়ের বই ছাপা হবে, সেই আসরে তাঁর বিষয়েই আলোচনা হল, তাঁর প্রতিভাকে ঘিরে-ঘিরেই নানা দিক থেকে নানান আলোচনা হতে লাগল, আর যে-মুহূর্তে তাঁর কবিতা ‘খাই খাই করো কেন এসো বসো আহারে’ পড়া শুরু হল, তৎক্ষণাৎ সকলকে অবাক করে দিয়ে ভোজবাজির মতো প্লেটে প্লেটে অতি উত্তম সব আহার্য এসে পৌঁছতে লাগল নিমন্ত্রিতদের কোলের কাছে।’’

এই সব ‘উত্তম আহার্য’ নীলিমার বড় মেয়ে নন্দিনীর তত্ত্বাবধানে তৈরি। রান্নার হাতটি তিনি পেয়েছিলেন মায়ের কাছ থেকেই। রান্না ছিল নীলিমার আর এক প্যাশন। পৌষ সংক্রান্তিতে নিজে পিঠে বানাতেন। সেই পিঠে সিগনেটের কর্মীদের সবার জন্য যেত। নন্দিনীর মেয়ে, নীলিমার নাতনি ইন্দ্রাণী দত্ত মনে করতে পারেন, ওঁদের দোতলায় ছিল এক বিশাল ডাইনিং টেবিল। অতিথি-অভ্যাগতরা এলে নীলিমা পেতে দিতেন তাঁর পছন্দের টেবিল ক্লথ। “একবার বিজয়লক্ষ্মী এ বাড়িতে এসে খেয়েছিলেন। সেটা আমার জন্মের আগে। কী খাওয়ানো হয়েছিল তাঁকে বলতে পারব না। তবে একটু বিশেষ খাওয়াদাওয়ার আয়োজনের দিনে সাধারণত বাদ যেত না লুচি, চিংড়ির মালাইকারি, পুরঠাসা দই বেগুন। চিংড়ি কাটলেট, কিমার চপও হত খুব। দিদিমা টেবিলে বসে পুরের মণ্ডটায় আলুসেদ্ধর মোড়ক দিয়ে, ফেটানো ডিমে ডুবিয়ে ব্রেডক্রাম্ব মাখিয়ে নিচ্ছেন ভাজতে দেবার আগে, চোখ বুজলে দেখতে পাই দৃশ্যটা। আর একটা চমৎকার জিনিস বানাতেন দিদিমা, ক্ষীর কমলা।”

বাড়ির একতলায় ছিল সিগনেটের অফিসঘর। সেখানে অনেকগুলো টেবিল জোড়া দিয়ে একটা বড় চৌকো টেবিল করা হয়েছিল। তার এক ধারে মহিলা কর্মীরা বসতেন। পাফ হাতা ব্লাউজ আর সুতির শাড়ি পরে নীলিমা বসতেন তাঁদের মধ্যমণি হয়ে। তারা ডাকত ‘ম্যাডাম’ বলে, ডিকেও বলতেন ‘ম্যাডাম’! কিমারের অফিস থেকে ফিরেই ডিকে বসে যেতেন সিগনেটের কাজ নিয়ে। অনেক রাত পর্যন্ত এক মনে কাজ করে চলতেন শাশুড়ি আর জামাই। এমন জুটি আর এসেছে কিনা সন্দেহ! ১৯৪৪ সালে সিগনেট থেকে প্রথম যে বই বেরোয়, সেটি নীলিমার কবিতার বই, ‘হোয়েন দ্য মুন ডায়েড’। এই বইয়ের কবিতা পরে স্থান পায় সাহিত্য অ্যাকাডেমি প্রকাশিত ভারতীয় ইংরেজি কবিতার সংকলন ‘দ্য গোল্ডেন ট্রে়জ়ারি অব ইন্দো-অ্যাংলিয়ান পোয়েট্রি ১৮২৮-১৯৬৫’তে। পরবর্তী কালে ইংরেজি ভাষায় ভারতীয় মহিলা কবিদের নিয়ে নিবন্ধে (১৯৭৫) নরসিংহ শ্রীবাস্তব নীলিমার লেখায় ‘মিস্টিকাল ইনসাইট’-এর বিশেষ প্রশংসা করেছিলেন। সিগনেটে কবিতার বইয়ের পরেই এল ডিকে-নীলিমার যৌথ অনুবাদে, ‘বেস্ট স্টোরিজ় অব মডার্ন বেঙ্গল’, প্রথম ভাগ। দ্বিতীয় ভাগ বেরোয় ১৯৪৫-এ, আর তার পরের বছর, নীলিমার করা অবন ঠাকুরের ‘ক্ষীরের পুতুল’-এর ইংরেজি অনুবাদ ‘দ্য চিজ় ডল’।

লীলা মজুমদার লিখছেন, “দিলীপের প্রকাশনালয়ে সব লেখা কপি করা হত। বড় বড় খাতায়। অনেক সময়ে নীলিমা দেবীর মুক্তোর মতো হস্তাক্ষরে। সে লেখা যে দেখেছে প্রশংসায় ও আত্মধিক্কারে সে হতবাক হয়েছে।” নীলিমা নিজেই খুব স্পষ্ট করে লিখেছেন ওঁদের লক্ষ্য আর স্বপ্নের কথা। “কী চেয়েছিল সিগনেট প্রেস? চেয়েছিল পাঠক তৈরি করতে, রুচি তৈরি করতে, ছেলেবেলা থেকে সৎ সাহিত্যের জন্য মনকে উৎসুক ও উন্মুখ করে তুলতে।...ভাল লেখা ছাড়া ভাল বই হয় না— এ কথাটা হয়তো এতই স্বতঃসিদ্ধ যে বিশদ করার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এখানেও একটা কথা আছে: বইটা কী ভাবে পরিবেশন করা হবে, সেটাও জরুরি। বই তৈরি করাটাও একটা শিল্প।” সেই শিল্পসাধনার ব্রতেই অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছিল সিগনেট। পরে সিগনেটের স্মৃতিচারণে নীলিমা সহযোগী শিল্পীদের পাশাপাশি মুদ্রকদের কথাও নাম ধরে ধরে উল্লেখ করতে ভোলেননি। ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’র গ্যালি প্রুফ দেখতে এলগিন রোডের বাড়িতে এসেছিলেন জওহরলাল। বিজয়লক্ষ্মীর ‘প্রিজ়ন ডায়েরিজ়’ আর কৃষ্ণা নেহরু হাতিসিং-এর ‘উইথ নো রিগ্রেটস-অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ও ছেপেছিল সিগনেটই। তা ছাড়া অধিকতর পরিচিত বাংলা বইগুলো তো ছিলই। সুকুমার থেকে বিভূতিভূষণ, জিম করবেট থেকে জীবনানন্দ দাশ— বাঙালি পাঠকের দরবারে সযত্নে হাজির করেছিল তারা। বইয়ের দোকান কী ভাবে সাজাতে হয়, দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল সেখানেও। নীলিমার ‘ইনপুট’ কাজে লেগেছিল প্রতি পদে।

পঞ্চাশের দশকের শেষে ডি জে কিমার বন্ধ হল। চাকরি বদলাতে হল ডিকে-কে। সিগনেটের স্বর্ণযুগও ধীরে ধীরে অবসিত হতে শুরু করল। দায়িত্ব অনেকটাই এসে পড়ল নীলিমার একার কাঁধে। এই পর্বেও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভূতপতরির দেশ’ (১৯৬৭) আর ‘খাতাঞ্চির খাতা’ (১৯৭৩), বিষ্ণু দে-র ‘চোরাবালি’ (১৯৬০) আর ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ (১৯৬১), অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘দীপিতার ঘরে রাত্রি’ (১৯৬৫), জীবনানন্দ দাশের ‘মহাপৃথিবী’ (১৯৬৯), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’-র (১৯৬৯) মতো বই বেরিয়েছে। ১৯৭৫-এর পর আর কোনও বই বার করেনি সিগনেট। কঠিন পরিশ্রমে শরীর ভাঙছিল ডিকে-র। এলগিন রোডের বাড়ি ছেড়ে ওঁরা তার আগেই চলে এসেছেন একবালপুরে। ১৯৭৭ সালের এপ্রিলে শিশুসাহিত্য সম্মেলনে যে বক্তৃতা দিলেন নীলিমা, তা ছাপা হল মে মাসে ‘দেশ’ পত্রিকার পাতায়। সিগনেটের ফুরিয়ে আসার সুর সেখানে স্পষ্ট। দিলীপ তখন শয্যাশায়ী। তখনও নীলিমা বলছেন, “দিলীপ আমাকে প্রায়ই বলেন, সত্যজিৎ রায় আরো ঢের বেশি করবেন, আরো চমৎকার কাজ করবেন, বাংলা হরফের নতুন রূপ দেবেন।”

ক’টা দিনই বা গেল তার পর? ১৯৭৭-এর জুন মাসেই চলে গেলেন দিলীপ। নীলিমা বেঁচেছিলেন আরও পাঁচটি বছর। এমন কর্মময় বর্ণময় জীবনের কোনও স্মৃতিকথা রেখে যাননি। এক বার কয়েক পাতা টাইপ করতে শুরু করেছিলেন। তার পর আর এগোননি। পারিবারিক জীবনে নাতি-নাতনিদের জন্য স্নেহ আর যত্নের অন্ত ছিল না। সিনেমা-নাটক-সার্কাস দেখতে নিয়ে যেতেন নিয়মিত। বাংলা-ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে ছোটদের পরিচয় করানোর পাশাপাশি সমান উৎসাহে আওড়াতেন দেশোয়ালি ছড়া— ‘হাতি পর হাওদা আউর ঘোড়ে পর জিন, জলদি আও জলদি আও ওয়ারেন হেস্টিন’! ইন্দ্রাণীর স্মৃতিলিখন আর অশোক মিত্রের নিবন্ধ ছাড়া তেমন ভাবে আলোচিত হননি নীলিমা। সিগনেটের ম্যাডাম থেকে গিয়েছেন নেপথ্যেই।

গ্রন্থ সহায়তা: বিভাব, দিলীপ কুমার গুপ্ত সংখ্যা শীত ১৩৮৬; A Calcutta Publisher’s Daughter / Indrani Dutt, 2017; অশোক মিত্রের লেখা দ্য টেলিগ্রাফ এবং আরেক রকম থেকে; আমার ছেলেবেলা, আমার যৌবন / বুদ্ধদেব বসু

তথ্য সহায়তা: ইন্দ্রাণী দত্ত, সঞ্জিৎ চৌধুরী, অরিন্দম দাশগুপ্ত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Nilima Guha Thakurata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE