Advertisement
E-Paper

চোখাচোখি হতে আমাকেও লাড্ডু দিল

বেনারস যাব বলেই বেরিয়েছিলাম। কিন্তু নামলাম না। ইচ্ছে করল না। নিজের সিট থেকে উঠে অন্য কামরায় চলে গেলাম। মিশে গেলাম ভিড়ের মধ্যে। উত্তর ভারতীয় লোকজনই বেশি মনে হল। কমলা রঙের একটা স্রোত বইছে এখানে-সেখানে।

শুভময় মিত্র

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
ছবি: শুভময় মিত্র

ছবি: শুভময় মিত্র

বেনারস যাব বলেই বেরিয়েছিলাম। কিন্তু নামলাম না। ইচ্ছে করল না। নিজের সিট থেকে উঠে অন্য কামরায় চলে গেলাম। মিশে গেলাম ভিড়ের মধ্যে। উত্তর ভারতীয় লোকজনই বেশি মনে হল। কমলা রঙের একটা স্রোত বইছে এখানে-সেখানে। দেহাতি ভাষা, এখানে ওখানে ময়লা, অদ্ভুত কেয়স। ভাল লাগছিল। হিন্দি ভাল বুঝি না। তবু মনে হল বেশির ভাগ লোকই তীর্থ করতে যাচ্ছে। ঠাকুর-দেবতা, রামায়ণ-মহাভারতের কথা ভেসে আসছিল করিডরের ভিড়ের মাথা টপকে। দরজার গায়ে বাথরুমের আশেপাশে জল ভর্তি, দিব্যি লোকে বসে আছে ভিড় করে। পুঁটলি খুলে মোটা মোটা রুটি খাচ্ছে আচার দিয়ে। হয়ে গেলে ময়লা বেসিনের ট্যাপে মুখ দিয়ে জল খাচ্ছে জামাকাপড় ভিজিয়ে। জাহাজের মাস্তুলের মতো উঠে আছে লাল-হলুদ কাপড় জড়ানো, জরি লাগানো লাঠি। ধরে আছে উবু হয়ে বসে বসে দুলতে থাকা অনেকে। এই নির্বিকার ব্যাপারটা বেশ ভাল লাগল, দেখতে লাগলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। নিয়ম নেই, তাও এক জন বিড়ি খাচ্ছিল। চাইলাম। দিল।

কোন স্টেশনে আসছে সেটা আর দেখার প্রয়োজন ছিল না। কলকাতা-দিল্লি মেন লাইনে রয়েছি। ট্রেন যেমন চলছে চলুক, ইচ্ছে হলে নামা যাবে। ইচ্ছেটা হল বিকেলবেলা। একটা বড় দল নামার তোড়জোড় করছিল। তাদের সঙ্গেই নামলাম। দেখি এলাহাবাদ। ওদের সঙ্গেই হাঁটতে হাঁটতে এলাম বাসস্ট্যান্ডে। সবাই গাদাগাদি করে ঢুকল একটা বাসের ভেতরে। কিছু লোক ছাদে উঠল। আমিও। ছেড়ে দিল বাস। গাছ আছে দু’পাশে। তার নীচের ডালগুলো বাস, লরি গিয়ে গিয়ে ছোট হয়ে গেছে নিজে নিজেই। তবুও সামনের লোকদের দেখাদেখি মাথা নিচু করছিলাম। এই চলল ঘণ্টা তিনেক। তার পর সবাই নামছে দেখে বুঝতে পারলাম বাস আর যাবে না। নেমে টিকিটের দাম দিলাম। ছাদের লোকদের টিকিট দেওয়া হয় না। পেয়ে গেলাম আমার চেনা দলটাকে, এদের মধ্যে এক জন বয়স্ক লোক রয়েছে, ও-ই নিয়ে এসেছে সবাইকে। চোখাচোখি হল, মনে হল আমাকে চিনেছে। একটা বড় প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে সে সবাইকে কী সব দিচ্ছে। আমাকেও দিল। দুটো কলা, পেয়ারা আর লাড্ডু। তার মানে, আমি কি ওদের দলের এক জন হয়ে গেলাম? ওদের সঙ্গেই হাঁটতে শুরু করলাম। একেবারে বেঁকে যাওয়া এক বুড়ি, সেও চলেছে। এক হাতে লাঠি। পিঠে বোঁচকা। সেটা চাইলাম। দিয়ে দিল কোনও প্রশ্ন না করে, যেন আমাকে চেনে। তার পর আমার হাতটা ধরল। ঠান্ডা, শক্ত, খসখসে হাত। আশপাশটাও দেখছিলাম। সফিস্টিকেশনের প্রশ্নই উঠছে না। তবে বাড়িগুলো দেখে গরিব-বড়লোকের তফাতটা বোঝা যাচ্ছে। কেউ কোনও রকমে দেওয়াল, দরজা তুলে টিন বা টালি দিয়ে ছাদ অবধি করেছে। সম্পন্ন লোকের মকান চেহারায় বড়। উৎকট রং করা, বারান্দাগুলো সিনেমার সেটের মতো। একটা কমন ব্যাপার আছে। বাড়ির বাইরের উঠোন বা রাস্তার ধারটাও সংসারের মধ্যে পড়ে। বাচ্চারা খেলছে। বড়রা খাটিয়া পেতে গল্পগুজব করছে। মহিলারা বাসন মাজছে। কারুর দেওয়ালে হেলান দেওয়া পুরনো সাইকেল। কারুর হুমদো গাড়ি। ছাদে ডিশ অ্যান্টেনা কিন্তু সবারই।

একটা মোড় ঘোরার পর চার পাশটা একটু বদলে গেল। নিঃসন্দেহে এটা শহরের পুরনো অংশ। ধর্মীয় দোকানপাটও বেশি। কাপড়, ঠাকুর-দেবতার ছবি, বই, মিষ্টি, হাঁড়ি, হিন্দিতে ছাপানো নামাবলি। প্রচুর মালা, ফুলপাতা। একটা চেনা গন্ধ, কালীঘাটের মন্দিরে ঢোকার সময় পাওয়া যায়। ভিড়ের মধ্যে দিয়েই ঝড়ের মতো অটোরিকশা যাচ্ছে আসছে লোক বোঝাই করে। নানা রঙের এলইডি আলো জ্বলছে। গানও চলছে। ভজন নিশ্চয়ই। এ বার ছোটবড় মন্দির দেখা যাচ্ছে। ঘাট দেখতে পেলাম। আর জল। নৌকোও আছে। থামল আমাদের দলটা। বুড়ি আমার হাত ছেড়ে দিল। মনে হল হাঁপাচ্ছে। এই প্রথম আমার খেয়াল হল, কোথায় এসেছি সেটাই জানি না। এই জায়গার নাম কী সেটা তো আর কাউকে জিজ্ঞেস করা যায় না। দোকানের সাইনবোর্ড খুঁজলাম, সুবিধে হল না। কায়দা করে এক জনকে টুরিস্টসুলভ আগ্রহ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আজ কী আছে? বলল, অমাবস্যার রাতে ভিড় হয়, পুজো আছে। একটু পরে আরতি হবে। কথা বলতে বলতে জেনে গেলাম, জায়গাটার নাম চিত্রকূট। নদীটা মন্দাকিনী। রাম-সীতার ব্যাপার। দলটা আবার চলতে শুরু করল। বুড়ি আবার আমার হাত ধরল। ঘাটগুলো বেনারসের মতো বড় নয়, নদীটাও ছোট। তাই ভিড়টা একটু বেশিই মনে হচ্ছিল। আরও লোক আসছে। বসছে দল বেঁধে। একটু জায়গা ফাঁকা পাওয়ায় আমাদের দলটাও বসবে বলে মনে হল। বসলেই ভাল, পা ব্যথা করছে। চাদর বের করছে দলের নেতা। ওর সঙ্গে আমার কোনও কথা হয়নি এখনও পর্যন্ত। কিন্তু সে আমাকেও বসতে বলল।

আরতি শুরু হল কিছুটা দূরে। সন্ধে হয়ে গেছে। মাইকে মন্ত্র পড়া আর গানও শুরু হল। পেতলের তৈরি একশো আট প্রদীপের আলোটা নাচতে লাগল প্রায় মিলিয়ে যাওয়া কালচে আকাশে। ঠাকুর, দেবতা, ধর্ম নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। কিন্তু ভেসে আসা গানের সঙ্গে, সবার সঙ্গে আমিও হাতের তালুতে হালকা চাপড় দিতে লাগলাম। বেশি ক্ষণ আরতি হল না। কেউ কেউ গেল পুরোহিতের হাতের প্রদীপ থেকে তাপ নিতে। তালুতে উত্তাপটুকু যত্ন করে বয়ে নিয়ে এসে ছুঁইয়ে দিল অন্যদের মাথায়। পুরোহিত ফিরে গেল মূল মন্দিরের দিকে, সেটা ওপরে কোথাও হবে। আমাদের দলের পান্ডা এবং আরও কয়েক জন তার সঙ্গে গিয়ে, ফিরে এল প্রচুর খাবার নিয়ে, মিষ্টিই বেশি। সবাইকে ভাগ করে দিয়ে শেষে আমাকে দিয়ে, আকাশের দিকে মুখ করে প্রণাম করে, নিজেও নিল। তার পর আমার পাশে বসে পড়ল। বলল, ‘আজ আমাদের সবার জীবন ধন্য।’ আমি সম্মতি জানালাম। নিজেকে একটু দোষী মনে হচ্ছিল। তীর্থযাত্রী সেজে ওদের সঙ্গে ভিড়ে গেছি, কোনও কাজে লাগছি না। এখনও পর্যন্ত খরচাপাতিও করিনি। একটু কথা বললাম, ভদ্রতার খাতিরেই। ওই রামায়ণ, পাপপুণ্য, ঈশ্বর, পৃথিবী, ভালবাসা নিয়ে। কিন্তু আসলে আমি যে ধর্মভীরু নই সেটা বুঝে ফেলে লোকটা অল্প হাসল। রাগল না। বলল, ‘তোমার দোষ নেই। যেটা জানো না, সেটা বুঝবে কী করে? বিশ্বাস তো অনেক দূরের ব্যাপার।’ চুপ করে রইলাম। ‘এটা তো মানবে যে এত বছরের মানুষের বেঁচে থাকার যাবতীয় দায় আমাদের ওপরেই বর্তায়। তোমার বাবার করা বাড়িতে তুমি থাকছ, তাই না? আবার দেশ যদি বিক্রি হয়ে যায় তা হলে তোমাকেও ভুগতে হবে।’ খটকা লাগল। শুধু ধর্মকথা নয়। ‘তাই মানুষের ভাল করে যাও, যে ভাবে পারো, পুণ্য সঞ্চয় করো পুণ্যস্থানে এসে। কতখানি, সেটা মাপার ক্ষমতা আমাদের কারুর নেই। এত হাজার বছরের মানুষের কর্মফলকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায়ও নেই। এটা সত্যি যে পাপের ভারটাই বেশি। নিজে পুণ্য করে তার ক্ষালনের চেষ্টা করা যেতেই পারে। এতে শেষ নিশ্বাস নেওয়ার আগে তুমি নিজে বুঝবে সবটা, শান্তিতে মরবে।’ অবাক হয়ে তাকালাম। লোকটা শান্ত ভাবে বলল, ‘একটা জিনিস দেখাই।’ মুখ ফিরিয়ে দেখি নীল আভায় ভাসছে ওর মুখ। পোঁটলা থেকে বের করেছে একটা ট্যাব। আঙুল চলছে টাচস্ক্রিনে। আওয়ার গ্লাস ঘুরছে। অপেক্ষা। নাসা-র ওয়েবসাইট খুলল।

suvolama@gmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy