Advertisement
E-Paper

আগে হেমা এখন এ মা!

চ‌ন্দননগর হেরে গেল। এ বার উত্তর কলকাতায় জগদ্ধাত্রী পুজোও হল ছ’দিন ধরে। ধুনো-আগুন উড়িয়ে পুজো এক দিনই, শুক্রবার। কিন্তু মঙ্গলবারই ঠাকুর চলে এলেন। পরনে কোনও ক্রমে জড়ানো জরি ওঠা শাড়ি, হাতা ছেঁড়া ব্লাউজ, বাচ্চাদের মতো পাকানো মুঠি। খালি, তাতে অস্ত্রশস্ত্র নেই। সর্বোপরি ন্যাড়া মাথা। সঙ্গে এক গাদা মিস্ত্রি। তারা মায়ের কাঁধে পিঠে উঠে গদাম গদাম পেরেক ঠুকে চুল, মুকুট আটকাতে লাগল, শাড়ি ব্লাউজ সেলাই করতে লাগল সবজেটে আঠা দিয়ে।

চিরশ্রী মজুমদার

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৫ ০১:০০
ছবি: সুমন বল্লভ

ছবি: সুমন বল্লভ

চ‌ন্দননগর হেরে গেল। এ বার উত্তর কলকাতায় জগদ্ধাত্রী পুজোও হল ছ’দিন ধরে। ধুনো-আগুন উড়িয়ে পুজো এক দিনই, শুক্রবার। কিন্তু মঙ্গলবারই ঠাকুর চলে এলেন। পরনে কোনও ক্রমে জড়ানো জরি ওঠা শাড়ি, হাতা ছেঁড়া ব্লাউজ, বাচ্চাদের মতো পাকানো মুঠি। খালি, তাতে অস্ত্রশস্ত্র নেই। সর্বোপরি ন্যাড়া মাথা। সঙ্গে এক গাদা মিস্ত্রি। তারা মায়ের কাঁধে পিঠে উঠে গদাম গদাম পেরেক ঠুকে চুল, মুকুট আটকাতে লাগল, শাড়ি ব্লাউজ সেলাই করতে লাগল সবজেটে আঠা দিয়ে। কিন্তু, কেন? প্যান্ডাল হয়েছে আদ্ধেক, পোশাক আলুথালু, এমন আনতাবড়ি অবস্থায় মা আছড়াতে আছড়াতে কুমোরটুলি থেকে ছুটে এসেছেন কেন? বোঝা গেল সাইরেনের শব্দে। শহর ‘স্টপ’ করে মুখ্যমন্ত্রী এলেন ও পুজো শুরু করে দিয়ে গেলেন। যাচ্চলে! দিদির ডায়েরিতে যখন অ্যাপয়েন্টমেন্ট, তখনই তো আসতে হবে। রেডি নই বললে হবে! তা, এত আগে এসে মা কী করবেন? কেন, দেখবেন। বুধবার নেতাদের জগদ্ধাত্রী টপিকে বক্তৃতা, বৃহস্পতিতে শিশু শিল্পীদের ডিস্কো ডান্স, শুক্রবার সকাল থেকে পুজোকমিটির একশো জন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারির অঞ্জলি নির্ঘণ্ট ঘোষণার জন্য মাইক নিয়ে কাড়াক্কাড়ি, তৎসঙ্গে গোলগাল পুরুতবাবাজির খটংমটং মন্ত্রপাঠ। এ বছর নাকি তিনি সান ফ্রান্সিসকোয় দুর্গাপুজো করতে গেছিলেন। তার পর থেকেই নতুন অ্যাকসেন্টে উচ্চারণ করছেন। চার দিন ধরে এক পোজে একা ঠায় দাঁড়িয়ে টেরিয়ে টেরিয়ে এ সব দেখতে দেখতে ঠাকুরেরই স্টিফ নেক হয়ে গেল। অঞ্জলির ফুল ছুড়তে গিয়ে ঠাকুর দেখে সবাই হাঁইহাঁই করে উঠল। ঘাড় বেঁকে আছে, ঠাকুর কুঁজো হয়েছে। এক জন বকল, বলতে নেই, নমো করো। আর এক জন হাই তুলল। কোন গণেশ পুজো থেকে মূর্তি গড়া চলছে। কুমোর কি আর পারে? টায়ার্ড হয়ে গেছে। সেও তো মানুষ।

জগদ্ধাত্রী ইন। মানে আর একটা দুর্গাপুজো। আর একটা জ্যাম-পঞ্চমী। এই গিয়েই তিনি আবার কেন ফেরত আসেন, হাতি আর সিংহ দুটোতেই কেন চাপেন, হাতিটাকে সিংহ থাবা দিয়ে মেরে আধমরা করে রক্ত বের করে দিলেও কেন মা হয়েও কিছু বলেন না, মানেকা গাঁধীই বা কেন মনে করিয়ে দেন না, হাতি গরু নয় বলে কি— কারও কাছে এ সব জরুরি প্রশ্নের সদুত্তর পাই না। শুধু অভ্যাস হয়ে গেছে বলে বনবন করে ঠাকুর দেখি। মুখ অনেকেরই চ্যাপ্টা। দু’চোখের মণি নাকের কাছে, একটু লক্ষ্মীট্যারা না হলে সুন্দর মুখ হয় না। কোথাও সত্যজিতের ‘দেবী’ সিনেমার পোস্টারের মতো দেখতে ঠাকুর। তিনটে চোখওয়ালা। পেতলের তিব্বতি প্রতিমারাও আছেন। এক সিংহ রোগা ও বুড়ো। কেশর কমে গেছে, এক-একটা চোখের পাতা ও গোঁফের রোঁয়াগুলোর মধ্যে দশ হাত করে ফাঁক। সেগুলো যেমন মোটা তেমনি কটকটে সাদা। কোথাও কোথাও অবশ্য সিংহের মাথাতেও মুকুট। সত্যিকারের ভক্তি না থাকলে বাহনকে এতটা রেসপেক্ট করা যায় না!

এক্ষুণি আসা বেসরকারি হিসেব বলছে দুর্গাপুজো হয়েছে ছাব্বিশ দিন। কারণ, অক্টোবর মাস শুরু হতে না হতেই তো ঠাকুর দেখা স্টার্ট। প্রযত্নে দি গ্রেট ___ পার্ক। তাদের বড় ঠাকুরের শিং, সরি, মুকুট তো তখন থেকেই শহরের যে কোনও দশতলার মাথা থেকে দেখা যাচ্ছিল। চাঁদ থেকেও দেখা যাচ্ছিল নিশ্চয়ই। তবুও আমি প্রথমে ওঁকে দুর্গা বলেই চিনতে পারিনি। ভেবেছি অজন্তা-ইলোরার ধাঁচে প্যান্ডাল হচ্ছে, তাতে খয়েরি রঙের যক্ষিণী খোদাই করছে। মোষের মাথার ওপর ব্যালান্স করে দাঁড়িয়ে আছেন ঠাহর হতে তবে চিনলাম। তবু রোজই রাসবিহারী দিয়ে ফিরতাম আর অবাক হতাম যে এমন বেঢপ মূর্তি করছে কেন? শরীরের আন্দাজে হাত পাগুলো এইটুকু পুচকে পুচকে। তা কোনও উমদা শিল্পরীতিতে বানানো হবে, পার্কে ঢুকে কাছ থেকে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ তো আর হল না।

আগেকার দিনে মা দুর্গাকে নাকি সোজাসাপটা হেমা মালিনীর মতো দেখতে করত। কিংবা জয়া প্রদা। লক্ষ্মীরা সব শ্রীদেবী। সরস্বতী মহুয়া। কিন্তু এঁদের তো আর সুদিন নেই। হেমা মালিনীর তো আবার সুনামটুকুও গেল। তাই এ বারে সে রকম সহজ কিছু পাইনি। তবে প্রচুর গণেশ দেখলাম ভিনগ্রহী জীবের মতো হয়েছে। মুখের দু’দিকে কানের কাছাকাছি সুরমা টানা দুটো করে চোখ, এস্থেটিকালি যামিনী রায়, কিন্তু টেকনিকালি ই.টি.। মানে, তার মুখে শুঁড় আর বডিতে মস্ত পেট বসিয়ে দিলে যেমন হবে। শুধু মাথায় চোঙের মতো মুকুটটার বদলে দুটো অ্যান্টেনা লাগিয়ে দিলে ষোলোকলাবউ পূর্ণ হত। শিয়োর কোনও সায়েন্স ফিকশনের ভক্ত ইয়াং পালমশাইয়ের গুদাম থেকে এরা বেরিয়েছে।

জমানা চিরকালই অসুরের। ব্রিটিশ যুগে নাকি কখনও-সখনও সায়েবের মুখ বসানো হত অসুরের ধড়ে, তার পর হিটলার, মগনলাল মেঘরাজ, অমরীশ পুরী, সাদ্দাম হুসেন, লাদেন, গ্রেগ চ্যাপেল সব সাজা শেষ। এখন সিক্স প্যাকস, এইট প্যাকস, পার্ম করা চুল, ট্রিম করা গোঁফ, ওয়াক্স করা মাসল। কাউন্ট ড্রাকুলার মতো জেল দিয়ে ব্যাকব্রাশ ছাঁট। দক্ষিণ কলকাতারই এক মাঝারি প্যান্ডালে অসুর এসেছিলেন মহেন্দ্র বাহুবলী সেজে। নিশ্চয়ই লাস্ট মোমেন্টে মহারাষ্ট্রের গণেশ পুজো দেখে টুকেছে। সেখানে তো এ বার সব গণেশ মণ্ডপে দাঁড়িয়ে ছিল বাইসেপ ফুলিয়ে, কাঁধে শিবলিঙ্গ নিয়ে। এই অসুরের ঘাড়ে শিব নেই, কিন্তু শিয়োর একাধিক মাথা আছে। দুর্গার হাতের বর্শাটা তার বুক ফুঁড়ে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে মাটিতে গেঁথে গেছে, তবু অসুরটা কুছ পরোয়া নহি টাইপ একটা হিরো লুক নিয়ে দুর্গাকে দেখছে! যেন ওই বর্শাপোরা বুকেই জার্ক মেরে উঠে ‘য়েই মদন চোপড়া’ বলে দুর্গাকে তাড়া করবে। অবশ্য মানতেই হবে, প্রচুর পুজো কমিটি অস্ত্র ও হিংসার বিরোধী। তাদের দুর্গাদের দশ হাতে ফুল, মাথায় ফুল, নাকে ফুল, পায়ের কাছে অসুর বাবুসোনা হয়ে বসে। হাত জড়ো বুকের কাছে। তাতেও এক খাবলা নীল সাদা ফুল। এ সব ঠাকুরের সিংহকে সব সময় কাঠের ঘোড়ার মতো দেখতে হয়। কিন্তু, প্যান্ডালে দুর্গাপরিবারের ছেলেমেয়েদের কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শেষে দেখলাম তাদের ঠাকুরের পিছনের দেওয়ালে কুলুঙ্গিতে তুলে রাখা হয়েছে। এক ফুট সাইজের। অস্ত্রও বাদ, সাপোর্টিং কাস্টও বাদ! বাজেট কি কম পড়িয়াছিল? না কি আর্ট বেশি পড়িয়াছিল?

আজকাল থিমের উলটো দিকের একটা হাওয়াও উঠেছে। সাবেক টাইমের মতো ঠাকুর করব, আমরা বাবা কনজারভেটিভ! এক দিক থেকে ভাল। থিম আমি কিছুতে বুঝে উঠতে পারি না। কারা যে রাজস্থান করল, কে যে ট্রাইবাল ঠাকুর, কার ঠাকুর কেন পঞ্জিকার ওপরে দাঁড়িয়েছিল, কার প্যান্ডালে গুচ্ছ গুচ্ছ পুতুল দুলছে, কোন প্যান্ডালের সামনে জায়েন্ট বাচ্চা শুয়ে রয়েছে, কোথায় দুর্গা শূন্যে উড়ছেন, কোথাও কেন একটা বিশাল হাঁয়ের মধ্যে ঢুকছি, কোথাও কেন ছোটা ভীম লাগিয়েছে অথচ হাতটুকুও বুলোতে দিচ্ছে না— কেউ কোত্থাও গুছিয়ে লেখে না কী করেছে। যদিও বা লেখে, দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে পড়তে দেবে না। চলুন চলুন এগোন এগোন হ্যাট হ্যাট। অনেকের হাতে লাঠিও থাকে। আরে, ও রকম ভেড়াতাড়ার মধ্যে মাথা কাজ করে কখনও! কষ্ট করে করলি, দেখতে দিবি না? তা ছাড়া শিবঠাকুরের পরিবারে এতগুলো লোক। প্রত্যেককে বাহন সমেত নমস্কার করতেই তো কম করে আধমিনিট লাগবে। অবশ্য এ বার দেখলাম ঠাকুর-নমস্কার একেবারে উবে গিয়েছে। তার বদলে চালু হয়েছে প্রতিমার সঙ্গে সেল্‌ফি নেওয়া।

টালা ট্যাংকের কাছে একটা পুজো দেখতে গিয়ে স্বস্তি পেলাম। থিমটা এখানে পরিষ্কার করে এবং বড় বড় অক্ষরে লিখে দিয়েছে। প্যান্ডাল দেখে আন্দাজও করা যাচ্ছে। ঢুকতেই ট্যাঁশগরু। হাতিমি। সিংহরিণ। গিরগিটিয়া। আর একটু এগোতে প্রাণ খুশিতে টগবগ। ভেতরে বিখ্যাত হলিউড ছবি ‘এক্স-মেন’ সিনেমার মিউটেন্টস। ‘অবতার’ সিনেমার আত্মার গাছ। মণ্ডপসজ্জায় শুক্রাণু আর ডিম্বাণু চিহ্ন! তার সঙ্গে প্ল্যাকার্ড— দেবী এখানে হাইব্রিডাসুরমর্দিনী। ভেজালের পৃথিবীতে সুকুমার রায়ের নির্মল কল্পনাগুলো বিষধর সত্যি হয়ে যাচ্ছে। আজ এটার সঙ্গে সেটা জবরদস্তি মিশিয়ে উদ্ভট মিশেল তৈরি হচ্ছে। কলার মধ্যে মাছের গন্ধ। মানুষের খোকার মুখে সাপের জিভ। বিবর্তন এ কোন ভয়ানক রাস্তায় চলেছে। এমন করেই তো দৈত্যরা ফিরে আসবে মাটিতে! সাংঘাতিক হাই-থটের থিমটা বুঝতে পেরে নিজের পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে বেরিয়ে আসছি, দেখি এক হোমরাচোমরা বাবা কলেজ-পড়ুয়া ছেলেকে বলছেন, বুঝলি, আমেরিকার চিড়িয়াখানা করেছে। ট্যাটুশোভিতা মা ক্লাস ফাইভকে বকচ্ছপ চেনাচ্ছেন, ‘ওই দ্যাখো ডাইনোসর!’। এত দিনে বোধি লাভ হল, আসলে থিম-টিম, সবচেয়ে বড় দুর্গা, সবচেয়ে বড় সত্যি, বড় ফুল, মায়ের আবার ছোট-বড়, ওরে মা কি তোদের একার— এ সকলই মায়া। দুর্গা, কালী, ছট টু জগদ্ধাত্রী— কলকাতায় সব পুজোই প্রতি বার ঝাড়েবংশে জুরাসিক পার্কই বানায় আসলে।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy