নিজেকে একবাক্যে কেবল ‘সুবিধেবাদী’ তকমা দিতে পারব না। ভাল-মন্দয় মিশিয়ে আমি মেয়েটা খুব খারাপ নয়। কিন্তু একটা ব্যাপারে আমার নীতি, মায়া, মনুষ্যত্ব, সব ব্যাকসিট নিয়ে নেয়, আর সব কিছুকে ছাড়িয়ে একটাই বুক-ধড়ফড় আমার ভেতরে জেগে থাকে। রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে জানলে আমি এগিয়ে গিয়ে সাহায্য করতে পারি না।
কী দৃশ্য আমায় দেখতে হতে পারে, এই ভয়ে আমি নিতান্ত কেন্নোর মত গুটিয়ে যাই। অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে বুঝলে এবং ভিড় দেখলেই অন্য রাস্তা নিই। মনকে বোঝাই, নিশ্চয়ই কেউ না কেউ সাহায্য করবে, কেউ না কেউ হাসপাতালে নিয়ে যাবে। আমার কি এগিয়ে যাওয়া উচিত, আমি কি পুলিশকে খবর দেব— এ সব আকাশপাতাল ভাবিও ঠিক, কিন্তু ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে সেই মানুষটাকে কিছুতেই সাহায্য করতে পারি না। ভিড়টা ছোটখাটো হলে, কিংবা লোকজনের মুখচোখ দেখে যদি বুঝতে পারি, ব্যাপারটা তেমন সিরিয়াস নয়, তা হলে হয়তো এগিয়েও যাই। কখনও বা টিটেনাস দেওয়ানো কিংবা বাঁ-হাঁটুর এক্স-রে অবধি গিয়ে অব্যাহতি মেলে।
কিন্তু বেশ বড় ভিড়, সাংঘাতিক হইচই, জ্যাম, গাড়ি ঘোরানো, ছোটাছুটি দেখলেই আমি একেবারে সাদা কাগজের মতো। যখন অনেকগুলো কথা উড়ে আসে আমার কানে— ‘লোকটার জানেন তো পা-টা কাটা চলে গেল’, কিংবা ‘মাথাটার আর কিচ্ছু নেই, ঘিলু বেরিয়ে রাস্তায় লেগে গিয়েছে’, কিংবা ‘এখনও ধুকপুক করছে রে, হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়তো বেঁচে যাবে’— তখন ভেতরটা কী রকম ছটফট করতে থাকে, মনে হয় কত ক্ষণে পালাব জায়গাটা ছেড়ে। কথাগুলো বলার ভঙ্গি থেকে বুঝি, মানুষের বীভৎসতার প্রতি কী অদম্য আকর্ষণ! বিবরণের ডিটেলে তারা সেলিব্রেট করে এই বীভৎসতা। আর আমি তাড়াতাড়ি আমার ইন্দ্রিয়গুলোকে অবশ করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি। যাতে এ সব দৃশ্য আমায় দেখতে না হয়, যাতে ওই আর্তি আমায় শুনতে না হয়। আমি নিজেকে অতিক্রম করে, কিছুতেই পারব না ওই ভয়ংকরের, বীভৎসতার মুখোমুখি হতে।
তা হলে? আমি কি ঝামেলা এড়াতে চাই? আর আমার যত নৈতিক বুকনি কেবল বলাবলি আর লেখালিখিতেই সীমিত? সত্যি বলছি, যদি কেবল এই দাঁড়িপাল্লায় বিচার করা হয়, তা হলে আমি ডাহা ফেল। নিজেকে ডিফেন্ড করার কোনও যুক্তি আমার কাছে নেই। কিন্তু আমিও এ রকম ঘটনায় বিচলিত হয়ে পড়ি, আকুল ভাবে মনে মনে বলি, ভাল হয়ে যাক, ঠিক হয়ে যাক। পরের দিন ওইখান দিয়ে গেলে মনে হয়, লোকটা চিকিৎসা পেয়েছিল তো?
কেবল নিজেকে এই দোষারোপ থেকে রেহাই দিতে পারি না যে, আমি কেন অন্যের ওপর ভরসা করব? কেন আমি এগিয়ে গিয়ে সাহায্য করব না? কেন আমার নীতির ভার, চিন্তার ভার, শুভকামনার ভার অন্যেরা নেবে? আর নিজেকে, নিজের মধ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে সেঁধিয়ে নেব? কিন্তু সব যুক্তি ও দায়িত্ববোধকে ওলটপালট করে দেয় আমার দম আটকানো ভয়। ভাবি, এর পর থেকে আর এড়িয়ে যাওয়া নয়। পরের বার এগোতেই হবে, ভয়কে নাকচ করে দিয়ে।
কিন্তু সত্যি বলছি, পারিনি এত দিনেও। ঝাঁপিয়ে পড়ে, ভিড় ঠেলে, ‘হ্যাঁ দাদা চলুন, আমি হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি’— এই সাহস সঞ্চয় করতে পারিনি। কোনও দিন পেরে উঠব, এমন মনের জোর কি আছে? জানি না।