Advertisement
E-Paper

খু দ কুঁ ড়ো

তিনি যখন ভাত খেতেন তখন বাস্তবিকই কোঁত কোঁত করে শব্দ হত। খেতেন আর চার দিকে তাকাতেন, কেউ দেখে ফেলছে কি না। যাদের খোরাক কিছু বেশি, তাদের একটু চক্ষুলজ্জাও তো থাকে। তাঁরও ছিল। বেশ বড় বড় গরাস ছিল তাঁর। পাঁচ-সাতটা বড় বড় মাছের টুকরো চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে যেত। সবাই দেখত। এ রকম খাইয়ে লোকের খাওয়া কি না দেখে থাকা যায়? তবে গৃহস্থকে বিপদে ফেলতেন না। বৃহৎ একটি মৎস্যখণ্ড তিনি নিজেই কিনে দড়িতে ঝুলিয়ে নিয়ে আসতেন।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০৫
ছবি: সুমিত্র বসাক

ছবি: সুমিত্র বসাক

তিনি যখন ভাত খেতেন তখন বাস্তবিকই কোঁত কোঁত করে শব্দ হত। খেতেন আর চার দিকে তাকাতেন, কেউ দেখে ফেলছে কি না। যাদের খোরাক কিছু বেশি, তাদের একটু চক্ষুলজ্জাও তো থাকে। তাঁরও ছিল। বেশ বড় বড় গরাস ছিল তাঁর। পাঁচ-সাতটা বড় বড় মাছের টুকরো চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে যেত। সবাই দেখত। এ রকম খাইয়ে লোকের খাওয়া কি না দেখে থাকা যায়? তবে গৃহস্থকে বিপদে ফেলতেন না। বৃহৎ একটি মৎস্যখণ্ড তিনি নিজেই কিনে দড়িতে ঝুলিয়ে নিয়ে আসতেন।

খোকাকাকু ছিলেন রেলের টিকিট চেকার। পাতলুনের ঝুল কিছুটা কম থাকতই তাঁর। কালো কোটের ধাতব বোতাম একটা-দুটো সর্বদাই মিসিং। ঘন ভ্রু, কানে বড় বড় লোম, মাথায় কোঁকড়া চুল, মুখে অতি সরল বোকা-হাসি, যা দেখে মনে হতে পারত যে, ইনি মস্তিষ্কের চর্চা বিশেষ করেন না। বলতে কি, খোকাকাকু তা করতেনও না। যখন চা খেতেন, তখন চায়ে চুমুকের যে শব্দ হত, তা আশপাশের ঘর থেকেও শোনা যেত।

অ্যাক্টিভিটি ছিল। কিন্তু খোকাকাকু বিশেষ বলিয়ে-কইয়ে মানুষ ছিলেন না। আর বললেও তাঁর কথা বিশেষ বোঝা যেত না। কারণ মুখে সর্বদাই থাকত পান আর কড়া গন্ধের জর্দা। একমাত্র খাওয়ার সময় ছাড়া পানহীন খোকাকাকুকে আমরা কখনও দেখিনি। কখনও হয়তো সকালে লুচি-তরকারি জলখাবার দেওয়া হয়েছে। উনি মুখ থেকে পানের ছিবড়েটা বের করে বাঁ হাতে মুঠো করে রাখতেন। জলখাবারের শেষে সেই ছিবড়েই ফের মুখে দিয়ে আরামে চিবোতেন।

আলিপুরদুয়ার জংশনের কাছাকাছি নানা ব্রাঞ্চ লাইনে তাঁর ডিউটি থাকত। তাঁর কোয়ার্টার ছিল বোধহয় মাল জংশন বা অন্য কোথাও। তাঁর পরিবারকে আমি কখনও দেখিনি। তিনিও পরিবারের কথা বিশেষ ফেঁদে বলতেন না। কথার কারবারি ছিলেন না। মাঝে মাঝে ওই লাইনে ডিউটি পড়লে আত্মীয়তার সূত্রে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হতেন। হাতে সর্বদাই অন্তত সের দেড় বা দুইয়ের রুই বা কাতলার টুকরো, পাটের দড়িতে ঝোলানো। এসেই ঠাকুমা আর মা’কে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতেন। আমার বাবা ছিলেন তাঁর ওপরওয়ালা এবং রাশভারী মানুষ। তাই খোকাকাকু তাঁর সম্মুখীন বিশেষ হতেন না।

আমাদের বাড়িতে রেলতুতো অতিথির কোনও অভাব ছিল না। মা’কে অসময়ে উনুন জ্বালিয়ে বাড়তি রান্না করতে যে কত দিন দেখেছি, তার হিসেব নেই।

খোকাকাকুর আনা মাছ রান্না করে তার বেশির ভাগটাই খোকাকাকুকেই খাইয়ে দিতেন মা। তিনিও অম্লানবদনে খেয়ে নিতেন।

খোকাকাকুকে আমরা কখনও মাতলামি করতে দেখিনি। কিন্তু সন্ধের পর তিনি যে একটু ঢুকুঢুকু করতেন, এ আমরা সবাই জানতাম। ঠাকুমা মাঝে মাঝেই বলতেন, খোকা রে, ওই ছাইভস্মগুলি আর খাইছ না। খোকাকাকু সঙ্গে সঙ্গে সাষ্টাঙ্গ হয়ে বলতেন, আর খামু না। এবং আবার খেতেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই খোকাকাকুই এক মাসের জন্য ঘুষ খাওয়া এবং মদ্যপান নাটকীয় ভাবে বন্ধ করে দেন বলে শুনেছিলাম। এক দিন এক কামরায় উঠে তিনি কম্বুকণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ভাইসব, দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমরা এখন স্বাধীন নাগরিক। দেশের প্রতি আমাদের পবিত্র কর্তব্য রয়েছে। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আজ থেকে আর ঘুষ খাব না। আপনারাও প্রতিজ্ঞা করুন, আজ থেকে আর বিনা টিকিটে রেলে চড়বেন না। দিন, আপনারা যাঁরা বিনা টিকিটের যাত্রী আছেন, সবাই আজ ফাইন দিন।

তাতে অনেক যাত্রীই অশ্রুবিসর্জন করলেন। অনেকে আবেগের বশে ফাইনও দিয়ে দিলেন। কামরায় কামরায় সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য। খোকা চেকারের বেশ নামডাকও হয়ে গিয়েছিল। তিনি মদ্যপান বন্ধ করে জর্দাপান ধরলেন। আর ঘন ঘন সিগারেট। সংযম ও আত্মত্যাগের এক দৃষ্টান্তই প্রায় স্থাপন করে ফেলেছিলেন তিনি।

এক মাস তো বড় কম সময় নয়। সংযম ও আত্মত্যাগ এক মাস বজায় রাখা বেশ কঠিন কাজ। কিন্তু মুশকিল হল, ভারতীয় রেলে বরাবরই বিনা টিকিটের যাত্রীর আধিক্য এবং রমরমা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেকের ধারণা হয়েছিল, এ তো এখন আমাদের রেল। টিকিট কাটতে যাব কোন দুঃখে? সুতরাং এই বিপুল, সংখ্যাগরিষ্ঠ অবৈধ যাত্রীর মিলিত শক্তির কাছে এক জন টিটি আর কতটুকু? তবু কালো কোটের মহিমাকে সম্মান জানাতে তারা চার আনা, আট আনা বাঁ হাতে দিতে রাজি। কিন্তু টিকিট কাটা তাদের ধাতে নেই।

সুতরাং মাসখানেকের শুখা কেটে আবার ঘুষের স্নিগ্ধ বর্ষণ নেমে এল। খোকা-টিটি ফের ঘুষ নিতে শুরু করলেন। তাতে পকেট খুশি, হাত খুশি, মনও ফুরফুরে, বিকেলে তৃষ্ণা মিটিয়ে ফের মদ্যপানও শুরু হয়ে গেল। অনেকেই তখন বলতে শুরু করল যে, দেশটা যে স্বাধীন হয়েছে, এটা তারা বুঝতে পারছে না। কথাটা আজও অনেকের মনে হয়। দেশটা যেন বেহাত হয়ে গিয়েছে। কারা চালাচ্ছে, ঠিক বুঝতে পারা যাচ্ছে না। খোকা-টিটির আর দোষ কী!

আজও যেন খোকাকাকুকে স্পষ্ট দেখতে পাই। কোঁত কোঁত করে খাচ্ছেন আর চার দিকে তাকাচ্ছেন, কেউ দেখে ফেলছে কি না।

shirshendu mukhopadhyay anandabazar rabibasariya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy