লম্বা ছিপছিপে চেহারার, ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক এক সকালে আমাদের বাড়িতে কড়া নাড়লেন। বেশ জোরের সঙ্গে বললেন, ‘সুকুকে এক বার ডেকে দাও তো।’ বাবা দরজার কাছে যেতেই, ‘কী রে ব্যাটা, চিনতে পারছিস না তো! জানতুম। তোর মেমরি খুব উইক!’ ধাঁধা উদ্ধার হল, বাবার স্কুলের বন্ধু। একসঙ্গে হাওড়ার বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশনে পড়েছে দশ-দশটা বছর।
চা-জলখাবার, মা’র সঙ্গে বন্ধুপত্নী-সুলভ ঈষৎ খুনসুটি, দেদার আড্ডা এবং দুপুরের খাওয়া সেরে, বিকেল নাগাদ কাকু উঠলেন। বাবার কাছে শুনলাম, কাকু নাকি ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিলেন। মুখে মুখে শক্ত অঙ্কের উত্তর বলতে পারতেন। ক্লাসে স্ট্যান্ড করায় তেমন নেশা ছিল না। স্কুলের পর কলেজে ঢুকে বাম রাজনীতিতে বুঁদ হন। ভিয়েতনাম থেকে রিফিউজি কলোনির সমস্যায় তাঁর অবাধ যাতায়াত। চাকরি কোনও দিনই করতে চাননি। ঠেলায় পড়ে সংসার চালানোর জন্য টুকটাক কিছু করতেন। ছেলে বিদেশে চলে গিয়েছে। নীতি মেলেনি, তাই মা-ছেলে আর বাবা আলাদা। এই বাবা এখন কিছুটা ভবঘুরে। পুরনো বন্ধু খুঁজে বেড়ান। সেই প্যাটার্ন মেনে আমাদের বাড়ি।
দিন পনেরো পর আবার এলেন। মুখটা কাঁচুমাচু। ‘ইয়ে, মানে, কিছু টাকা দিতে পারিস? একটু সমস্যায় পড়েছি। পোস্ট অফিসের টাকাটা ম্যাচিয়োর করলেই ফেরত দিয়ে দেব।’ ওঁর চেয়ে বাবাই যেন বেশি লজ্জা পেল। বন্ধুর এমন অবস্থা, অথচ কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না। টাকা দেওয়া হল। এর পর মাস তিনেক দেখা নেই। ফের এক দিন। এ বার টাকা চাইলেন ভারী অসুস্থ বলে। অসুস্থতায় পোস্ট অফিসের টাকাটা খরচ হয়ে গিয়েছে। বাবা বলল, ‘থাকগে সে সব কথা। খেয়ে যাস।’ বাবার কাজ ছিল, তাই বেরিয়ে গেল।
এ বার সেই কাকু প্রায়শই আসতে থাকলেন। মাসে দু’বার, কখনও তিন বার। এলে খেয়ে যেতেন। আর কোনও না কোনও বাহানায় টাকা ধার চাইতেন। একটা সময়ের পর আমরা বুঝেছিলাম, উহা ফেরতযোগ্য নহে। বুঝতে পারতাম, এই ব্যবস্থায় উনিও লজ্জা পেতেন, বাবাও ভারী কষ্ট পেত। আসলে ওঁর রোজগার বলতে কিছু ছিল না। পেট তো চালাতে হবে। মোটামুটি একটা পরিবার, যারা ওঁকে হ্যাট হ্যাট করে তাড়িয়ে দেয় না, গেলে এক বেলা খাইয়ে দেয়— এমন একটা বাড়িতে লজ্জার মাথা খেয়ে যাওয়াই যায়।
এক দিন কাকু এসেছেন। আমরা যে যার কাজে ব্যস্ত, মা-বাবাও বাড়িতে নেই, তাই সে দিন টাকা দেওয়া যায়নি। কিছু জলখাবার খাইয়ে ওঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হল। ফিরে এসে দেখি, আমি কিছু ক্ষণ আগে কিছু খুচরো টাকাপয়সা টেবিলে রেখেছিলাম, সেটা নেই। আমার খুব খুব কষ্ট হল। খুব কান্না পেল। কতই বা ছিল— সব মিলিয়ে গোটা কুড়ি টাকা হয়তো!
এর পর যে দিন উনি এলেন, আমি লজ্জায় ওঁর সামনে যেতে পারলাম না। কিন্তু সে দিনও শুনলাম বাজার-ফেরত কিছু টাকা কাজের মাসি টেবিলে রেখেছিল, মা চিনি আনতে দিতে গিয়ে দেখে, নেই। আমি আগের দিনের কথা কাউকে কিছু বলিনি। কিন্তু ব্যাপারটা হঠাৎ ছ্যাঁৎ করে সবাই বুঝে ফেলল। বাবার মুখটা কালো হয়ে গেল। সারা দিন কথা বলল না। আমি জানি বাবা রেগে যায়নি, বাবার যন্ত্রণা মাত্রা ছাড়ালে অমন রং হয়ে যায় মুখের। আমি চিনি সেটা।