তখন সদ্য মধ্যপ্রদেশ থেকে এসেছি। জন্ম ঢাকায়। পাঁচ বছর বয়সে কলকাতায় চলে আসি। মধ্যপ্রদেশে বড়মামা থাকতেন। বাবা তাঁর ব্যবসার কাজ বাড়াতে গিয়েছিলেন সেখানে।
কিন্তু বাবার কাজের সে রকম সুবিধে হচ্ছিল না। তাই আমরা আবার চলে আসি কলকাতায়। আমার মেজদি নাটক করত। মা মধ্যপ্রদেশে থাকার সময়েও সরস্বতীপুজো, রবীন্দ্রজয়ন্তীর সময়ে ভাইবোনদের দিয়ে নাটক করাতেন। সেই থেকেই অভিনয়ের ইচ্ছেটা গেঁথে গিয়েছিল মনের মধ্যে।
এক দিন মেজদির সঙ্গে চোরবাগানে নব নাট্যম বলে একটা দলের নাটকের মহড়া দেখতে গিয়েছিলাম। মেঘনাদবধ কাব্য। অবাক হয়ে দেখছি! এই ধরনের নাটক তো কোনও দিন করিনি। কী ভীষণ ইচ্ছে করছিল, আমিও যদি ওই সংলাপগুলো বলতে পারতাম! হঠাৎ নাটকের নির্দেশক দেবব্রত সুরচৌধুরী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘খুকি, একটা রোল করবে?’ তখন আমার সতেরো বছর বয়স। আমি তো সঙ্গে সঙ্গে রাজি। একটা ছোট্ট রোল ছিল। কামদেব আর রতির একটা নাচের দৃশ্য আর দু’চারটে সংলাপ। আমি রতির চরিত্রটা করেছিলাম। নিউ এম্পায়ারে মর্নিং শো হয়েছিল। আমার অভিনয় দেখে দুটো অফিস ক্লাব থেকে আমায় অভিনয় করার জন্য বলে। তখন মনে হল, মেজদি তো বাবাকে একটু আর্থিক সাহায্য করার জন্য নাটক করে। আমিও তা হলে তা-ই করব। ভাইবোনেরা পড়ুক। আমি বাড়িতেই যতটা পারি, পড়ার চেষ্টা করব। বাবাকে বললাম সে কথা।
তার পরে তো সেই অফিস ক্লাবের মহড়ায় গিয়েছি। সেখানে নির্দেশক ছিলেন কুণাল মুখোপাধ্যায়, তিনি ছিলেন কনক মুখোপাধ্যায়ের ভাই। কনক মুখোপাধ্যায়ই ‘ভানু পেল লটারি’ ছবিটার পরিচালক। তো, অফিস ক্লাবের মহড়া কিছু দিন চলার পরে তিনি আমায় বললেন, ‘একটা সিনেমায় অভিনয় করবি?’ আমি তখন ভাবছি, এগুলো তো আমার মনের ইচ্ছে। এ ভাবে না চাইতেই একটার পর একটা ঘটছে কী করে? কেউ যেন এক-একটা জায়গায় তুলে তুলে নিয়ে যাচ্ছে আমায়।
যাই হোক, আমি তো লম্বা করে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। তখন কনকদা বললেন, ‘তুই তো রাস্তাঘাট কিছু চিনিস না! এক কাজ করবি। বাবাকে নিয়ে কাল রাধা ফিল্ম স্টুডিয়োতে যাবি।’ সেটা ছিল টালিগঞ্জে যাওয়ার পথে বাঙুর হাসপাতালের পরে।
আমি তো শাড়ি-টাড়ি পরে গেলাম। সঙ্গে বাবা। ছবির পরিচালক এসে বললেন, ‘একটু বোসো। আজকেই কিন্তু শুটিং। বেশি ক্ষণ লাগবে না। রাত বারোটার মধ্যে হয়ে যাবে।’ তখন বিকেল চারটে। আমরা তো বাড়িতে বলে আসিনি। সবাই চিন্তা করবে, যদি অত দেরি হয়। ফোন-টোনের তো ব্যাপার নেই। তাই বাবা উল্টোডাঙায় বাড়িতে বলে আসতে গেল। তখন তো এত যানজট হত না। টালিগঞ্জ থেকে উল্টোডাঙা বাসে মিনিট কুড়ি লাগত বড়জোর।
বাবার কথামত আমি তো চুপটি করে একটা বেঞ্চে বসে আছি একা-একা। এক জন এসে বললেন, ‘চলো! মেক-আপ করতে হবে।’ পরিচালক বলে দিয়েছিলেন, যে শাড়িটা পরে আছি, ওটাই চলবে। মেক-আপ হয়ে গেলে এক জন ডেকে সঙ্গে করে সেটে নিয়ে গেল। সেখানে যেতেই পরিচালক বললেন, ‘শোনো, এই যে টেবিল-চেয়ার আর টাইপরাইটার রয়েছে। তুমি চেয়ারে বসে টাইপরাইটারের উপরে মাথা রেখে ঘুমনোর ভান করে থাকবে। তার পরে তোমার বস ঢুকে তোমাকে ডাকবে। তুমি অমনি চমকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াবে।’
মজার সিনেমা তো! আমার চরিত্রটার নাম ছিল মনে হয় মিস ঢ্যাং। আমার সঙ্গে ছিল কমল মিত্র আর জহর রায়ের দৃশ্য। আমি তো সদ্য মধ্যপ্রদেশ থেকে এসেছি। কাউকেই চিনি না। আমায় পরিচালক যা যা করতে বললেন, যে ভাবে তাকাতে বললেন, যে যে সংলাপ বলতে বললেন, আমি গড়গড় করে সব বলে দিলাম।
পরে যে দিন দেখা হল, কুণালদা বললেন, ‘তোর জন্য দাদার কাছে বকুনি খেলাম!’ আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম। ভুল করলাম কি কিছু? ওঁকে সে কথা বলতেই হইহই করে বলে উঠলেন, ‘না না! দাদা বলল, এই মেয়েটাকে আগে পাঠাসনি কেন? ওকে দিয়েই আমি হিরোইনের পার্টটা করাতাম। কী ফ্লেক্সিব্ল মেয়ে! যা বলছি করে দিচ্ছে, কোনও ভয় নেই! কমল মিত্র, জহর রায়ের মতো জাঁদরেল অভিনেতাদের সঙ্গে কেমন সাবলীল ভাবে অভিনয় করল!’
তখন বুঝলাম, ওঁরা আসলে কত বড় মাপের অভিনেতা! আমি তো বুঝিইনি আগে। নির্ভয়ে অভিনয় করে গিয়েছি। এক দিনেরই শুটিং ছিল ‘ভানু পেল লটারি’র। জহর রায় ছিলেন আমার বসের ভূমিকায়।
তার পরে একটার পর একটা কাজ আসতে লাগল। ‘ভানু পেল লটারি’র ক্যামেরা করেছিলেন যিনি, তিনি দ্বিতীয় ছবির জন্য আমায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি হয়তো সে ভাবে নায়িকার পার্ট করিনি কখনও। শুধু নায়িকা করব, এমন লক্ষ্যও আমার ছিল না। শুধু চরিত্রটা ভাল হতে হবে, ব্যস্। সেই জন্যেই সব ছবিতেই আমি কিন্তু দর্শকের নজরে পড়ে যেতাম ঠিক।
ছবি পাওয়ার ক্ষেত্রে আমার কপালটা সত্যিই ভাল। মানিকদার ‘জনঅরণ্য’, ‘শাখাপ্রশাখা’ই হোক বা মুম্বইয়ের কাজ— সবগুলোই কোনও না কোনও সূত্রে নিজে থেকেই আমার কাছে এসেছে। আমাকে কোনও দিন গিয়ে গিয়ে কাজ চাইতে হয়নি। মানিকদার প্রসঙ্গে আর একটা ঘটনা মনে পড়ে। তখন আমি ‘দীপ জ্বেলে যাই’-তে একটা ছোট্ট রোল করেছি। অসিত সেন-এর ছবি। ইন্ডাস্ট্রিতেও আমি তখন নতুনই। ছ’মাসও হয়নি বোধ হয়। অসিত সেনই মানিকদাকে আমার সম্পর্কে বলেছিলেন। উনি আমায় ডেকে পাঠান। গেলাম ওঁর লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে। বউদি শাড়ি পরিয়ে সাজিয়ে দিলেন। মানিকদা আমার অনেক ছবি তুললেন। ‘অপুর সংসার’ ছবির জন্য। তবে বলেই দিয়েছিলেন, ‘আরও একটা মেয়েকে দেখে রেখেছি। ওর স্কুল নিয়ে কী একটা সমস্যা হয়েছে। সেটার যদি সমাধান হয়ে যায়, তা হলে কিন্তু ও-ই করবে পার্টটা। ওর সঙ্গে তো আমি আগে কথা বলেছি! তখন কিন্তু তুমি মনখারাপ কোরো না।’
পরে তো অন্য মেয়েটা, মানে শর্মিলা ঠাকুরই করল ছবিটা। তারও পরে ‘ফুলেশ্বরী’ দেখে আমায় ‘জনঅরণ্য’-এর জন্য আবার ডাকেন মানিকদা।