Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

চার্চ-নগরী

মিস্টার ফিলিপ্‌স বললেন, ‘হ্যাঁ, আমাদের এ শহরটা সত্যিই একটা চার্চ-নগরী।’ লোকটার উঁচোনো আঙুলের দিকে তাকিয়ে সিসিলিয়া মাথা নাড়ল। রাস্তার দু’দিকে সারি সারি চার্চ, কাঁধে কাঁধ ঘষে দাঁড়িয়ে। স্থাপত্যের নানা বৈচিত্র সেগুলোয়।

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

ডোনাল্ড বার্থেল্‌ম

আমেরিকা

মিস্টার ফিলিপ্‌স বললেন, ‘হ্যাঁ, আমাদের এ শহরটা সত্যিই একটা চার্চ-নগরী।’ লোকটার উঁচোনো আঙুলের দিকে তাকিয়ে সিসিলিয়া মাথা নাড়ল। রাস্তার দু’দিকে সারি সারি চার্চ, কাঁধে কাঁধ ঘষে দাঁড়িয়ে। স্থাপত্যের নানা বৈচিত্র সেগুলোয়। হোলি মেসাইয়া ফ্রি ব্যাপটিস্ট চার্চের পাশেই দ্য বেথেল ব্যাপটিস্ট, গ্রেস ইভানজেলিকাল কোভেন্যান্ট-এর পাশে সেন্ট পল্স এপিসকোপাল। তার পর একে একে ফার্স্ট ক্রিশ্চান সায়েন্স, দ্য চার্চ অব গড, অল সোল্স, আওয়ার লেডি অব ভিকট্রি, সোসাইটি অব ফ্রেন্ডস, অ্যাসেম্বলি অব গড আর চার্চ অব দ্য হোলি অ্যাপোস্ল্‌স। সনাতন ভবনগুলোর সর্পিল সিঁড়ি আর বুরুজগুলোর পাশেই ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়েছিল হাল ফ্যাশনের প্রশস্ত সব সিঁড়ি। ‘চার্চ-সংক্রান্ত ব্যাপারস্যাপারে এখানে লোকে বেশ আগ্রহী’, মিস্টার ফিলিপ্‌স বললেন। আর সিসিলিয়া ভাবছিল ওর আদৌ এ সব পটবে কি না। একটা ভাড়া-গাড়ি কোম্পানির শাখা-অফিস খোলার জন্যই ওর প্রেস্টার-এ আসা।

রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায়ী মিস্টার ফিলিপ্‌সকে সিসিলিয়া বলল, ‘আমি ঠিক ধার্মিক গোছের নই।’

‘এখন নন’, তিনি বললেন, ‘এখনও হয়তো নন। কিন্তু এখানে চমত্‌কার সব অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে আছে। সেই দলে শিগগিরই মিশে যাবেন আপনি। কিন্তু এই মুহূর্তে সমস্যাটা হচ্ছে, আপনি থাকবেন কোথায়? এখানে বেশির ভাগ লোক নিজেদের পছন্দের চার্চেই থাকে। আমাদের এখানে সব চার্চেই অনেকগুলো বাড়তি ঘর আছে। আমি আপনাকে কয়েকটা ঘণ্টাঘর দেখাতে পারি, যেগুলো আমার হাতে আছে। আপনি কত ভাড়ার ঘর চাইছেন সেটা যদি বলেন।’

ওরা একটা বাঁক পেরোতেই ফের অনেকগুলো চার্চ দেখা গেল। ওরা একে একে পেরিয়ে গেল সেন্ট লুক’স, চার্চ অব দি এপিফ্যানি, অল সেন্টস ইউক্রেনিয়ান অর্থোডক্স, সেন্ট ক্লেমেন্টস, ফাউন্টেন ব্যাপটিস্ট, ইউনিয়ন কংগ্রিগেশনাল, সেন্ট অ্যানারজিরিস, টেম্পল এমানুয়েল, ফার্স্ট চার্চ অব ক্রাইস্ট রিফর্মড। সব চার্চের সামনেটা হাট করে খোলা। ভেতরে টিমটিমে আলো দেখা যাচ্ছিল।

সিসিলিয়া বলল, ‘আমি একশো দশ অবধি দিতে পারব। কিন্তু আপনার হাতে এমন কোনও বাড়ি নেই যেগুলো চার্চ নয়?’

মিস্টার ফিলিপ্‌স বললেন, ‘নাহ্! তবে আমাদের এই সব চমত্‌কার চার্চগুলো অন্য অনেক কাজেও লাগে।’ তিনি একটা সুন্দর জর্জিয়ান ভবনের বাইরেটা দেখিয়ে বললেন, ‘ওই যে, ওতে যেমন রয়েছে ইউনাইটেড মেথডিস্ট চার্চ, আর তার সঙ্গে বোর্ড অব এডুকেশন। তার পরেরটা অ্যান্টিয়ক পেন্টেকোস্টাল, ওখানে আছে নাপিতের দোকান।’

ঠিকই। লাল-সাদা ডোরাকাটা নাপিতের চিহ্ন-আঁকা একখানা খুঁটি অ্যান্টিয়ক পেন্টিকোস্টাল-এর সামনে দায়সারা পড়ে আছে বটে। সিসিলিয়া জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে কি গাড়ি ভাড়া দেয় এমন অনেক লোক আছে? না কি একটা সুবিধেজনক জায়গা পেলে লোকে সেখান থেকে ভাড়া নেবে?’ মিস্টার ফিলিপ্‌স বললেন, ‘তা বলতে পারব না। গাড়ি ভাড়া করা মানে কোথাও যাওয়া। এখানে অধিকাংশ লোকই নিজের নিজের জায়গাতে ভাল আছে। আমাদের নানা কাজকর্ম। তবে আমি হলে এই গাড়ি-ভাড়ার ব্যবসাটা অন্তত করতাম না। কিন্তু আপনি ভালই চালাবেন।’

তিনি সিসিলিয়াকে একখানা ছোট্ট কিন্তু অত্যাধুনিক ভবন দেখালেন, যার সামনেটা ইট ইস্পাত আর কাচ দিয়ে বানানো, খুব শক্তপোক্ত। ‘ওটা সেন্ট বার্নাবাস। আচ্ছা আচ্ছা লোকেরা থাকে ওখানে। রাতের খাবারে দারুণ স্প্যাগেটি খায়।’

সিসিলিয়া দেখল, অনেকগুলো মাথা জানলা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু সিসিলিয়া ও-দিকে তাকিয়ে আছে দেখে মাথাগুলো অদৃশ্য হয়ে গেল।

‘এতগুলো চার্চ এক জায়গায় একসঙ্গে, এটা কি একটা ভাল পরিবেশ?’ সিসিলিয়া তার গাইডকে বলল, ‘ব্যাপারটাকে ঠিক সুস্থ বলে মনে হয় না। কী বলতে চাইছি, বুঝতে পারছেন আশা করি।’

মিস্টার ফিলিপ্‌স বললেন, ‘আমাদের চার্চগুলোর জন্যই আমরা বিখ্যাত। নিরীহ, নির্দোষ ওগুলো। এই যে, এসে পড়েছি।’

তিনি একটা দরজা খুললেন। তার পর অনেকগুলো ধুলোভর্তি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন দুজনে। সিঁড়ির শেষে তাঁরা ঢুকলেন বেশ বড় একখানা ঘরে। চৌকো ঘরটার চার দিকেই জানলা। এ ছাড়া একটা বিছানা, একটা টেবিল, দুটো চেয়ার, আলো, একখানা কম্বল। ঘরের ঠিক মাঝামাঝি ঝুলছিল পেল্লায় চারটে পেতলের ঘণ্টা। মিস্টার ফিলিপ্‌স বিস্ময়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কী অসাধারণ! এসে দেখুন এ দিকে।’

ছবি: সায়ন চক্রবর্তী।

সিসিলিয়া জিজ্ঞেস করল, ‘ওরা সত্যি সত্যিই ঘণ্টাগুলো বাজায়?’ মিস্টার ফিলিপ্‌স হেসে বললেন, ‘দিনে তিন বার, সকাল-দুপুর-রাত্রি। ওরা যখন ওগুলো বাজাবে, আপনাকে অবশ্যই চটজলদি সরে যেতে হবে। নইলে এই চার বিচ্ছুর কোনও একটায় মাথা ঠুকে গেলে সর্বনাশ। মানে আগের মেয়েটা তা-ই লিখেছিল আর কী।’

সিসিলিয়ার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘হায় ভগবান,’ তার পর সে বলল, ‘ঘণ্টাঘরে কেউ থাকে না। সে জন্যই খালি এগুলো।’

‘আপনার তাই মনে হচ্ছে?’ মিস্টার ফিলিপ্‌স বললেন।

সিসিলিয়ার গলায় স্পষ্ট অনুযোগ, ‘এ শহরে নতুন যারা, ঘণ্টাঘরগুলো তাদেরকেই শুধু ভাড়া দিতে পারেন আপনারা।’

মিস্টার ফিলিপ্‌স বললেন, ‘আমি তা করব না। সেটা খ্রিস্টীয় সৌহার্দ্যের পরিপন্থী হবে।’

‘শহরটা কেমন একটা গা ছমছমে, আপনি কি তা জানেন?’

‘হতে পারে, কিন্তু আপনার সেটা বলা ঠিক নয়, তাই না? মানে বলতে চাইছি, আপনি এখানে নতুন। কিছু দিন একটু সাবধানে হাঁটাচলা করবেন। আর যদি ওপরতলার ঘর না চান, সে ক্ষেত্রে সেন্ট্রাল প্রেসবিটারিয়ান চার্চের বেসমেন্টে আমার একটা ঘর রয়েছে। তবে সেখানে এখন দুজন মহিলা আছেন। আপনাকে ওদের সঙ্গে থাকতে হবে।’

সিসিলিয়া বলল, ‘আমি শেয়ার করতে চাই না। নিজের একটা জায়গা চাই।’

রিয়েল এস্টেটের লোকটি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন? কী জন্য?’

‘কী জন্য?’ সিসিলিয়া বলল, ‘কোনও কিছুর জন্য নয়। ব্যস চাই।’

‘একা থাকাটা এখানে চল নয়। বেশির ভাগ লোকই অন্যের সঙ্গে থাকে। স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে। ছেলেপুলেরা মা’র সঙ্গে। নয়তো রুমমেটের সঙ্গে। এটাই এখানকার রীতি।’

‘সে যা-ই হোক, আমি নিজের মতো একটা জায়গা চাই।’

‘সেটা খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার হবে।’

‘আপনার হাতে সে রকম ঘর আছে কি? মানে, ঘণ্টাঘর ছাড়া?’

স্পষ্টতই অনিচ্ছুক গলায় মিস্টার ফিলিপ্‌স বললেন, ‘মনে হচ্ছে কয়েকটা আছে। দু-একটা দেখাতে পারব আশা করি।’

একটু চুপ করে থাকলেন তিনি। তার পর বুঝিয়ে বললেন, ‘আমাদের আলাদা কিছু মূল্যবোধ আছে। মানে আশপাশের গোষ্ঠীগুলোর থেকে আলাদা আর কী! আমাদের নিয়ে লেখালেখিও হয়েছে বিস্তর। এক সময় ‘সিবিএস ইভনিং নিউজ’ চার মিনিট খবর করেছিল আমাদের নিয়ে। বছর তিন-চার আগে। ‘চার্চ নগরী’ শিরোনামে।’

সিসিলিয়া বলল, ‘যদি আমাকে এখানে থাকতেই হয়, তা হলে আমার একটা নিজস্ব ঘর দরকার।’

‘আপনার তো অদ্ভুত মনোভাব দেখছি! আপনার ধর্মসম্প্রদায়, মানে গোষ্ঠীনামটা কী?’

সিসিলিয়া চুপ করে রইল। ওর সে রকম কোনও নামই ছিল না। মিস্টার ফিলিপ্‌স ফের জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী, আপনার গোষ্ঠীনামটা কী?’

সিসিলিয়া বলল, ‘আমি ইচ্ছে করলেই স্বপ্ন দেখতে পারি। যা ইচ্ছে স্বপ্ন দেখতে পারি। ধরুন আমি প্যারিস বা অন্য কোনও শহরে দারুণ সময় কাটাচ্ছি, এই স্বপ্ন দেখতে চাই, তা হলে আমাকে ঘুমোতে হবে, ব্যস। সেই স্বপ্নই দেখব আমি। আমি যা চাই, স্বপ্নে তা-ই দেখতে পারি।’

ওর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে মিস্টার ফিলিপ্‌স বললেন, ‘বেশির ভাগ সময় কী ধরনের স্বপ্ন দেখেন আপনি?’

‘বেশির ভাগই যৌনতা নিয়ে’, সিসিলিয়া বলল। লোকটাকে দেখে ওর কোনও ভয়-টয় লাগছিল না।

অন্য দিকে তাকিয়ে মিস্টার ফিলিপ্‌স বললেন, ‘প্রেস্টার সে রকম শহর নয়।’

রাস্তার দু’দিকেই চার্চগুলোর দরজা তখন খুলে যাচ্ছিল। ছোট ছোট দলে লোকেরা বেরিয়ে আসছিল, দাঁড়িয়ে পড়ছিল চার্চগুলোর সামনে, সিসিলিয়া ও মিস্টার ফিলিপ্‌সকে দেখছিল।

এক তরুণ এগিয়ে এসে চেঁচাল, ‘এ শহরে সব্বার গাড়ি আছে। এমন কেউ নেই যার গাড়ি নেই।’

মিস্টার ফিলিপ্‌সকে সিসিলিয়া জিজ্ঞেস করল, ‘সত্যি?’

তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, সত্যি। এখানে কেউ গাড়ি ভাড়া নেবে না। আগামী একশো বছরেও না।’

মেয়েটি বলল, ‘তা হলে এখানে থাকব না। অন্য কোথাও যাব।’

‘না আপনি থাকুন,’ মিস্টার ফিলিপ্স বললেন। ‘মাউন্ট মোরিয়া ব্যাপটিস্ট চার্চের লবিতে একটা ভাড়া-গাড়ির অফিস আগে থেকেই আছে। ওখানে একটা কাউন্টার আছে, একটা টেলিফোন, এক গোছা চাবি। একটা ক্যালেন্ডারও।’

‘আমি থাকব না,’ সিসিলিয়া বলল, ‘ভাল ব্যবসাই যদি না হল তো থেকে কী লাভ?’

‘আমরা আপনাকে চাই। আমরা চাই, প্রতি দিন কাজের সময় ভাড়া-গাড়ি অফিসের কাউন্টারে আপনি দাঁড়িয়ে থাকবেন। শহরটা তাতে একটা পূর্ণতা পাবে।’

মেয়েটি বলল, ‘অসম্ভব। আমি থাকব না।’

‘আপনাকে থাকতেই হবে। আপনার থাকাটা খুব জরুরি।’

মেয়েটি বলল, ‘আমি এমন সব স্বপ্ন দেখব যা আপনাদের পছন্দ হবে না।’

‘আমরা খুব দুঃখী,’ মিস্টার ফিলিপ্‌স বললেন, ‘ভয়ংকর অতৃপ্ত, অসুখী আমরা। কিছু একটা গণ্ডগোল আছে।’

‘আমি গোপন সব স্বপ্ন দেখব,’ মেয়েটি বলল, ‘আপনারা দুঃখ পাবেন।’

লোকটি বললেন, ‘এ শহরটা বাইরে থেকে অন্য সব শহরের মতোই। শুধু এক্কেবারে খুঁতহীন,পরিপূর্ণ। আমাদের ভেতরকার অসুখকে চেপেচুপে রাখতে পারে শুধু এই পূর্ণতা। ভাড়া-গাড়ি অফিসের জন্য আমরা একটা মেয়ে চাই। ওই কাউন্টারের ও-পারে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। হবেই।’

সিসিলিয়া হুমকি দিল, ‘আমি এমন জীবনের স্বপ্ন দেখব, যা আপনাদের কাছে ভয়ংকর।’

‘আপনি আমাদের,’ মেয়েটির হাত আঁকড়ে ধরে মিস্টার ফিলিপ্স বললেন। ‘আমাদের ভাড়া-গাড়ি অফিসের মেয়ে। আপনার কিচ্ছু করার নেই।’

সিসিলিয়া বলল, ‘ঠিক আছে, দেখা যাবে!’

অনুবাদ: উজ্জ্বল সিংহ।

singha.ujjal@yahoo.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE