রা শিয়ার ভবিষ্যৎটা নাকি একেবারে ঝাঁঝরা হতে বসেছিল এই সব ছেলেমেয়েদের হাতে। পিয়ার্সিং করা ঠোঁট, আজব হেয়ার কাট, কালো-রঙা নখ আর একগাদা আইশ্যাডো-চাপানো চোখ। বোলার হ্যাট, লেদার জ্যাকেট আর তাপ্পি-মারা জিন্স। ‘এমো’ ফ্যাশন। দেশ-বিদেশ ঘুরে মস্কোর মাটিতে এ ফ্যাশন যে-ই না পা রাখল, অমনি রাশিয়ার সরকার উসখুস। এদের ফ্যাশন আর ভাবধারা দেশের পক্ষে মোটেই ভাল নয় তো! আদর্শগুলো কেমন নেতিবাচক। ডিপ্রেশনকে চাগিয়ে তোলে, সমাজ থেকে আলাদা হয়ে একলা থাকায় উসকানি দেয়, আত্মহত্যার জন্য খোঁচাখুঁচি করে। এমন চললে দেশের ভবিষ্যতের দফারফা। সুতরাং, অল্পবয়সিদের মধ্যে এমন ভয়ানক ঝোঁক বন্ধ করতে কড়া হল সরকার। স্কুল-সরকারি ভবনে নিষিদ্ধ হল এমো আর গথ ফ্যাশন। ওয়েবসাইটে চলল তুমুল খবরদারি। সময়টা ২০০৮ সালের মাঝামাঝি।
রাশিয়ার এই ‘দাবায়ে রাখা’র কায়দাটা অবশ্য চেনা। সোভিয়েত যুগ থেকেই যে কোনও বিরোধী স্বর শোনা গেলেই লাল সংকেত বিপ বিপ। হলই বা সেটা ফ্যাশন বা মিউজিকের দুনিয়া। ‘পুসি রায়ট ব্যান্ড’ একটি ফেমিনিস্ট পাঙ্ক রক গ্রুপ। জন্ম ২০১১ সালে। গানের বিষয়গুলোও ছকভাঙা। নারীবাদ তো ছিলই, এলজিবিটি-দের অধিকারও তার মধ্যে ছিল। আর ছিল রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরোধিতা। ব্যান্ডের চোখে পুতিন মানেই সীমাহীন স্বৈরাচার। খোদ প্রেসিডেন্টকে নিয়ে টানাটানি! ফল মিলল হাতেনাতে। ব্যান্ডের দুজন জেলবন্দি। খাতায়-কলমে অপরাধ, ‘হুলিগ্যানিজ্ম’। পুতিনের বক্তব্য, দেশের নীতিবোধগুলোকে স্রেফ উড়িয়ে দিচ্ছে তারা। ফলে যা হয়েছে, বেশ হয়েছে। বিশ্ব জুড়ে হইচই। প্রায় একুশ মাস জেল খেটে তারা ছাড়া পেল।
দেশ-বিরোধী কাজ যেমন মোটে বরদাস্ত করেন না উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং-উন। সরকারের বিরুদ্ধে কোথাও কলকাঠি নড়ছে মনে করলেই অমনি নাকি তাকে খপ করে একরাশ উপোসি, খেঁকি কুকুরের খাঁচায় পুরে দেন, গুরুত্বপূর্ণ সভায় কিমের বক্তৃতার মধ্যিখানে দর্শকের চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়লে বিমান-বিধ্বংসী কামান ছুড়ে উড়িয়ে দেন। তাঁর বাবা, অর্থাৎ আগের শাসক, যখন মারা গিয়েছিলেন, তাঁর শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে রাশি রাশি মিলিটারি গোয়েন্দা ছড়িয়ে পড়েছিল, দেখার জন্য: সবাই ঠিকঠাক হাপুস নয়নে কাঁদছে কি না। যারা কম কেঁদেছিল, বা কাঁদলেও খুব একটা দুঃখ ফোটাতে পারেনি, তাদের জেল হয়েছিল। আর ওখানে জেল হলে সব্বার হয়, মানে গোটা পরিবারের। তাই যদি ছোটমামা কম কাঁদেন, তবে গোটা ফ্যামিলির পরের দিন থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। স্বাভাবিক, যথেষ্ট দেশপ্রেম যার নেই, সে স্বাধীনতা ভোগ করবে কোন অধিকারে! দিন কয়েক আগে কিম ঘোষণা করেছেন, দেশের সব পুরুষকে তাঁর মতো করে চুল কাটতে হবে। আর তাঁর স্ত্রী’র হেয়ারস্টাইল নকল করবে দেশের মেয়েরা। পুরুষদের চুল মোটেও দুই সেন্টিমিটারের বেশি রাখা চলবে না। কেন? ক্যাপিটালিস্ট কায়দাকানুনের ছোঁয়া থেকে দেশকে আগলে রাখার পবিত্র কর্তব্য পালন করছেন তিনি।
তবে সব সরকার এমনধারা নয়। তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। রাতদিন বেয়নেট উঁচিয়ে বসে থাকে না। বরং, এই সরকারেরা দেশকে সত্যি সত্যি ভালবাসতে শেখায়। খুব যত্নে, কোনও রকম জবরদস্তি না করেই এরা সরকারকে, থুড়ি দেশকে জনতার মধ্যে চারিয়ে দিতে চায়। যেমন, এক সময় ফ্রান্স, জার্মানিতে এবং হাঙ্গেরি, ডেনমার্কের মতো বেশ কিছু দেশে আজও ছেলেমেয়েদের নাম ইচ্ছে মতো রাখা যায় না। বাছাই করা নামের সরকারি তালিকা থেকে নাম বেছে রাখতে হয়। অন্য নাম দিতে চাইলে সরকারি অনুমতির প্রয়োজন হয়। নামের মধ্যে দিয়ে অবশ্যই বোঝা যেতে হবে, শিশুটি ছেলে না মেয়ে। এবং সে নামের কোনও নেতিবাচক প্রভাব যেন ওর ওপর না পড়ে, সেটাও দেখতে হবে। এ সব দিকে নজর রাখা ওখানে সরকারেরই কর্তব্য। যেমন, এক সময় হিটলারের জার্মানিতে দু’সেট নাম বেছে রাখা থাকত। এক সেট খাঁটি জার্মানদের জন্য, তাদের আর্য পরিচয় বহনকারী। আর অন্য সেটটি ছিল একেবারেই ইহুদি মানুষদের জন্য। নাৎসিরা অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবধি যা যা করেছে সব ‘দেশের স্বার্থে’ই করেছিল! তাদের নির্বিচারে ইহুদি-নিধন তো, তাদের মতে, এক রকম দেশকে শোধন করারই প্রক্রিয়া ছিল। এক সময় তারা নাকি বহুবিবাহের দিকেও ঝুঁকেছিল। কারণ, তাদের ধারণা হয়েছিল যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তো তারা জিতবেই, কিন্তু যুদ্ধ শেষ হলে, দেশে সেনাবাহিনীতে কাজ করার মতো লোকের আকাল দেখা দেবে। ফলে, খাঁটি জার্মানদের সংখ্যা বাড়ানো বিশেষ জরুরি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমনিতে ভারী উদার দেশ। বাইরের দেশগুলোর ওপর সে যতই জ্যাঠামি ফলাক না কেন, ভেতরের মানুষগুলোকে মোটের ওপর প্রশ্রয়ই দিয়ে থাকে। সর্ব ক্ষণ টুঁটি চেপে রাখে না। কিন্তু ওই সোভিয়েত ভীতির সময়টুকু বাদ দিয়ে। তখন ১৯৫৩ সাল। তীব্র লাল-আতংকে ভুগছে দেশটা। এমন অবস্থায় ইন্ডিয়ানা টেক্সট বুক কমিশন-এর টমাস জে হোয়াইট একটি প্রস্তাব আনেন। প্রভিন্সের সমস্ত স্কুল বই থেকে ‘রবিন হুড’-এর অস্তিত্ব একেবারে মুছে ফেলতে হবে। রবিন হুড কেন? হোয়াইটের সাফ জবাব, আরে, ও তো ধনীদের লুটে সেই পয়সা গরিব মানুষদের মধ্যে বিলোয়। পাক্কা কমিউনিস্ট চিন্তাভাবনা। এ সব কাজকর্ম আসলে আইনের মুখে চাট্টি কালি মাখানো। আর যে কোনও ধরনের আইনবিরোধী কাজই তো কমিউনিস্টদের। শুধু রবিনহুডই নয়, কমিউনিস্ট-ভীতির কারণে মার্কিন মুলুকের পাবলিক লাইব্রেরি আর স্কুলের চৌহদ্দিতে পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে একাধিক বই নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
তাইল্যান্ডে বসে রাজার বিরোধিতা কোনও মতেই করা চলে না। ওটা বেআইনি কাজ। সে দেশে আবার দেশের মুদ্রা পা দিয়ে মাড়িয়ে দেওয়াও বেআইনি কাজ। রাজার ছবি আছে তাতে। সুতরাং মুদ্রায় পা দেওয়া আসলে রাজার মুখে পা দেওয়ারই শামিল। সুতরাং পা নিজ দায়িত্বে রাখুন।
আর এক দেশ আছে। খুব বড় গণতন্ত্র। সেখানে ফ্যাসিবাদ নেই, স্বৈরাচার নেই, প্রতি পাঁচ বছরে ভোট হয়, বিপুল ভোটে জিতে সরকার রাজধানীর মসনদেও বসে। তার পর নেহাতই যারা গণ্ডমূর্খ, সেই সব প্রজাদের পড়ায় জাতীয়তাবাদের অআকখ। শুধু মাঝেমধ্যে কেউ বিপথে যেতে গেলে বা একটু বেশি গলা তুলে ফেললে কানটা মুচড়ে সিধে রাস্তায় নিয়ে আসে। ছাত্রদের মধ্যে যাতে দেশপ্রেম জাগে, সেই জন্য উচ্চশিক্ষার প্রাঙ্গণে তারা জাতীয় পতাকা বসানোর ফরমান দেয়। তার ওজন বড় কম নয়, ৩৫ কেজি। কে না জানে, পতাকা যত বড় আর ভারী, তা দেখে মানুষের মনে চারিয়ে যাওয়া দেশপ্রেমও সমান অনুপাতে বড় আর ভারী! ২০৭ ফুট উঁচু পোলের মাথায় তরতরিয়ে উড়ছে দেশের ঐক্য আর অখণ্ডতা— দিনের পর দিন এই দেখে কোনও পাষণ্ড আর কক্ষনও তুলতে পারবে দেশ-বিরোধী স্লোগান!
futi.chatterjee@gmail.com