Advertisement
E-Paper

আমি কি মনিষ্যির মতো মনিষ্যি

আমার হবু বউ তখন হুগলির এক গাঁয়ের স্কুলে শিক্ষকতা করে। হাওড়া থেকে বর্ধমান মেন লাইনে লোকাল ট্রেনে ঘণ্টা দেড়েকের পথ। স্টেশনে নেমে এক মাইল হাঁটা পথ। এখন ভাবলে যতটা দূর বলে মনে হয়, তখন কাঁচা বয়সে তা মনেই হত না। প্রতি রোববার হয় আমি গিয়ে হাজির হতাম, নয়তো সে চলে আসত কলকাতায়।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৬ ০০:০০

আমার হবু বউ তখন হুগলির এক গাঁয়ের স্কুলে শিক্ষকতা করে। হাওড়া থেকে বর্ধমান মেন লাইনে লোকাল ট্রেনে ঘণ্টা দেড়েকের পথ। স্টেশনে নেমে এক মাইল হাঁটা পথ। এখন ভাবলে যতটা দূর বলে মনে হয়, তখন কাঁচা বয়সে তা মনেই হত না। প্রতি রোববার হয় আমি গিয়ে হাজির হতাম, নয়তো সে চলে আসত কলকাতায়। আর তখন রোববারের জন্য সে কী হা-পিত্যেশ! ও ভারী মিশুকে মানুষ। যেখানে কাজ করত, সেখানকার ভূমিকন্যা সে নয়। তবু কয়েক মাসের মধ্যেই গ্রামের অনেক পরিবারের সঙ্গে তার দিব্যি ভাবসাব। মাসি-মেসোমশাইয়ের অভাব ছিল না।

তখন মোবাইল দূরস্থান, ল্যান্ডলাইন ফোনও আমাদের কাছে আকাশের চাঁদ। প্রেমিক-প্রেমিকাদের সে বড় সুখের দিন ছিল না। তাদের মাঝখানে লম্বা লম্বা বিরহ ও নীরবতা বিরাজ করত। শুধু এটুকু বলতে পারি, লম্বা বিরহের পর দেখা হলে ভারী ঝলমলে লাগত। বাড়তি আলো এসে পড়ত। বাড়তি রঙের ঢেউ খেলে যেত, এবং লজ্জাটজ্জাও হত একটু-আধটু। তা, এক দিন আমার হবু আমি যেতেই ভারী ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলল, ওগো, সামনের রোববার আমি কলকাতায় যেতে পারব না। কিন্তু তোমাকে আসতেই হবে। জরুরি দরকার।

আমি তটস্থ হয়ে বলি, দরকারটা কীসের?

অতিশয় উত্তেজনার সঙ্গে সে যা বলল, তা থেকে বুঝলাম, জনৈকা মাসিমার বয়স্থা কন্যার বিয়ের সম্বন্ধ এনেছে গাঁয়ের ঘটকী। পাত্র নাকি বেজায় ভাল। কিন্তু কানাঘুষো শোনা গেছে, পাত্র বুড়ো। ঘটকী অবশ্য বলছে যে, ও সব বাজে কথা। পাত্রের বয়স মোটে পঁয়ত্রিশ।

সামনের রোববার পাত্র পাত্রীকে দেখতে আসছে। মাসিমা বিধবা মানুষ, সহায়-সম্বল নেই। তাই আমার হবুকে ধরেছেন, কনে দেখার সময় সে যেন হাজির থাকে। হবু বলেছে, সে তো থাকবেই। সেই সঙ্গে আমিও।

কিন্তু আমার ভূমিকা সেখানে কী হবে?

বাহ্! তুমি না পুরুষমানুষ! এক জন পুরুষমানুষ হাতে থাকা ভাল।

বুঝতে পারলাম না, বুড়ো পাত্রটি কন্যাহরণ করে নিতে আসছেন কিনা লাঠিসোঁটা নিয়ে। আর আমার তো বীর হিসেবে কোনও খ্যাতি নেই, ডাকাবুকোও নই, বলিয়ে-কইয়েও নই। কিন্তু প্রেম পর্যায়ে কাগজের বাঘও হালুম গর্জন ছাড়ে। তাই রাজি হতে হল।

পরের রোববার মাসিমার বাড়িতে দুপুরে সমবেত হয়ে দেখলাম, অবস্থাটা বেশ বজ্রগর্ভ।

ছোট একটি ঘরের ভিতরকার দৃশ্যটা অনেকটা এ রকম: ত্রিশোর্ধ্ব একটি মেয়ে খুব সাজগোজ করে, লিপস্টিক-কাজল-টিপ-ঝলমলে শাড়িতে সেজে বসে আছে একটা চৌকিতে। সে একটুও সুন্দর নয়। কিন্তু তার দৃষ্টিতে তীব্র আক্রোশ, এবং সে ফুঁসছে। পাশে করুণ মুখে মধ্যবয়স্কা এক বিধবা মহিলা দাঁড়িয়ে। আর দরজার কাছে মজবুত, চালু চেহারার এক মহিলা বেশ তেজালো গলায় ভাষণ দিচ্ছে, ওগো বলছি তো পাত্তরের বয়স পঁয়ত্রিশের একটি দিনও বেশি নয়। দাঁতও পড়েনি, চুলও পাকেনি। পঞ্চাশ বিঘের ওপর জোতজমি, মাসে দেড়-দু’হাজার টাকা বেতন, ঝাড়া হাত-পা, বুড়ি মা ছাড়া কেউ নেই...

আমার হবু গিয়ে মেয়েটির পাশে বসতেই সে তীব্র স্বরে বলল, পাত্র বুড়ো হলে কিন্তু অপমান করে তাড়িয়ে দেব!

একটু বাদেই সুধীরবাবু, অর্থাৎ পাত্র এলেন। একা, পরনে সাদামাটা ধুতি-পাঞ্জাবি, দোহারা চেহারা এবং তিনি সত্যিই বয়স্ক। পঞ্চাশ তো বটেই। বেশিও হতে পারে। দিব্যকান্তি না হলেও চেহারাটা খারাপ নয়। এবং অতিশয় নিরীহ। ঘরে ঢুকে দুজন অপরিচিত উটকো যুবক-যুবতীকে দেখে তিনি যে এতটা ঘাবড়ে যাবেন, সেটা অনুমানও করতে পারিনি।

সুধীরবাবুকে দেখে বকুল, অর্থাৎ পাত্রীর চোখ আরও ক্ষুরধার হয়ে উঠল। কিন্তু আমার হবু তার কানে কানে কিছু বলে বিস্ফোরণটা চেপে রাখার চেষ্টা করল।

আর সুধীরবাবু ভারী কাঁচুমাচু হয়ে আমাকে বার দুই নমস্কার করলেন। পাত্রীর দিকে এক বারও তাকালেন না। যেন আমার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছেন, এমন ভাব করে আমতা আমতা করে নানা অপ্রাসঙ্গিক কথা পেড়ে ফেললেন, আপনারা শহরের লোক, কত জানেন-শোনেন। আমরা গাঁয়ে কোন অন্ধকারে পড়ে আছি। তার পর বোধহয় ফসলের পোকা, গরুর অসুখ, মাকালতলার শিবরাত্রির মেলা— এমন সব আগডুম বাগডুম। ভারী মায়া হল আমার। নানা কথার আড়ালে উনি নিজেকে এবং নিজের বয়সটাকে আড়াল করতে চাইছিলেন বোধহয়। পাত্রী দেখার কথা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলেন। ঘটকী হঠাৎ হুংকার দিল, বলি পাত্রী দেখতে এয়েছ, না কি?

সুধীরবাবু ভারী লজ্জিত হয়ে বললেন, ও আর কী দেখার আছে? আমি কি আর একটা মনিষ্যির মতো মনিষ্যি? আবার তিনি আমার সঙ্গে কথা কইতে লাগলেন। কখন দুজনের হাতে মিষ্টির প্লেট ধরানো হয়েছিল কে জানে। আমরা কথা কইতে কইতে দুজনেই বেবাক মিষ্টি সাবাড় করে ফেললাম। সত্যি বলতে কী, সুধীরবাবুকে আমার বেশ লাগল। অমায়িক, বিনয়ী, নিরহংকার, মিষ্টভাষী এবং সম্ভবত সজ্জন।

সুধীর চলে যাওয়ার পর বকুল রাগ করে কেঁদেকেটে একশা। আমার হবুও ঘটকীকে খুব ঝাড় দিল। কিন্তু আমার মনে হল, বিয়েটা হলেও তো হয়। কথাটা প্রকাশ করায় হবু আমার সঙ্গে দু’ঘণ্টা কথা বন্ধ রেখেছিল।

যত দূর খবর পেয়েছি, বিয়েটা কিন্তু হয়েছিল। এবং বেশ টেকসইও হয়েছিল।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy