Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

ঈশ্বরকে লেখা চিঠি

গ্রেগরিয়ো লোপেস ই ফুয়েন্তেস

মেক্সিকো
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৩ ১৯:০২
Share: Save:

বাড়িটা— সারা উপত্যকায় ওই একটিই বাড়ি— নিচু টিলাটার ঠিক মাথায় বসানো। টিলার উপর থেকে দেখা যায় নীচে এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া নদীটাকে, আর অন্য দিকে খাটালের পাশে পাকা ফসলের খেতটাকে, যেখানে ফসলের ফাঁকে ফাঁকে অসংখ্য বিন্দু বিন্দু ঝিনুকের মতো শিম ফুল ফুটে আছে। লোকে বলে, এই শিম ফুলের ঝাঁক ভাল ফসলের প্রতিশ্রুতি বয়ে আনে।

এখন পৃথিবীর দরকার শুধু খানিকটা টানা বর্ষণের বা নিদেনপক্ষে কয়েক পশলা ভারী বৃষ্টির। সারাটা সকাল লেঞ্চো তার অতি-চেনা খেতটাকে আর উত্তর-পূর্ব দিকের আকাশটাকে চোখ মেলে জরিপ করা ছাড়া আর কিছুই করেনি।

‘বুঝলে গিন্নি, এই বার আমরা সত্যি সত্যিই বৃষ্টির দেখা পাচ্ছি।’

গিন্নি তখন বিকেলের খাবার তৈরি করছিল। মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, ঈশ্বরের ইচ্ছে হলে পাব বইকী।’
বাড়ির ছেলেপিলেদের মধ্যে বড়গুলো তখনও মাঠে কাজ করছিল আর ছোটগুলো খেলা করছিল বাড়ির উঠোনে। গিন্নি সবাইকে হাঁক দিয়ে ডাকল, ‘খাবি আয়—।’

সবাই যখন খেতে বসেছে, ঠিক সেই সময় লেঞ্চোর ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি প্রমাণ করে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হল। উত্তর-পূর্ব দিক থেকে পেল্লায় পাহাড়ের মতো কালো মেঘেদের তেড়ে আসতে দেখা গেল। লেঞ্চো বেরিয়ে খাটালের দিকে কিছু একটা অনির্দিষ্ট জিনিস খুঁজে এল— আর কোনও কারণে নয়, শুধু বৃষ্টিতে নিজের শরীরটাকে খানিকটা ভিজিয়ে নেওয়ার আনন্দে। ফিরে এসে সবাইকে শুনিয়ে উঁচু গলায় বলল, ‘এগুলো আকাশ থেকে পড়া বৃষ্টির ফোঁটা নয়, এগুলো হল সব ঝকঝকে নতুন পয়সা। বড়গুলো দশ আর ছোটগুলো পাঁচ পয়সা...’

মহানন্দে সে গোল গোল ফুলে ছাওয়া ফসলের খেতটার দিকে চেয়ে রইল। কিন্তু হঠাৎই হাওয়ার গতি বেড়ে গেল আর বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে শিলাবৃষ্টিও শুরু হল। এই বরফের টুকরোগুলোকে কিন্তু সত্যিকারের রুপোর পয়সার মতোই দেখাচ্ছিল। ছোটরা সেই শিলাবৃষ্টির মধ্যেই ভিজতে ভিজতে জমাট মুক্তোর মতো শিল কুড়োতে লাগল। লেঞ্চোর মুখ এই বার শুকিয়ে গেল, সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই বার দেখছি সময় খারাপের দিকে যাচ্ছে। আশা করি বেশি ক্ষণ শিলাবৃষ্টি চলবে না, দুর্যোগটা কেটে যাবে।’

কিন্তু শিলাবৃষ্টি সহজে থামল না। এক ঘণ্টা ধরে হতেই থাকল— বাড়ি, বাগান, পাহাড়তলি, ফসলের খেত, সারা উপত্যকার উপর— অবিরাম। ফসলের খেতটা ক্রমে সাদা হয়ে গেল, যেন নুনে ঢেকে গেছে পুরো খেতটা। কোনও গাছে একটি ফুল বা পাতা কিছুই অবশিষ্ট রইল না। সমস্ত ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেল। শিম ফুলেরাও কোথায় উধাও হয়ে গেল। ঝড়বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর ধ্বংস হয়ে যাওয়া ফসলের খেতে দাঁড়িয়ে লেঞ্চো তার ছেলেদের বলল, ‘পঙ্গপালেরা যদি এই খেতে ঝাঁপিয়ে পড়ত, তা হলেও বোধহয় এর চেয়ে কম ক্ষতি হত—। এই শিলাবৃষ্টির পর আর কিছুই বাকি রইল না। এ বছর আমাদের ঘরে একটুও ফসল উঠবে না। একটুও না।’

ভয়ংকর বিষণ্ণতায় ভরা ছিল সেই রাতটা।
‘আমাদের সব পরিশ্রম ধুলোয় মিশে গেল।’

‘এই বছরটা আমাদের অনাহারেই কাটাতে হবে—’
কিন্তু সেই প্রত্যন্ত উপত্যকার মাঝখানের সেই নিঃসঙ্গ কুটিরে যারা থাকত, সর্বস্বান্ত হওয়ার পরেও তাদের মনে একটিই মাত্র আশা-ভরসার জায়গা টিকে ছিল: ঈশ্বরের কৃপাদৃষ্টি আর করুণা। ‘অত ভেঙে পড়লে চলবে না। সবটা নষ্ট হয়ে গেছে ঠিকই, তবু মনে রেখো, না খেয়ে কেউ মরে না।’

‘হ্যাঁ, জানি। লোকে তো সেই রকমই বলে, না খেয়ে কেউ মরে না—’

সারা রাত ধরে লেঞ্চোর মনে একটাই চিন্তা ঘুরতে লাগল— তার একমাত্র আশা-ভরসার কথা, ঈশ্বরের সাহায্য। তাঁর চোখ, সে যেমন শিখেছে, সব দেখতে পায়— এমনকী এক জনের মনের গভীরে যে কথা লুকানো আছে, তা-ও। লেঞ্চো যদিও ষন্ডামার্কা এক জন চাষি, যে সারা দিন মাঠে পশুর মতো পরিশ্রম করে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সে লিখতে পড়তে জানে। পরের দিনটা ছিল রবিবার। সারা রাত ধরে ভেবে এক জন রক্ষাকর্তার অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হবার পর ভোরবেলা লেঞ্চো ঈশ্বরকে চিঠি লিখতে বসল। ঠিক করল, চিঠিটা সে নিজে হাতে করে শহরে নিয়ে যাবে এবং ডাকবাক্সে ফেলে দেবে।

সে যা লিখল, সেটা পুরোদস্তুর একটা আবেদনপত্র— ‘ঈশ্বর’, সে লিখল, ‘তুমি যদি সাহায্য না করো, তা হলে এই বছরটা আমাকে সপরিবারে অনাহারে কাটাতে হবে। আমার একান্ত দরকার একশো পেসো, নতুন করে মাঠে বীজ বুনবার আর ফসল ওঠার আগে পর্যন্ত সবার মুখে দুটো খাবার জোগানের জন্য। কারণটা তুমি জানো। আমাদের সমস্ত পাকা ফসল শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে গেছে।’
খামের উপর সে বড় বড় করে লিখল— ‘ঈশ্বরকে’। চিঠিটা তার মধ্যে পুরে সে চিন্তিত মুখে শহরের উদ্দেশে রওনা হল। ডাকঘরে পৌঁছে সে ডাকটিকিট কিনে খামের উপর লাগাল আর তার পর চিঠিটা ডাকবাক্সে ফেলে দিল। ডাকঘরের পিওন ডাকবাক্স থেকে সে দিনের চিঠিপত্র বার করার সময় ওই চিঠিটা দেখতে পেয়ে তুমুল হাসতে হাসতে পোস্টমাস্টারকে সেটা দেখাল। তার পিওনের জীবনে এ রকম চিঠি সে আগে কখনও দেখেনি। চিঠিটা হাতে নিয়ে মোটাসোটা, গোলগাল, ভালমানুষ পোস্টমাস্টারমশাইও প্রথমে অট্টহাস্য করলেন। কিন্তু পর ক্ষণেই তিনি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন, আর চিঠিটা আস্তে আস্তে টেবিলে ঠুকতে ঠুকতে বললেন, ‘কী গভীর এই ঈশ্বরবিশ্বাস! আমি খুব খুশি হতাম, যদি আমারও এই ঈশ্বরকে চিঠি-লেখা লোকটির মতো বিশ্বাস থাকত। সে যে ভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে, আমিও যদি করতে পারতাম। অমন করে ভরসা রাখতে পারতাম! আহা-হা, একেবারে ঈশ্বরের সঙ্গে পত্রালাপ!’

এখন, এই চিঠিটিকে তার উদ্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়। পোস্টমাস্টারমশায়ের মাথায় একটা উদ্ভট চিন্তা খেলে গেল। ওই চিঠিটার একটা উত্তর দিলে কেমন হয়? তবে চিঠিটা পড়ার পর পোস্টমাস্টারমশাই বুঝতে পারলেন যে, এই চিঠির উত্তর দেবার জন্য শুধুমাত্র সহৃদয়তা, কালি আর কাগজই যথেষ্ট নয়। কিন্তু তিনি তাঁর পরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে আসতে রাজি হলেন না। তিনি কর্মচারীদের কাছ থেকে কিছু অর্থ সংগ্রহ করলেন আর নিজেও বেশ অনেকটা অর্থ দিলেন। এ ছাড়াও বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে আবেদন-নিবেদন করে আর ‘দান করলে পুণ্য হয়’ এই যুক্তি দেখিয়ে তাদেরও কিছু কিছু করে দিতে বাধ্য করলেন। তবু লেঞ্চোর আবেদন মতো একশো পেসো জোগাড় করা সম্ভব হল না। শেষ পর্যন্ত তিনি ওই অদ্ভুত লোকটাকে তার প্রয়োজনের অর্ধেকের কিছু বেশি টাকা দিতে পারলেন। তিনি একটি খামের ভিতর টাকাটা পুরে তার সঙ্গে দিলেন এক টুকরো সাদা কাগজ, যাতে একটি শব্দই লিখে দিলেন স্বাক্ষর হিসেবে— ঈশ্বর।

পরের রবিবার তার নামে কোনও চিঠি আছে কি না জানার জন্য লেঞ্চো আগের দিনের তুলনায় একটু আগেই ডাকঘরে উপস্থিত হল। সেই পিওন নিজেই তার হাতে উত্তরটা তুলে দিল, আর কেউ কোনও ভাল কাজ করলে যে সুখানুভূতি হয়, তাই নিয়ে পোস্টমাস্টারমশাই তাঁর টেবিল থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে সেটা দেখতে লাগলেন। চিঠি এবং তার সঙ্গের টাকা দেখে লেঞ্চো বিন্দুমাত্র বিস্ময় প্রকাশ করল না— এমনই গভীর তার বিশ্বাস। কিন্তু টাকাটা গোনার পর সে ভীষণ রেগে গেল—। ঈশ্বরের তো গুনতে ভুল হতে পারে না, আর তিনি নিশ্চয়ই লেঞ্চোর ন্যায্য দাবি খারিজও করবেন না।

লেঞ্চো তৎক্ষণাৎ পোস্টাপিসের জানলায় গিয়ে কাগজ আর কালি-কলম দাবি করল। সকলের লেখার জন্য যে টেবিল আছে, সেখানে কাগজ রেখে সে খসখস করে লিখতে শুরু করল— তার চিন্তাকে ভাষায় প্রকাশ করার দুরূহ প্রচেষ্টায় তার ভুরু দুটো যথাসম্ভব কুঁচকে। চিঠি লেখা শেষ হলে সে আবার জানালায় গিয়ে ডাকটিকিট কিনল, আর তাতে থুতু লাগিয়ে খামের উপর সশব্দে কিল মেরে সেটাকে সেঁটে দিল। চিঠিটা ডাকবাক্সে পড়তেই পিওন গিয়ে বাক্স খুলে সেটাকে বার করে আনল। তাতে লেখা আছে: ‘ঈশ্বর, আমি যে টাকাটা চেয়েছিলাম, তার মধ্যে মাত্র সত্তর পেসো আমি পেয়েছি। বাকিটা অবশ্যই পাঠিয়ে দিও। কারণ, টাকাটা আমার খুবই দরকার। তবে দয়া করে ডাকে পাঠিও না। কারণ, ডাকঘরের লোকেরা সব জোচ্চোর।’
—লেঞ্চো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE