Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

কেচ্ছা

নোবেল তিনি ফের পেলেন বটে, কিন্তু নোবেল কমিটি সিধে জানিয়ে দিল, পুরস্কারটা তিনি না নিতে এলেই মঙ্গল! ফরাসি বিজ্ঞানী মারিয়া স্ক্লদভ্স্কা কুরি। সেটা ১৯১১। ইতিহাসে সেই প্রথম বার কেউ দ্বিতীয় বার নোবেল পেলেন। তাও আবার এক জন মহিলা পদার্থবিদ। হয়তো এই মহিলা হওয়াটাই তাঁর অভিশাপ হল। মাদাম কুরি এ বার রসায়নশাস্ত্রে নোবেল পাচ্ছেন— নোবেল কমিটির এই ঘোষণা ফরাসি মিডিয়ায় মোটে পাত্তাই পেল না।

সুস্নাত চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

নোবেল তিনি ফের পেলেন বটে, কিন্তু নোবেল কমিটি সিধে জানিয়ে দিল, পুরস্কারটা তিনি না নিতে এলেই মঙ্গল! ফরাসি বিজ্ঞানী মারিয়া স্ক্লদভ্স্কা কুরি। সেটা ১৯১১। ইতিহাসে সেই প্রথম বার কেউ দ্বিতীয় বার নোবেল পেলেন। তাও আবার এক জন মহিলা পদার্থবিদ। হয়তো এই মহিলা হওয়াটাই তাঁর অভিশাপ হল। মাদাম কুরি এ বার রসায়নশাস্ত্রে নোবেল পাচ্ছেন— নোবেল কমিটির এই ঘোষণা ফরাসি মিডিয়ায় মোটে পাত্তাই পেল না। কারণ তার ঠিক আগেই তাদের হাতে এসে পড়েছিল আরও গরম স্টোরি: বিধবা কুরির অবৈধ প্রেমকাহিনি। সে কেচ্ছার ঝড়ের চোটেই নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে তাঁকে চিঠি দিয়ে গরহাজির থাকার অনুরোধ। কুরি অবশ্য এসেছিলেন, পুরস্কার নিয়েছিলেন।

সেই পুরস্কার ফ্রান্সের আমজনতার বিষনজর থেকে মুক্ত করতে পারেনি মাদাম কুরিকে। কেউ বলছে ‘ডাইনি’, কেউ ‘ঘর-ভাঙানি’। স্বামী পিয়ের কুরির মৃত্যুর পর একেবারেই ভেঙে পড়েছিলেন মারি। তার কিছু পর থেকেই ক্রমশ তাঁর সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞানী পল লঁজেভঁ-র সম্পর্কের শুরু। পল ছিলেন পিয়েরের ছাত্র, মারির চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট। উপরন্তু বিবাহিত ও চার সন্তানের পিতা। পলের সান্নিধ্যে মারি জীবনের মূল স্রোতে ফিরে আসতে চাইছিলেন। দুই বিজ্ঞানীর বন্ধুত্ব প্রণয়ের রূপ নিয়ে গাঢ়তর হল, সেই ‘তেজস্ক্রিয়’ প্রেমে তাঁরা পুড়তে শুরু করলেন।

মারির কর্মক্ষেত্র সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই নাম ভাঁড়িয়ে একটি ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন পল। সেখানেই আসতেন মারি। একসঙ্গে সময় কাটাতেন। পল-কে বেশ কিছু চিঠিও লিখেছিলেন। আবেগঘন সে সব লেখায় ছিল অনেক অন্তরঙ্গ বিষয়। কিন্তু পলের স্ত্রী জেনি-র কাছে আর কিছুই গোপন থাকল না। এমনকী চিঠিগুলোও জেনি হস্তগত করলেন। এবং ক্রোধে ফেটে পড়লেন। পরে মারির ওপর চড়াও হতে, তাঁকে খুনের হুমকি দিতেও নাকি ছাড়েননি।

তার পর সব তথ্য গিয়ে পড়ল সংবাদমাধ্যমের হাতে। যেটুকু সত্য, সেটুকুই তুমুল চাঞ্চল্যকর। তার ওপর কিছু রংও চড়ল। ফলাও করে ছাপা হতে লাগল কুরি-লঁজেভঁ রগরগে পরকীয়ার কাহিনি। ছাপা হল পলের স্ত্রী আর শাশুড়ির সাক্ষাৎকার। সামনে এল সেই সব ব্যক্তিগত চিঠিপত্রও। তারও আগে অবশ্য মারির মধ্যনাম ‘স্ক্লদভ্স্কা’-কে হাইলাইট করে এ কথাও রটানো হয়েছে, তিনি নাকি ইহুদি, প্রকৃত ফরাসি নন। আর উন্মত্ত ফরাসি জনতা তখন তাঁর শাপশাপান্ত করছে। তাদের মোদ্দা কথা, অন্যের সংসারে ভাঙন ধরিয়েছেন দুষ্ট বিদেশি মারি। মার্কিন কাগজেও তত দিনে উঠে এসেছে নোবেলজয়ী বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীর কেচ্ছা। দক্ষিণপন্থী সাংবাদিক গুস্তেভ টেরি এ বার আক্রমণ করলেন আরও নগ্ন, হিংস্র ভঙ্গিতে। ব্রেকিং নিউজ দিলেন, পিয়েরের মৃত্যুর আগে থেকেই নাকি মারি-পল এই গোপন লীলার শুরু! আর সে কথা জানতে পেরেই আত্মহত্যা করেন পিয়ের! এই ইন্ধনে উত্তেজিত জনতা ফেটে পড়ল মারির বাড়ির সামনে। ঘেরাও করে চলল বিক্ষোভ, তাণ্ডব। তাঁর উদ্দেশে স্লোগান, অশ্রাব্য গালাগাল। সন্তানদের নিয়ে তখন ভয়ে কুঁকড়ে রয়েছেন মারি। বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত। কাজ-গবেষণা খুইয়ে প্রায় দেশ ছাড়ারই জোগাড়। এ বার টেরির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন লঁজেভ।ঁ ডাক দিলেন খোলাখুলি দ্বন্দ্বযুদ্ধের। মুখোমুখি সাংবাদিক ও বিজ্ঞানী— দুজনের হাতেই পিস্তল! শেষমেশ সেই ডুয়েলে গুলি বিনিময় হয়নি, এটাই রক্ষে।

কিন্তু রক্ষা পেলেন না মাদাম কুরি। দ্বিতীয় বারের নোবেল নিয়ে ফেরার পর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত কাজ করার প্রভাব। সংবাদমাধ্যমকে এড়াতে গোপন রাখা হল তাঁর অসুস্থতার কথা। কিন্তু রটে গেল, তিনি গর্ভবতী, তাঁর পেটে লঁজেভঁ-র অবৈধ সন্তান! গর্ভপাত করানোর জন্যই নাকি এই গোপনীয়তা! শোনা যায়, এ সময় ভীষণ রকম ডিপ্রেশনে তলিয়ে যান তিনি। আড়ালে আত্মহত্যার চেষ্টাও নাকি করেন। তত দিনে অবশ্য জেনি আর পলের আইনি বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছে। পলের সঙ্গে বন্ধুত্ব অটুট ছিল বাকি জীবনটা, কিন্তু ভালবাসার সেই দিনগুলো আর ফিরে আসেনি মাদাম কুরির।

susnatoc@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

susnato chowdhury marie curie
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE