Advertisement
E-Paper

ক্রেজি কিয়া রে

দেওয়ালে প্লেয়ারদের পোস্টার, তাদের কপালে ভাইফোঁটা, ইন্ডিয়া টিম শহরে এলে টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে বুথ থেকে তাজ বেঙ্গল ডায়াল। চিরশ্রী মজুমদার।কেসটা অবিকল মহাভারতের অভিমন্যুর মতো। মাতৃগর্ভে গুটিসুটি মেরে কান খাড়া করে চক্রব্যূহে ঢোকার কায়দাটা শিখে নিয়েছিল, কিন্তু বেরোবার ট্রিক-টা শুনতে পায়নি, তাই টিনএজেই তার লাইফটা গোল্লা হয়ে গেল। আমার কহানিও কতকটা সে রকম। তখন আমরা বিশ্বকাপ ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে উড়িয়ে টগবগবগ ফুটছি, বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপে অস্ট্রেলিয়াকে ফুটিয়ে রবি শাস্ত্রীর অডি’তে উঠে বনবন ঘুরছি।

শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৪ ০০:০৬
ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

কেসটা অবিকল মহাভারতের অভিমন্যুর মতো। মাতৃগর্ভে গুটিসুটি মেরে কান খাড়া করে চক্রব্যূহে ঢোকার কায়দাটা শিখে নিয়েছিল, কিন্তু বেরোবার ট্রিক-টা শুনতে পায়নি, তাই টিনএজেই তার লাইফটা গোল্লা হয়ে গেল। আমার কহানিও কতকটা সে রকম। তখন আমরা বিশ্বকাপ ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে উড়িয়ে টগবগবগ ফুটছি, বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপে অস্ট্রেলিয়াকে ফুটিয়ে রবি শাস্ত্রীর অডি’তে উঠে বনবন ঘুরছি। এমনই এক যুগান্তকারী লগ্নে, আমার আসার সময় হতেই মা যে কেন ট্রানজিস্টরে অতি মনোযোগে টেস্ট খেলার ধারাবিবরণী শুনতেন, বাবা যে কেন অফিস ভুলে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের ম্যাচে ছুটতেন, আর আমার মাসি কেন স্পোর্টসওয়ার্ল্ড এনে মাকে বিয়র্ন বর্গ জন ম্যাকেনরো’র আজব গজব কিস্সা শোনাতেন, কে জানে। তাই পৃথিবীতে আসার আগেই আমি আজন্ম বন্দি হয়ে গেলাম খেলার মাঠে। জীবনটাও গোল্লায় গেল। গোল্লা মানে, ফুটবল, ক্রিকেট বল, টেনিস বল হয়ে গেল।

ভেবে দেখলে সে খুবই কাজের কথা। আজকের দুনিয়ায় খেলা-দেবতার বরকন্যা হয়ে জন্মানো মানে তোমার সামনে সুনহেরি ভবিষ্যত লপলপায়িং। তিন-চার বছর বয়স থেকে যে বালিকাটি বারান্দায় ঝুলে পাড়ার দাদাদের ক্রিকেট ম্যাচ গেলে, বড় বড় চোখ করে সন্তোষ ট্রফি টু নাইন্টি’র দুখী আত্মা ইতালি ওয়ার্ল্ড কাপের খবর পড়ে, সবুজ-মেরুন বা নীল-সাদা যে জার্সিই গোলের কাছে বল নিয়ে দৌড়োক না কেন তার ছোট্ট হৃদয়ে ধুকপুকুনি মাত্রা ছাড়ায়, দূরদর্শনের প্রচণ্ড বোরিং নিউজের মধ্যেও বিরানব্বইয়ের ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপের একটুখানি বাইটটার জন্য ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে বসে থাকে, তার তো শৈশব নামক রাতটুকু পেরোলেই কোনও একটা পোডিয়ামে উঠে হাজারো করতালির মাঝখানে, ঘর্মাক্ত ট্র্যাকসুট গায়ে মাথা ঝুঁকিয়ে ঝুঁকিয়ে মেডেলের পর মেডেল পরার কথা। মা-বাবা একটুখানি তেমনটাই এক্সপেক্ট করেছিলেন। তাই দশের চৌকাঠটুকু পেরোনোর অপেক্ষা, তার পরই ক্রিকেট, টেনিস ও সাঁতার ক্যাম্পে ভরতি করে দিলেন। ও সব জাঁহাবাজ নামবাজ খেলায় না পারলে হাডুডু, খোখো, কবাডি— কোথাও একটা মতি নন্দীর কলাবতী বা কোনি কিছু একটা হয়ে যাবই বলে তাঁরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছিলেন।

তার পরই গাড়ির ব্রেক ফেল। সেটা ফাইভ বা সিক্স হবে, তেল দিয়ে স্নান করে, চপচপে বিনুনি করে, পাটপাট ধপধপে ইউনিফর্ম পরে, দিব্য স্কুলের প্রেয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে ভগবানের নাম করার জন্য হাঁ করেছি, কোন ম্যাজিকে সারা স্কুলবাড়ি, রাগী রাগী দিদিমণি, সিরিয়াস কাঁচুমাচু মুখের এক-ইস্কুল ছাত্রী পুরো ভ্যানিশ। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজল, রঙ্গিলা রে-এএএএএ। অমনি একটা সাসপেন্ডার্স লাগানো জামা পরে মাথায় টুপি হাতে লাঠি নিয়ে মিচকে হেসে আমির খান আমার চারদিকে ঘুরে ঘুরে গান গাইতে লাগলেন। পর দিন সকালে যখন ক্রিকেট কোচিং ক্লাসে গেলাম, ব্যাটটা তুলতে গিয়ে মনে হল এর থেকে লিপস্টিক অনেক বেশি হালকা। বিকেলে সাঁতার কাটতে গিয়ে জলের ভয়ে কেঁদে ফেললাম। জলের ক্লোরিনে আমার গায়ের রং আরও কালো হয়ে যাচ্ছে মনে পড়তেই কান্নার দমক প্রচণ্ড বেড়ে গেল। মা মারতে মারতে বাড়ি নিয়ে চলে এল।

এমনি করে, আমার জীবন বাঁইবাঁই ঘুরতে ঘুরতে যে জায়গাটায় এসে দাঁড়াল, সেখানে আমি কোনও হবু হিরো নই, ভাবী কেউকেটা নই, আমি স্রেফ আদ্যোপান্ত সে, যার হয়ে রবি ঠাকুর সেই কব্বে লিখে রেখে গেছেন, আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে। তুমি ভগবান, আর আমি আউট অ্যান্ড আউট ভক্ত। তুমি খেল কা ময়দান, আর আমি তোমার নিবেদিতপ্রাণ সাপোর্টার। আমার ভগবান একটার পর একটা চমৎকার করবে, আমি দেখব আর তালি দিয়ে চিৎকার করে সবাইকে অস্থির করে ছাড়ব।

তাতে প্রথমেই চোখে অন্ধকার দেখলেন আমার মাতা-পিতা। ঘরের দেওয়ালে পেন্টের দরকারই রইল না। যে দিকে তাকাও উড়ন্ত জন্টি রোড্স, সোনালি চুল শেন ওয়ার্ন, যিশুর হাসি দেল পিয়েরো, প্রাণখোলা অজয় জাডেজা, এমনকী পড়শি দেশের সুশান্তিকা জয়সিংহে, খোকা বয়সের স্টাইলবাজ আফ্রিদি। আর সবাইকে ছাপিয়ে লাইফ-সাইজ তেন্ডুলকর। মা প্রবল আপত্তি জানালেন, কখনও এ ঘরে ঘুমোতে এলে, ঘুম ভাঙলেই প্রচণ্ড চমক লাগে তাঁর। মনে হয় এক গাদা বাঘ-সিংহ চার দিক থেকে মাপছে। তা স্পোর্টসম্যানের চোখে-মুখে যুদ্ধসুলভ খুন্নস থাকলে আমি কী করব? আর আমি কিন্তু তখনও বন্ধুদলের তুলনায় নেহাতই বাচ্চা। তারা সব এমন খেলা-পাগল, ক্লাসের মধ্যে রো-ভাগ হয়ে গেছে, সচিন-ফ্যানরা এ দিকে, সৌরভরা ও দিকে। ক্লাসের কত জনের প্লেয়ারদের সঙ্গে স্বপ্নে কিসি কিসি শুরু হয়ে গেছে। আর আমি গবেট, সব ভাল প্লেয়াররা আমার নিরামিষ দাদা। আমার বাড়ির ছবিগুলোয় প্রতি ভাইফোঁটায় চন্দনের ফোঁটা গড়াচ্ছে, সেলোটেপ দিয়ে রাখি আটকাতে আটকাতে পাশের দেওয়ালের চটা উঠে গেছে।

প্রেম বাড়তে বাড়তে এমন হল, আমরা সবাই মিলে গো অ্যাজ ইউ লাইক-এ দাদাদের ব্যাট-প্যাড-গ্লাভস-হেলমেট চেয়ে ক্রিকেট টিম সেজে ফেললাম। দিদিমণিরা মাথা চুলকে অস্থির। তিনটে প্রাইজের জন্য প্রায় হাফ ক্লাস মেয়ে মিলে ক্রিকেট টিম বনে গেছে। এ বার প্রাইজ কি হাতুড়ি দিয়ে টুকরো টুকরো করবেন? তাই আমাদের বুক খানখান করে বললেন, ক্রিকেট টিম বসে পড়ো। প্রাইজ গেল সেই যারা প্রত্যেকবার পায় তাদের হাতেই। শূর্পণখা, খবরের কাগজের হকার আর জোকার।

ইংরেজি, বাংলা এমনকী সংস্কৃত ক্লাসে, আমার বাক্যরচনা দেখে সকলেই ভিরমি খেতে লাগল। সব বাক্যে ক্রিকেটের ছড়াছড়ি, আর কোপা আমেরিকা, ইউরো বা ওয়ার্ল্ড কাপের আশেপাশে ফুটবল। এক রসিকা প্রাজ্ঞ দিদি আমার হাফ-ইয়ারলির খাতা ক্লাসে ক্লাসে পড়ে শোনান। শোনো, সংস্কৃত পরীক্ষায় ‘অন্তরা’ দিয়ে বাক্য রচনা করেছে। সচিনম্, রাহুলম্ চ অন্তরা সৌরভঃ উপবিশতি।

জেগে থাকলে কাগজ থেকে ছবি আর স্পোর্টস-এর নিউজ কেটে কেটে স্ক্র্যাপবুক। ঘুমোলে সিরিয়াল-স্বপ্ন। তেন্ডুলকর প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসেন। কেন কে জানে, তাঁকে খাওয়ার ঘরে থাকতে দেওয়া হয়! বেবেতো’র সঙ্গে রোজই দেখা হয় স্কুল থেকে ফেরার পথে। তিনি পল্টুকাকার দোকানে খাতা কিনতে আসেন। আর মাথায় গাঁধী টুপি দিয়ে নয়ন মোঙ্গিয়া এসে আমাকে ইতিহাস পড়িয়ে যান মন দিয়ে।

সেই আমার সঙ্গে দেবতার এতাদৃশ বঞ্চনা! ’৯৬-এ ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপের আসর বসছে ভারতে। উদ্বোধনী ইডেন গার্ডেনস-এ। পুরো ক্রিকেট দুনিয়া কলকাতায় ভেঙে পড়েছে। অথচ, গিয়ে দেখা তো দূর, টিভিতে উঁকি মারাও পাপ। কারণ, অ্যানুয়াল পরীক্ষা নামক জল্লাদটিও আর এক হপ্তা দূর। এ দিকে দিদিরা অবধি ক্লাসে গল্প করছেন হগ মার্কেটে নাকি ক্রিস কেয়ার্নস-কে দেখেছেন। আঁকার ক্লাসে গিয়ে শুনি রণজয় বড়বাজারে ইনজামাম আর সাকলিন মুস্তাকের সঙ্গে কথা বলেছে। আমি পড়ার মাঝের বোর্নভিটায় ডেলা ডেলা কষ্ট গিলছি। হঠাৎ এক রবিবারে, সিলেবাস বোঝাই মাথাটা ফ্রেশ করিয়ে আনতে বাবা নিয়ে গেলেন গ্লোবে বাচ্চাদের সিনেমা দেখাতে। ফেরার পথে, নিউ মার্কেটে পুতুল কিনতে ঢুকেছি, তখন! মাঝারি উচ্চতা, সাদা পোশাকে গুলি গুলি বেরোচ্ছে কালো পেশি আর নীল রক্ত। টুপির আড়ালে ভীষণ চেনা দৃষ্টি। নাভি ফুঁড়ে চিৎকার বের হয়: ব্রা-য়া-ন লা-আ--রা! মুহূর্তে বাবার হাত ছাড়িয়ে দিগ্বিদিক ছুট, চকিতে কলরব আশেপাশে। কিন্তু সুপারম্যান তখন মার্কেটের গোলকধাঁধায় মিলিয়ে গেছেন। ভুল দেখলাম? নো ওয়ে ম্যান। সেই শিহরনেই আমি সে বারের অ্যানুয়াল পরীক্ষা নিবেদন করে দিলাম ওয়ার্ল্ড কাপের পায়ে। অঙ্ক পরীক্ষার আগের রাতে ইন্ডিয়া-পাকিস্তান কোয়ার্টার ফাইনাল। দু’ইনিংস নট নড়নচড়ন বসে, জাডেজাকে দিয়ে ওয়াকার ইউনিসকে পিটিয়ে, পাকিস্তানকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে ঘুমোতে গেলাম। পর দিন, পরীক্ষার খাতায় বহু চেনা প্রশ্নের উত্তর বেরোল সাত পূর্ণ একের পাঁচ জন শ্রমিক, বাবার বয়স নয় এবং ছেলের বয়স এগারো। এতটুকুও না ঘাবড়ে, ইডেনে ইন্ডিয়া-শ্রীলঙ্কা সেমিফাইনালের রাতেও বই-খাতা, পেনসিলবক্সকে তুকতাক করতে ব্যবহার করলাম। দেবী সরস্বতী তার বদলে ভারতকে কান্নার হার ধরালেন, ইডেনকে অপমানে স্নান করালেন, আমার বুকে ত্রিশূল।

পরের বছর থেকে আমি তো শিয়োর, ইন ফিউচার কোনও হ্যান্ডসাম বিপক্ষত্রাস ইন্ডিয়া প্লেয়ারের সঙ্গে আমার বিয়ে বাঁধা। শুধু, সেটা কে, তারই খোঁজ চলছে স্পোর্টসস্টারের পাতায়, কেঁদেকুটে নেওয়া কেব্লের স্পোর্টস চ্যানেলে। এখন থেকে না খুঁজলে, কী করে আর... নিশ্চয়ই সে বাড়িছে রঞ্জিতে, দলীপে, বা সারদাশ্রমের মাঠে। না কি লাতিন আমেরিকার কোনও স্কুল টুর্নামেন্টে?

ক্লাসে বসে আমি জানলা দিয়ে রোদ্দুরের খেলা দেখি। ঠিক এই রোদ্দুরই তো এখন এমনি করে পড়ছে মিনিট পনেরো দূরের ইডেনের বাইশ গজে। যেখানে প্যাভিলিয়ন এন্ড থেকে ছুটতে ছুটতে আসছে রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস, আর আশি হাজারের চিৎকারের মাঝে স্টান্স ঠিক করছেন সচিন তেন্ডুলকর। স্কুল বলে আমাকে যেতে দেয়নি। আই ডোন্ট কেয়ার। কেউ জানে না, আমি এখন কলকাতার রাস্তাঘাট চিনি। জানি খেলা না থাকলে ক্রিকেটাররা কোথায় কোথায় ঘোরেন। তাই, বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি বলে, মেট্রো পাকড়ে সেখানেই চলে যাব আমি বিকেলবেলায়। কালকেও যাব, কোচিং কেটে। পার্ক স্ট্রিট, এসপ্ল্যানেড। ঘুরতে ঘুরতে দশ-বারো-পনেরো বছর কোথা দিয়ে কেটে যায়। তার পর লায়েকবেলায় এক দিন এক অভিজাত রেস্তরাঁয়, ঢুকতে গিয়ে পাথর হয়ে দাঁড়াই মাখন দিয়ে তৈরি এক ভাস্কর্যের মুখোমুখি। চলতি কলকাতা টেস্টে ইন্ডিয়াকে নাকানিচোবানি খাওয়ানো ওস্তাদ ইংরেজ। আমার অটোগ্রাফ-ফোটোগ্রাফ, ই-মেলের আবদারবিহীন স্তব্ধ মুখে চোখ বুলিয়ে ঝকঝকে হেসে এগিয়ে গিয়ে আবার দুষ্টু দুষ্টু আড়চোখে তাকান। স্কুল লাইফে টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে এসটিডি বুথে ঘামতে ঘামতে তাজ বেঙ্গল ডায়াল করে ‘এটা কি টু থ্রি থ্রি থ্রি নাইন থ্রি নাইন/ দিন না ডেকে --কে একটি বার’-এর যন্ত্রণা আর কলেজ লাইফে ইডেনের ক্লাবহাউসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একলা ম্যাচ দেখার সাধনা সঅঅব— ওই তিন সেকেন্ডের খেলায় উইনিং স্ট্রোকটা মেরে স্টাম্প তুলে বেরিয়ে আসে। কেউ বিশ্বাস না করলে কিছু যায় আসে না, কারণ, বাকিটা জানেন শ্রীমান অ্যালিস্টেয়ার কুক।

এই দিওয়ানা-আখ্যান আর কত বলব? এখন খেলা দেখলে কেউ পড়তে বলে না। আর ফাটিয়ে দিচ্ছে আইপিএল। হ্যাঁ, বিচ্ছিন্নতাবাদী, প্রাদেশিকতা উসকানো আইপিএল। তাড়ু ক্রিকেট আর অপসংস্কৃতির বলিউডের ঝাঁঝালো ককটেল। কিন্তু আমার ক্রিকেট ফ্যানাটিক ফ্যান্টাস্টিক ফ্যান্টাসি-ফুল লাইফে, স্বর্গের কয়েকটা মাত্র আগের স্টেশন। কারণ, ওতেও আছে, আছে সে। সে আছে বলেই এত জেল্লা, এত রূপ, সেই জৌলুস। এত গ্ল্যামার থাকলে বকরাক্ষস, ঘ্যাঁঘাসুর, কাকাসুররাও ছুটে আসবেই। তবু সে তাদের এক ঘুসিতে শুইয়ে দেবে। তাকেই তো পাওয়া যায় কপিলের কান্নায়, সচিনের ধরা গলার বক্তৃতায়। সে থাকে জাডেজার প্রতিভা আর আজহারের কব্জিতে, যাকে কোনও কলঙ্কই ঢাকতে পারে না কোনও দিন। থাকে ধোনির শেষ ওভারের মস্তানিতে, যার ওপর শ্রীনির অর্ডার চলে না। থাকে হরভজনের থাপ্পড়ে, আর ইউসুফ পাঠানের ‘জিতাকে আতা হুঁ’-র হুঙ্কারে। থাকে হ্যান্সি ক্রোনিয়ের কবরেও, কোনও বুকি যাকে কিনতে পারেনি কোনও দিন। যার খিদে চব্বিশ বছর ধরেও মেটে না সচিনের। যেমন শেষ হয় না আমার জোশ-এর খিদে, এক্সাইটমেন্টের ভুখ! (একটু সিধু সিধু শোনাল?)

আর আছে নমন ওঝা, রাজস্থান আর দিল্লি ওকে ইনকনসিস্টেন্সি-র জন্য ছেড়ে দিয়েছে, এখন সানরাইজার্সে খেলে, ঠিক করে চান্স পায় না, কিন্তু নিজের দিনে দশ ওভারে ম্যাচ শেষ করার ক্ষমতা রাখে। তবে আপনারা কেউ চেনেন কিনা জানি না। আমি ওর জন্যই সারা বছর আইপিএল-এর দিকে জুলজুলে হৃদয়ে তাকিয়ে থাকি।

আপনারাও কি ওটার বা ওগুলোর কিছু পেয়ে গেছেন? নইলে এই এত ধিক্কারের পরেও ‘অব কি বার, কেকেআর’ বলছেন কেন? এ টিমে তো বাঙালি নেই, এ তো নাম কা ওয়াস্তে কলকাতার। তবে অবাঙালি অভারতীয় কতগুলো খেলোয়াড়, মাথা-গরম করে কাজ পণ্ড করা ক্যাপ্টেন আর ধুরন্ধর ব্যবসাবুদ্ধিসম্পন্ন মালিকের এই টিমখানাকে আমার বলে জাপ্টে ধরছেন কেন? আমার মতো কেন খুঁজছেন বেগুনি জামা? কেন সন্ধেবেলার জন্য সব কাজ সেরে রাখছেন?

আজ রাতে যদি না হ্যাঁ হয়, কাল থেকে শহরে আবার সাত ভূতের নৃত্য হবে। তখন আমার লেভেলের চেয়েও উচ্চাঙ্গের হিস্টিরিয়া, ক্রেজ, পাগলামি সহ্য করতে হবে কিন্তু।

আর কেকেআর হেরে গেলে? কী এসে যায়? আমার চার্জ তো ফুরোয় না। আমাকে জন আব্রাহাম বলেছে, আইপিএল শেষ হলেই দিন গোনা শুরু। শহরের রং বেগুনি থেকে বদলে হলদে-সবুজ, বা নীল-সাদা। আমি আবার উত্তেজনায়, ইমোশনে ফুটছি। বুকের মধ্যে থরথর কাঁপছে এক ফুজিয়ামা আগুন-ভালবাসা। আর, আর বারোটা দিন লাগবে ওর আসতে। ওই দেখুন ছুটতে ছুটতে আসছে ও। রেশম চুল, মায়াবী চোখ, স্বপ্নে দেখা সিংহশাবক-রাজপুত্তুর। লিয়োনেল মেসি, আমার লিয়ো, সেই ব্রায়ান লারা-বিকেলে দেখা আমার ‘দ্য লায়ন কিং’!

chirashree.majumdar@gmail.com

chirashree majumdar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy