Advertisement
E-Paper

খেজুরগ্রামের শিউলী

অমরেন্দ্র চক্রবর্তীনাম ‘সহদেব শিউলী’ শুনেই ফার্স্ট বেঞ্চ থেকে নিজের বই-খাতা নিয়ে সিদ্ধার্থ পিছনের বেঞ্চিতে সহদেবের ঠিক পাশে গিয়ে বসল। কয়েক বার আড়চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘ফুল ছাড়াও শিউলির আর একটা মানে আমি জানি।

শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৪ ০০:০০
ছবি: সুমন চৌধুরী।

ছবি: সুমন চৌধুরী।

নাম ‘সহদেব শিউলী’ শুনেই ফার্স্ট বেঞ্চ থেকে নিজের বই-খাতা নিয়ে সিদ্ধার্থ পিছনের বেঞ্চিতে সহদেবের ঠিক পাশে গিয়ে বসল। কয়েক বার আড়চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘ফুল ছাড়াও শিউলির আর একটা মানে আমি জানি। যারা খেজুরগাছে উঠে মাটির হাঁড়ি বাঁধে, তাদের শিউলী বলে, তাই না? তার পর সারা রাত ধরে হাঁড়িতে খেজুররস জমলে ভোরবেলা গিয়ে হাঁড়ি নামিয়ে আনে, তাই তো? আর শিউলিফুলের বানান কিন্তু ল-এ হ্রস্ব-ই, তোমাদের মতো দীর্ঘ-ঈ না।

‘আমি এখন আর গাছে হাঁড়ি বাঁধতে উঠি না। আমার বাপ-দাদারা উঠে গাছের বুক ছুলে হাঁড়ি বাঁধে।’

সহদেবের কথা শুনে সিদ্ধার্থ কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘তোমার পদবি তা হলে কেন এখনও শিউলী?’

এ প্রশ্নের উত্তর মনে হয় সহদেবকে অনেক বারই দিতে হয়েছে, সিদ্ধার্থর কথায় বলল, ‘শিউলী তো আমাদের পদবি না। আমাদের বাপ-পিতেমো, তাদের বাপ-পিতেমো খেজুরগাছ কেটে রস পাড়ত বলে গ্রামের সবাই আমাদের শিউলী বলেই জানে। আমাদের আসল পদবি ‘গায়েন’, আমি সহদেব গায়েন।’

‘তা হলে স্যর রোল-কলে তোমায় সহদেব শিউলী বললেন কেন?’

‘দাদা আমাকে ইস্কুলে ভর্তি করার সময় আমাদের সবার পদবি শিউলী বলে ফেলেছে। ভুল করে, বা হয়তো অভ্যেসে বলেছে। দাদা আমাদের বাপ-পিতেমোর মতোই কখনও ইস্কুলে পড়েনি। শিউলীদের মধ্যে আমিই প্রথম ইস্কুলে ভর্তি হয়েছি।’

সিদ্ধার্থ এ বারও কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল। সামনেই স্যরকে দেখে চুপ।

‘প্রথম দিনের পক্ষে যথেষ্ট আলাপ-পরিচয় হয়েছে। এ বার বল তো শিউলী কাল ভূমিকম্পের সময় কত বার ঘরবাড়ি দুলেছিল?’

‘তিন বার। একটু পর পর। প্রথম বার পৃথিবী দুলে উঠতেই আমরা সবাই এক একটা খেজুরগাছে উঠে বসেছিলাম। এ আমাদের নিয়ম।’

‘নামলি কখন?’

‘যখন দেখলাম, নীচে নদীর জলে চাঁদ আর উলটোপালটা দুলছে না।’

‘বা! বা! বেশ! এ বার শিউলীর সঙ্গে মিলিয়ে একটা শব্দ বল তো?’

‘বিউলি।’

‘যদি বলি হুতোমপুরের খাল, তুই কী বলবি?’

‘গরম মুগের ডাল।’

‘চমত্‌কার! তোমার চোখ-কান দুটোই তীক্ষ্ণ। জলে চাঁদের উলটোপালটা দুলুনি থামতে দেখে বুঝলে ভূমিকম্প থেমেছে। শিউলির সঙ্গে মিল খুঁজতে গিয়েই কানে ধরা দিল বিউলি। খালের সঙ্গে ডাল!’

সহদেবের পিঠ চাপড়ে স্যর ফিরে যাচ্ছিলেন, হঠাত্‌ দাঁড়িয়ে সিদ্ধার্থকে বললেন, ‘শুধু বই নয়, সেই সঙ্গে বাইরের গাছ, নদী আকাশ, বাতাস থেকেও শেখার আছে। দরকার শিউলীর মতো চোখ আর কান।’

প্রথম দিনেই শিউলীর প্রশংসা বেশির ভাগ ছেলেরই ভাল লাগেনি।

স্কুল ছুটি হতেই রাস্তায় যে যে ভাবে পারল তাকে খ্যাপাতে লাগল। ‘শিউলি, তবু ফুল নয়’ বলে ফার্স্ট বেঞ্চে গত ক’দিন আমার ডান দিকে বসা শৌভিক যেই বেসুরো গান ধরেছে, শিউলীও অমনি যোগ করল, ‘গাধা তা তো ভুল নয়’।

‘তুই কি ওকে ভ্যাঙাচ্ছিস?’ বলে

এ বার বিশ্বজিত্‌ তেড়ে এল।

সঙ্গে সঙ্গে শিউলীর উত্তর নির্দোষকেই ঠ্যাঙাচ্ছিস?

দু’তিন জন শিউলীর দিকে তেড়ে এল। বলল, মেরেই তোকে তাড়াব।

এ বারও শিউলী ওদের কথা কান না দিয়ে বলল, ‘আবার উঠে দাঁড়াব।’

সত্যিই এ বার শিউলীকে ওরা মারবে নাকি? সিদ্ধার্থ ভয় পেয়েও ওদের বোঝাবার চেষ্টা করল শিউলী তো কারও কোনও ক্ষতি করেনি, তা হলে ওকে অপমান করছ কেন?

এতেও কিছু লাভ হল না।

দলে ভারী হয়ে ওরা শিউলীকে ঘিরে ফেলল। এবং এক ধাক্কায় মাটিতে ফেলে বলল, ‘উঠে দাঁড়াবি? ওঠ!’

আর এক জন দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে এগিয়ে আসছে দেখে শিউলী বলল, ‘যে দিক পারিস ছোট!’ কথা শেষ হওয়ার আগেই দু’জনের পায়ের ফাঁক গলে এমন দৌড় লাগল, যেন গুলতি থেকে ছোড়া ঢিলের মতো উড়ে গেল।

ছেলের দল ‘ধর ধর’ করে তার পিছু ধাওয়ার চেষ্টা করল। ততক্ষণে সে সকলের চোখের নাগালের বাইরে।

খোঁজাখুঁজি করে একটা খেজুর গাছের মাথায় শিউলীকে দেখা গেল।

হিংস্র ছেলের দল তক্ষুনি দৌড়ে গিয়ে সেই খেজুরগাছ ঘিরে ফেলল। অনেকে আবার কাছেই নদীপাড় থেকে শুকনো মাটির টুকরো, ঢেলা নিয়ে এল শিউলীকে আক্রমণের জন্য।

আসলে খেজুরগ্রাম অর্ধেক গ্রাম, অর্ধেক শহর। গ্রামের পুব দিক ঘিরে যে শাখা নদী মনসানদীতে গিয়ে মিলেছে, সেই নদীর দিকটা গ্রাম। সেখানে শীতকালে শাক-সব্জির খেত ভোর-ভোর শিশিরে গা ধোয়। আর পশ্চিম দিক বেড় দিয়ে যে রেললাইন রূপকথাপুরের দিকে চলে গিয়েছে সে দিকটা প্রায় শহর। রাস্তাঘাট, দোকান-বাজার, লোকজনের পোশাক-আশাক, এমনকী মুখের ভাষাও অনেকটাই শহুরে। সেখানে ধুলো-ময়লা বাতাস ভারী হয়ে থাকে।

নদীপাড়ের খেজুরে গ্রামে শিউলী নিধনের জন্য ছেলেরা সবাই যখন তৈরি, এ কে ফোর্টি সেভেনের মতো তাদের হাতগুলো শিউলীকে তাক করে গুলি ছুড়ল বলে, হঠাত্‌ আকাশ থেকে আলতা-হলুদে চোবানো খেজুর-ছড়া তাদের সামনে এসে পড়তে লাগল।

‘লুফে নাও, মাটিতে পড়লে পাকা খেজুর সব নষ্ট হবে। ঢিল ফেলে দু’হাত বাড়িয়ে লুফে নাও।’

খেজুরগাছের ঝুপসি মাথা থেকে শিউলীর গলা শুনে হঠাত্‌ই সিদ্ধার্থর চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। মারমুখী ছেলের দল হাতের ঢিল ফেলে ভারী ভারী খেজুরের ছড়া লুফতে লাগল।

সিদ্ধার্থ দেখল, খেজুরগাছটা ক্রমশ লম্বা হতে হতে সদ্য ওঠা সন্ধ্যাতারাকে ছুঁতে চলেছে।

ছেলের দলের বুক শুকিয়ে গিয়েছে, তারা দেখল শিউলী খেজুরগাছ থেকে নীচের নদীতে লাফিয়ে পড়ল। তার পর নদী সাঁতরে ওপারের দিকে চলে গেল।

সিদ্ধার্থ ঝাপসা চোখে এ সব কিছুই দেখেনি। তার শুধু আবছা মতো চোখে পড়েছে, বিরাট একটা খেজুরগাছের মাথায় চড়ে শিউলী সন্ধ্যাতারার দিকে উঠছে তো উঠছেই।

এ গ্রামে সে আর ফেরেনি।

amarendra chakraborty
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy