Advertisement
E-Paper

আগুন আমার ভাই

বাংলাদেশে ব্লগাররা রোজই হুমকি পাচ্ছেন, খতম তালিকায় তাঁদের নাম দেখছেন। কিন্তু তাতে তাঁরা থামছেন না, দমছেন না। বেঁচে থাকা ও প্রতিবাদ করার নতুন ব্লুপ্রিন্ট গড়ে নিচ্ছেন।সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বেজে গিয়েছে। সদ্য বাড়ি ফিরেছেন তিনি। দিনের আলো নেভার পরে যাতে কোনও ভাবেই বাইরে না থাকেন, সে ব্যাপারে পুলিশ সতর্ক করে দিয়েছে বার বার। কিন্তু সে সব আর মানছেন কই?

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০৩

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বেজে গিয়েছে। সদ্য বাড়ি ফিরেছেন তিনি। দিনের আলো নেভার পরে যাতে কোনও ভাবেই বাইরে না থাকেন, সে ব্যাপারে পুলিশ সতর্ক করে দিয়েছে বার বার। কিন্তু সে সব আর মানছেন কই?

শাহবাগে সে দিন সন্ধ্যায় জমায়েত ছিল ব্লগারদের। পোশাকি নাম ‘মুক্তচিন্তার সংহতি সমাবেশ’। জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক আরেফিন ফয়জল দীপনকে খুনের প্রতিবাদে ডাকা ওই সমাবেশে মূল বক্তা তিনি, অজয় রায়। মৌলবাদীদের হাতে নিহত বিজ্ঞান লেখক, ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বৃদ্ধ বাবা। যিনি জানেন, তাঁর ওপরেও আঘাত আসতে পারে যে কোনও দিন, যে কোনও সময়েই।

বাড়ি ফিরে এক কাপ চা হাতে নিয়ে ধীর পায়ে সোফায় বসলেন বৃদ্ধ অধ্যাপক। বললেন, ‘আমি তো আমার ছেলেকেও বলেছিলাম, এ দেশে এখন তোমার প্রতি পদে বিপদ। যত দিন এখানে থাকছ, যেখানেই যাও, ছ’টার মধ্যে বাড়ি ঢুকবে। অন্য দিন শুনত, শুধু সে দিনই শোনেনি। আড্ডাবাজ ছেলে তো! বইমেলায় গিয়ে আড্ডায় মজে গিয়েছিল। আর বাড়ি ফিরতে পারল না। অবশ্য বাড়িতে এসেও ওরা খুন করে যেতে পারত।’

এ বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি, বইমেলার বাইরের রাস্তায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে মৌলবাদীরা কুপিয়ে খুন করেছিল বাংলা ব্লগ ‘মুক্তমনা’র স্রষ্টা অভিজিৎকে। সেই রাতে ছেলের মৃতদেহ দেখে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পাঁচ মিনিটের মধ্যে হুমকি ফোন পান অজয়। এক বার ফোন কেটে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফের ফোন। ফের হুমকি।

বসার ঘরে সোফার ঠিক পিছনের দেওয়ালেই ছেলের একাধিক ছবি। কোনওটায় ছেলে একা। কোনওটায় সঙ্গে তার স্ত্রী-কন্যা। কথার ফাঁকে পদার্থবিদ্যার নামী অধ্যাপকের চোখ বার বার চলে যাচ্ছিল সে দিকে। বললেন, ‘এই মুহূর্তে যে কোনও সুস্থ চিন্তার বাংলাদেশির পক্ষে যা করা সম্ভব, আমিও সেটাই করছি। এটা ব্যতিক্রম নয়। আলাদা করে প্রশংসারও নয়। এটাই একমাত্র পথ।’

দেশের পুলিশ তাঁকে ভিআইপি নিরাপত্তা দিতে চেয়েছে। রাজি হননি। বলেছেন, ‘সারাটা জীবন ভয় পাইনি। এখন শেষ বয়সে ভয় পেয়ে গুটিয়ে থাকব? আমাদের ভয় পাওয়ার অর্থ ওদের জিতিয়ে দেওয়া। সেটা কী ভাবে হতে দিই?’ মৌলবাদীরা দিন কয়েক আগেই খুন করেছে প্রকাশক দীপনকে। দীপনের বাবা হাসপাতালে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘আমি বিচার চাই না। কারণ আমি জানি, বিচার হবে না কোনও দিন।’

বিচারের ভরসা নেই বাংলাদেশের অধিকাংশ ব্লগারেরই। বাংলাদেশের বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠন তাদের খতম তালিকা তৈরি করেছে। কোথাও ৫০ জন, কোথাও ৬০, কোথাও ৮০ জন ব্লগারের নাম। কিন্তু তাতে কেউই খুব দমছেন না। খতম তালিকায় একদম ওপর দিকে ইমরান এইচ সরকারের নাম। তিনি প্রতিবাদী সংগঠন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র। পেশায় চিকিৎসক। চাকরি করতেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। যে দিন শাহবাগ আন্দোলনের প্রথম বড় সভা হল, সে দিনই চাকরিতে ইস্তফা দেন। কারণ ‘সরকারি চাকরিতে থেকে এই প্রতিবাদের রাস্তায় হাঁটা যেত না।’ এখন পেশাগত জীবন মাথায় উঠেছে। ধ্যানজ্ঞান সবটা জুড়েই মৌলবাদ বিরোধী লেখালেখি। ভয় করে না? হিট লিস্টে নিজের নামটা দেখা অভ্যাস হয়ে যাওয়া তরুণ পালটা প্রশ্ন করলেন, ‘এই লড়াই কি নতুন কিছু? মুক্তিযুদ্ধে আমাদের যাঁরা পূর্বসূরী ছিলেন, তাঁরা তো আমাদের চেয়ে অনেক বড় লড়াই করে গেছেন। ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছেন!’

ব্লগারদের সংগঠনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। কী ভাবে তৈরি হয় নতুন নতুন ব্লগার? যাঁরা নিজে থেকে লিখতে উৎসাহিত হন তাঁরা তো রয়েছেনই, পাশাপাশি খোঁজও চলতে থাকে। ঢাকার একটি স্কুলের ম্যাগাজিনে ক্লাস নাইনের এক ছাত্রের লেখা পড়ে চমকে গিয়েছিলেন ব্লগাররা অনেকেই। খোঁজ করে জানতে পেরেছিলেন, মৌলবাদ-বিরোধী লেখাটি আদৌ ছাপা হবে কি না, তা নিয়ে দ্বিধা ছিল শিক্ষকদের অনেকেরই। শেষ পর্যন্ত দু’তিন জন শিক্ষকের জোরদার চেষ্টায় লেখাটি ছাপা হয়। এর পরেই বেশ কয়েকটি সংগঠন যোগাযোগ করে ছেলেটির সঙ্গে। তার বাড়িতে যাওয়া হলে ভয় পেয়ে যান বাবা-মা। জানিয়ে দেন, তাঁদের ছেলে আর কোথাও লিখবে না। কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে এর পর ছেলেটি নিজেই যোগাযোগ করে একটি ব্লগের মূল লেখকের সঙ্গে। নাম বদলে নিয়ে এখন নিয়মিত লিখছে সে। তার লেখা তারিফ কুড়িয়েছে বাংলাদেশের বাইরেও। ভয় করে না? জানতে চাওয়া হলে ছেলেটি শুধু হাসে। জবাব দেয় না।

কোথাও একটিও লেখা প্রকাশ হয়নি, কোনও সভায় একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি, এমন অনেকেও আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদেরই এক জন মীরাজ্জুমান। এঁর বন্ধু নিয়মিত ব্লগার। আপাতত লন্ডনের বাসিন্দা সেই বন্ধুকে না পেয়ে তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু মীরকেই আক্রমণ করেছিল মৌলবাদীরা। তাঁর বাঁ হাতের একটি আঙুল কেটে নিয়েছে তারা।

মহিলা ব্লগারের সংখ্যাও ক্রমশ বাড়ছে বাংলাদেশে। চট্টগ্রামের এক লাঞ্ছিতা তরুণী টেলিফোনে জানিয়েছেন তাঁর প্রতিবাদের কথা। শাহবাগের সভায় টানা তিন সপ্তাহ হাজির ছিলেন তিনি। বক্তৃতাও দিয়েছেন। চট্টগ্রামে এক সন্ধ্যায় টিউশন সেরে বাড়ি ফেরার পথে তাঁকে ধাওয়া করে ধরে ফেলে দুষ্কৃতীরা। চার-পাঁচ জন মিলে ঘিরে ফেলে চলতে থাকে উল্লাস। তরুণী বললেন, ‘ওরা একটাই কথা বলছিল। আমি নষ্ট হয়ে গিয়েছি। তাই আমার বাঁচবার অধিকার নেই।’ আচমকাই ওই এলাকায় একটি পুলিশের গাড়ি এসে পড়ায় সে যাত্রা রক্ষা পান তিনি। আপাতত ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া মেয়েটি মৌলবাদবিরোধী সব সভায় নিয়মিত হাজির হচ্ছেন। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটেও চলছে তাঁর প্রতিবাদী লেখালিখি। বললেন, ‘ভয় আগে ছিল। সেই রাতের পরে ভয়টা কেটে গিয়েছে। আমি জানি কী হতে পারে, কত দূর হতে পারে।’

কী ভাবে মহিলাদের দমানোর চেষ্টা হয়? জানা গেল, সাধারণত সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট থেকে তাঁদের ছবি নিয়ে ফোটোশপে নানা কারিকুরি করে অশ্লীল ভঙ্গিতে তা ছাপানো হয়। তার পর সেই ছবি পোস্টারের মতো সেঁটে দেওয়া হয় মেয়েটির পাড়ায়, কলেজে, এমনকী পাঠানো হয় আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও। বিভিন্ন সম্পর্কের কথা রটিয়ে কুৎসা ছড়ানোও চলে। শাহবাগ আন্দোলনের সময়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এক সঙ্গে পথে রাত্রিবাস করেছেন দিনের পর দিন, তখন রটানো হয়েছে, আন্দোলনের নামে মঞ্চের পিছনে নেশাভাং চলছে, শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছে ছেলেমেয়েরা।

‘হিট লিস্ট’-এ থাকা বহু ব্লগার পুলিশের কাছ থেকে নিরাপত্তা পান না। অথচ নিয়মিত বেরোতেই হয়। কী করেন? এক ব্লগার বললেন, ‘আমার আবাসনের নিরাপত্তারক্ষীকে বেরনোর কিছু ক্ষণ আগে ফোন করি। ফোন করি পাশের এক দোকানদারকেও। জানতে চাই আশপাশে সন্দেহজনক কোনও লোকজন ঘোরাফেরা করছে কি না। দুজনেই ‘না’ বললে, তার পর বেরোই। নিজস্ব গাড়ি ছাড়া যাতায়াত করি না।’

এক ব্লগার আরিফ নূর। শাহবাগের সভা থেকে ফেরার পথে অন্ধকার রাস্তায় তাঁকে ঘিরে ফেলে চাপাতি দিয়ে কোপাতে শুরু করেছিল এক দল লোক। মাথা সহ শরীরের অন্যান্য অংশে ৩২টা আঘাত ছিল। কিন্তু প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। মারতে মারতে তাঁকে যখন আধমরা করে ফেলা হয়েছে, তখনই এক দল লোক ওই রাস্তায় এসে পড়ে। পালিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা।

আর একটা চেষ্টাও চলছে। ব্লগার-হত্যার ঘটনাগুলিকে ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে খুন বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। তদন্ত এগোয় না বলে সেই প্রচারে সুবিধাও পেয়ে যায় দুষ্কৃতীরা। ব্লগার নেতা ইমরান এইচ সরকার জানান, বিচার তো দূরের কথা, একটি ক্ষেত্র ছাড়া বাকিগুলিতে চার্জশিটই দিতে পারেনি পুলিশ। শুধু মাত্র ব্লগার রাজীব হায়দারের ক্ষেত্রে চার্জশিট হয়েছে। সেখানে ধরা পড়েছে, আক্রমণকারীরা মৌলবাদীই ছিল।

এক দিকে মৌলবাদ, অন্য দিকে সরকারি নিস্পৃহতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ব্লগাররা। ঠিকানা বদলাচ্ছেন, ফোন নম্বর বদলাচ্ছেন, কিন্তু মূল যে কাজটা করছেন, তা হল: ভয় না-পাওয়া শিখছেন। দীপন খুন হওয়ার পরের দিন সকালে তাঁর ছেলে রিয়াদের স্কুলের পরীক্ষা ছিল। চোখের জল সামলে সেই পরীক্ষায় বসেছে সে। তাকে স্কুলে এগিয়ে দিয়েছেন তার মা, রাজিয়া রহমান জলি। রাজিয়া জানালেন, থেমে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। দীপনের লড়াই তাঁরা চালিয়ে যাবেন। মৌলবাদ-বিরোধী বই ছাপা থামবে না।

এই আগুনের জয় হবেই, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়।

somatitas@gmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy