Advertisement
E-Paper

ইনিonউনি

শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৪ ০০:০০

সত্তরের দশকের গোড়ার দিক। দুই সুপারপাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠান্ডা লড়াইয়ের আবহ। এই সময়, ১৯৭২ সালে, আইসল্যান্ডে বিশ্ব দাবা প্রতিযোগিতায় মুখোমুখি হলেন তখনকার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন রাশিয়ার বরিস স্প্যাসকি এবং তাঁর চ্যালেঞ্জার আমেরিকার ববি ফিশার। এই খেলাকে ঘিরে গোটা দুনিয়ায় তখন তুমুল উত্তেজনা। মিডিয়া কভারেজ খেলাটার হাইপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। গোটা খেলাটাকেই দেখানো হয়েছিল ‘ঠান্ডা লড়াই’-এর প্রতিরূপ হিসেবে। কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দাবার দুনিয়ার একমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নেরই রমরমা। চেস বোর্ডটাকে তারা ব্যবহার করত পুঁজিবাদের ওপর কমিউনিজ্‌ম-এর আধিপত্য কতটা, তা দেখাতে। রাশিয়ানরা মনেই করত, বিশ্বচ্যাম্পিয়ন খেতাবের ওপর এক মাত্র তাদেরই অধিকার। তুলনায় আমেরিকায় সে যুগে দাবা খেলার তেমন পরিকাঠামোই তৈরি হয়নি। ঠিক এই সময় স্প্যাসকি-র হাত থেকে বিশ্বখেতাব ছিনিয়ে নিলেন ফিশার। গোটা দুনিয়া জানল, কী ভাবে এক জন অ-রাশিয়ান আঘাত হেনেছে রুশ আধিপত্যে।

এই খেলা নিয়ে যখন গোটা দুনিয়া উত্তাল তখন আমি ছ’বছরের। বাবা এমনিতে দাবা খেলতে ভালবাসতেন। দু’এক দিন বাবাকেও চাল বলে দিয়েছি। এক দিন খেলাচ্ছলে বাবার বন্ধুকেই হারিয়ে দিয়েছিলাম। সব দেখে বাবার মনে হয়েছিল খেলাটার প্রতি রীতিমত আগ্রহ আছে তাঁর ছেলের। তাঁর খুব ইচ্ছে ছিল আমি এই খেলাতেই থাকি। কিন্তু অনেকেরই অমত ছিল। কারণ তখন দাবাকে খুব একটা ভাল চোখে দেখা হত না। ঠিক এই সময়ই ফিশার-স্প্যাসকি ম্যাচ নিয়ে আমাদের এখানকার কাগজে হেডলাইন বেরতে শুরু করল। সেই দেখে বাবা ঠিক করে নেন, আমাকে দাবাড়ুই বানাবেন। তাই, আজ আমার দাবা খেলার পেছনে, পরোক্ষে ফিশারের হাত রয়েছে বললে, ভুল বলা হবে না।

ববি ফিশার। কী বলব, অসামান্য দাবাড়ু, না কি জিনিয়াস? বলা কঠিন। ছ’বছর বয়সে দাবায় প্রথম হাতেখড়ি হয় রবার্ট জেম্‌স ফিশার-এর। মা অধিকাংশ সময়েই কাজে বাইরে থাকতেন, আর একঘেয়েমি কাটাতে ফিশার মেতে থাকতেন খেলাটা নিয়ে। খেলাটার মধ্যে ঢুকে যেতে যেতে এক সময় তাঁর এমন অবস্থা হল যে স্কুল, বন্ধুবান্ধব, পড়াশোনা কিছুতেই মন বসত না। মাত্র তেরো বছর বয়সে তিনি চেস মাস্টার হয়ে যান। এবং সেই বছরই একটি প্রতিযোগিতায় আমেরিকারই ডোনাল্ড বার্ন নামে এক জন আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়কে অসামান্য সব চাল দিয়ে পরাস্ত করেছিলেন। এই খেলাটি পরে ‘গেম অব দ্য সেঞ্চুরি’ নামে বিখ্যাত হয়। এর পর বিশ্ব দাবায় ববি ফিশারের নামটা ক্রমশ পরিচিত হতে শুরু করল।

আজ আমাদের দাবায় যে নাম বা যশ, বা আজ আনন্দ-কার্লসেন ম্যাচকে নিয়ে লোকের এত কৌতূহল, তা প্রায় পুরোটাই ফিশারের কারণে। তিনি যখন খেলতেন, সে সময় দাবার টুর্নামেন্টগুলোয় পুরস্কারমূল্য থাকত খুব কম। ফিশার এসে বদলে দিলেন সেই ধারা। এমন বেশ কয়েক বার হয়েছে, যখন পুরস্কারমূল্য কম বলে ফিশার টুর্নামেন্টই খেলবেন না বলে দিয়েছিলেন। ’৭২-এর বরিস স্প্যাসকির সঙ্গে বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে গিয়েও একই কারণে বেঁকে বসেছিলেন তিনি। এবং এক ব্রিটিশ ভদ্রলোকের দৌলতে সেই অর্থ বহু গুণ না হওয়া পর্যন্ত খেলতে নামেনইনি। তবে শুধু ‘মূল্য-বৃদ্ধি’র ব্যাপারে নয়, নিজের টার্ম-এ কোনও কিছু না হলেই তিনি তাঁর জমি ছাড়তে রাজি হতেন না। সেটা অল্প বয়স থেকেই। নানা টুর্নামেন্টে গিয়ে তাঁর হরেক অভিযোগ থাকত কোথাও লাইটিং-টা ঠিকঠাক নেই, কোনও জায়গায় দর্শকদের আওয়াজ বেশি, কোথাও আবার দাবা বোর্ড বা ঘঁুটিগুলোই ভাল নয়।

খেলা তো ছিলই। আরও একটা কারণে সব সময় আলোচনায় থাকতেন ফিশার। তাঁর স্বভাব। খামখেয়ালি, বদমেজাজি, কখন কী করছেন, কাকে কী বলছেন তার ঠিক নেই। ’৭২-এর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম গেম-এ স্প্যাসকির কাছে হারলেন। দ্বিতীয় গেমটা ওয়াক-ওভার দিয়ে দিলেন! সবাই ভাবল, গেল। একে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন প্রতিদ্বন্দ্বী, তায় আবার ২-০ পিছিয়ে পড়েছেন। আর পারবেন না। কিন্তু ফিশার তো ফিশারই। জিতলেন ঠিকই, এবং পয়েন্টের অনুপাতে বেশ ভাল ব্যবধানেই। গোটা দুনিয়ায় তাঁকে নিয়ে হইচই পড়ে গেল। নিজের দেশে হিরো বনে গেলেন ফিশার। এত যশ, এত প্রতিপত্তি পেলে মানুষ তো যেনতেনপ্রকারেণ সেটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করে! ফিশার তা করলেন না। ওই ম্যাচের পর আর তেমন কোনও বড় টুর্নামেন্ট খেলেননি তিনি। ১৯৭৫ সালে তাঁকে বিশ্বচ্যাম্পিয়নের খেতাব বজায় রাখতে সোভিয়েত ইউনিয়নের আনাতোলি কারপভ-এর বিরুদ্ধে খেলতে হত। কিন্তু সেখানেও ফিশার ওয়ার্ল্ড চেস ফেডারেশন-এর কাছে কিছু শর্ত রেখে বসলেন। এবং শর্ত পূরণ না হওয়ার কারণে হেলায় ছেড়ে দিলেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব!

এর পর দাবার দুনিয়া থেকে যেন সম্পূর্ণ নির্বাসনে চলে গেলেন তিনি। ফিরলেন। যুগোস্লাভিয়ায়। একটি প্রদর্শনী ম্যাচে। ম্যাচটি হয়েছিল তাঁদের ’৭২-এর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে। প্রতিদ্বন্দ্বী বরিস স্প্যাসকি। কিন্তু এ বারের ছবিটা ছিল সম্পূর্ণ উলটো। সেই সময় যুগোস্লাভিয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত। তখনকার মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে ফিশারকে ম্যাচটি না খেলার জন্য একটা বার্তা পাঠানো হয়। খেলা শুরু হওয়ার আগে এক আশ্চর্য কাণ্ড ঘটে। এ বোধ হয় শুধু ববি ফিশারের পক্ষেই সম্ভব। সাংবাদিক সম্মেলনে ফিশার সেই বার্তাটিতে থুতু ছিটিয়ে বুঝিয়ে দেন, কাঁরও তাঁবেদারি তিনি কোনও দিন সহ্য করেননি, করবেনও না। বলা বাহুল্য, প্রদর্শনী ম্যাচটাও জিতলেন ফিশারই।

ভাগ্যের পরিহাস হয়তো একেই বলে। এক দিন যে দেশ এই দাবার কারণে তাঁকে মাথায় তুলে নিয়েছিল, এক সময় সেই দেশের কাছেই চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ালেন তিনি। এর পর নানা দেশে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন ফিশার। মাঝে জাপানে বাতিল পাসপোর্ট ব্যবহারের দায়ে বেশ কয়েক মাস জেলের ঘানিও টানলেন। শেষে, আইসল্যান্ড তাঁকে ঠাঁই দিল, যেখানে খেলার সুবাদেই এক দিন তিনি বিশ্ববিখ্যাত হয়েছিলেন। বাকি জীবনটা কাটল ওখানেই। এবং ৬৪ বছর বয়সে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন ৬৪ ঘরের জাদুকর। কাকতালীয়?

শুনেছি, এক বার ফিশার-এর আই কিউ মাপা হয়েছিল: ১৮০। এক অর্থে জিনিয়াসই। তিনি যে সময় দাবা খেলেছেন তখন আজকের মতো এত সুযোগ-সুবিধে ছিল না। কিন্তু ‘ক্লাস’ কখনও সুযোগের ধার ধারে না। তবে দুনিয়া তাঁকে ঠিক সম্মানটা দিতে পারল কি? চেস সুপারস্টার ফিশার আমাদের কাছে সারা জীবন ‘Fishy’-ই রয়ে গেলেন।

baruadibyendu@hotmail.com


Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy