ছবি: সুমন চৌধুরী
রাজবাড়ির আলোর লাইন কেটে দিয়েছে! বিল মেটায়নি! জব্বর খবর। পর দিন সকালে রিপোর্টিং করতে রওনা দিলাম রানিগঞ্জে। সিয়ারসোল রাজবাড়িতে গিয়ে দেখি, একে হানাবাড়ি বলাই ভাল। জরাজীর্ণ রাজবাড়ির সামনে একটা রংচটা বড় রথ দাঁড়িয়ে। সারা বাড়ির পলস্তারা খসে পড়েছে। দেওয়ালে বট-পাকুড়। সিংহদরজা ফাঁকা। ভিতরে ঢুকেই নজরে পড়ল, উঠোনে বসে কয়েক জন যুবক তাস খেলছে। চটে যাওয়া পিলারে হেলান দিয়ে রাখা কয়েকটা সাইকেল। পাশ দিয়ে চলে গেলাম সিঁড়ির দিকে। কেউ ভ্রুক্ষেপও করল না। ওপরে উঠে দেখি, বেশির ভাগ ঘরেরই জানলা-দরজা ভাঙা, বারান্দার অনেক জায়গাও ভেঙে পড়েছে। যে ক’টা ঘরের দরজা রয়েছে, সব তালা দেওয়া। সেই সব দরজার কোনওটায় চক দিয়ে লেখা ‘মিলন নাট্যগোষ্ঠী’, কোনওটায় ‘পদধ্বনি নাট্যগোষ্ঠী’, কোথাও ‘বোহেমিয়ান থিয়েটার’।
রাজপরিবারের লোকজনরা কোথায়? নীচে বসে যারা তাস খেলছিল, তারা বলল, ‘এখানে তো কেউ থাকে না। যদি রাজপরিবারের কেউ আসে, গ্রামে ঢুকতেই ডান হাতে যে বড় বাড়িটা আছে, সেটায় থাকে।’ আর দরজায় দরজায় ওই নাটকের দলের ব্যাপারটা কী? ‘এই রাজবাড়িতে আমরা নাটক করি। রিহার্সাল দিই। গোটা সিয়ারসোল গ্রামই নাটক করে। এই তো এখন বাড়ি যাচ্ছি। চান-খাওয়া করে রিহার্সাল দিতে আসব।’
গোটা গ্রামটাই নাটক করে! খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সত্যিই, গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারের এক জন না এক জন নাটকের সঙ্গে যুক্ত। সবাই যে অভিনয় করে তা নয়। কেউ নাটক লেখে। কেউ পরিচালনা করে। কেউ নাটকের জন্য গান লেখে। অনেকেই আছে স্টেজ সাজানো বা আলোর দায়িত্বে।
১৯১৩ সালের সরস্বতী পুজোর দিন থেকে এই নাটক-নেশার শুরু। তখনকার রাজকুমার পশুপতিনাথ মালিয়া নাট্যরসিক ছিলেন। বন্ধুবান্ধব নিয়ে নিয়মিত কলকাতায় থিয়েটার দেখতে যেতেন। নিজে গ্রামে ‘ড্রামাটিক ক্লাব’ তৈরি করলেন। তার পর ওই সরস্বতী পুজোর দিন, রাজবাড়িতে বন্ধুদের নিয়ে করলেন নাটক ‘সিন্ধু-বধ’। বেশি দিন রাজবাড়ির মধ্যে আটকে থাকল না নাটক। গ্রামের সকলেই জড়িয়ে পড়লেন। এই সব যখন জানছি, তখন ১৯৯৭।
১৭ বছর পর, ২০১৪-য়, নাটকের গ্রামের কী অবস্থা, জানতে ফের গেলাম সিয়ারসোল রাজবাড়িতে। চোখ আর মন এক সঙ্গে ধাক্কা খেল। রাজবাড়িটা আর নেই। বিক্ষিপ্ত ভাবে ভাঙাচোরা দেওয়ালের কোনও কোনও অংশ দাঁড়িয়ে আছে। ধ্বংসস্তূপে জন্মেছে বুনো গাছগাছড়া। পাশেই চায়ের দোকান। সেখানে আড্ডা চলছে। সেই আড্ডায় আলাপ হল মধ্যবয়সি সুনন্দ মুখোপাধ্যায়, দীপক শর্মাদের সঙ্গে। সুনন্দবাবু অভিনয় করেন, আর নাটকে আলোকসজ্জার কাজ করেন দীপকবাবু। সিয়ারসোল গ্রাম নাটকেই আছে। না থাক রাজবাড়ি। না থাক রাজমঞ্চ। বা রাজা। রাজবাড়ির পাশে ‘সিয়ারসোল স্পোর্টস অ্যান্ড কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন’ গড়ে তুলেছে কংক্রিটের মঞ্চ। সেখানেই নাটক হয়। যে দলগুলো জীর্ণ রাজবাড়িতে নাটকের মহড়া দিত এখন তারা রিহার্সাল দেয় কোথায়? সুনন্দবাবু বললেন, ‘কেন? বিভিন্ন বাড়িতে, গ্রামের মন্দিরের আটচালায়।’
’৯৭-এই শুনেছিলাম তন্ময় কাঞ্জিলালের কথা। সিয়ারসোল গ্রামের নাট্যচর্চা নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে গবেষণা করছেন। মধ্য-ষাটের তন্ময়বাবু বললেন, ‘এই তো গেল বছর একশো বছর হল। শতবর্ষেও এই গ্রামের ১৯টি দল নিয়ে নাট্যোৎসব হল। উদ্বোধন করতে কলকাতা থেকে এসেছিলেন নাট্যকার ও পরিচালক অশোক মুখোপাধ্যায়।’ শতবর্ষের নাটক শুরুর আগে গ্রামের প্রথম মহিলা অভিনেত্রী প্রদীপ্তা কাঞ্জিলাল দাস বললেন সিয়ারসোলের পুরনো দিনের নাটকের কথা। ১৯১৩ থেকে নাটক শুরু হলেও, ১৯৪৩-এর আগে কোনও মহিলা অভিনয় করতেন না। ওই বছরে ‘সীতা’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন প্রদীপ্তা। এখন অবশ্য গ্রামের বহু মহিলা বিভিন্ন দলে অভিনয় করেন।
একশো বছর আগে বাংলার অন্যান্য গ্রামের মতোই খনি এলাকার গ্রামগুলিতেও পাঁচালি, কীর্তন, কবির লড়াই, যাত্রা হত। থিয়েটার হত শুধু কলকাতায়। কলকাতা থেকে হাত ধরে থিয়েটারকে রাজকুমারই নিয়ে এসেছিলেন। ‘রাজাদের কুলদেবী ছিলেন সরস্বতী। তাই, শ্রীপঞ্চমীর রাতে নাটক করা হত’, বললেন তন্ময়বাবু। ‘তবে, সেই নাটক দেখার সুযোগ গ্রামের সাধারণ মানুষের ছিল না। রাজবাড়ির লোকজন এবং তাঁদের আমন্ত্রিতরাই শুধু নাটক দেখতেন।’ রাজবাড়ির বাইরে গ্রামের মধ্যে নানা জায়গায় গাছে মাইক লাগিয়ে দেওয়া হত। তখন গ্রামের মানুষ ছিলেন নাটকের শ্রোতামাত্র। নাটক শুনে নাটক করার ইচ্ছে জাগল গ্রামের যুবকদের মধ্যে। সেই থেকেই অনেকে কলকাতায় থিয়েটার দেখতে যাওয়া শুরু করল। রাজমঞ্চের পাশাপাশি, মণি বাঁড়ুজ্জের খামারবাড়িতে মঞ্চ তৈরি করে নাটক শুরু করল যুবকরা। তার পর কাঞ্জিলালপাড়ার ঘটকদের বাড়িতেও স্টেজ বাঁধা হল। ‘তবে, রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতা সব সময়েই পাওয়া গেছে। রাজবাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার আগেই পাকা মঞ্চ করার জন্য রাজপরিবার থেকেই জমি দেওয়া হয়। ১৯৯৮-এ তৈরি হল সুবর্ণজয়ন্তী মঞ্চ। উদ্বোধন করেছিলেন মনোজ মিত্র।’
এর পর উঠল নগেনবাবুর কথা। নগেনবাবুর পদবি কেউই জানে না। একশো বছর আগে, রাজমঞ্চে নাটকের জন্য পোশাক আনতে সিয়ারসোলের ছেলেরা যেত কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটে। সেখানেই তাদের আলাপ হল নগেনবাবুর সঙ্গে। নগেনবাবু অবাক, কলকাতার বাইরে থিয়েটার! তাও আবার খনি এলাকার গ্রামে! এক দিন তিনি সটান চলে এলেন সিয়ারসোলে। তার পর দীর্ঘ দিন এখানে থেকে অভিনয়, পরিচালনা ইত্যাদি শেখাতে লাগলেন গ্রামের যুবকদের। রাজবাড়ির পাকা মঞ্চে ১৯৪৪ সালে গ্রামের ছেলেরা ‘টিপু সুলতান’, ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’, ‘মিশরকুমারী’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘উল্কা’র মতো নাটক মঞ্চস্থ করল।
তন্ময়বাবু বললেন, ‘সে কালে গিরীশ ঘোষ, শিশির ভাদুড়িরা সিয়ারসোলের নাটককে প্রভাবিত করেছিলেন। তখন সামাজিক, পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক গল্প নিয়ে নাটক করা হত। পরে, সত্তরের দশকে কলকাতার গ্রুপ থিয়েটারের প্রভাব এসে পড়ে। ‘মারীচ সংবাদ’, ‘ব্যারিকেড’, এইগুলো হত। এখানে উৎপল দত্ত, শোভা সেন, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভাস চক্রবর্তী, অরুণ মুখোপাধ্যায়, নীলকণ্ঠ সেনগুপ্তরা এসে নাটক নিয়ে আলোচনা করে গেছেন। ওয়ার্কশপও করেছেন।’
সিরিয়াল এসে এই নাটকের উৎসাহ খেয়ে নেয়নি? ‘উঁহু’, বললেন তন্ময়বাবু, ‘গ্রামের উঠতি ছেলেমেয়েরা আজও আগের মতোই নাটক নিয়ে পাগলামি করে। এখন গ্রামের গ্রুপগুলো বাইরে গিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়, পাশাপাশি কল-শো’ও পায়।’ আজকের যুগে এ ভাবে গ্ল্যামার-হীন একটা শিল্পে জানপ্রাণ দিয়ে পড়ে থাকা! কীসের মহিমায় সম্ভব হল? শুরুর লগ্নের ওই সরস্বতীপুজো? না ওই অমোঘ সাল: ১৯১৩?
sukanto2008@gmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy