Advertisement
E-Paper

চিরকুট

বেশ কয়েক মাস ধরেই ‘কুকুর ছানা পুষব’ বলে বায়না করছিল কুট্টুস। সবে তার ক্লাস টু হয়েছে। ‘পরীক্ষা হয়ে যাক, আমরা সমুদ্রের ধারে বেড়িয়ে আসি’ ইত্যাদি বলে কুট্টুসের মা-বাবা দেরি করাতেই চাইছিলেন। সকালে কুট্টুসের স্কুল। তার একটু পরে বাবা-মাও অফিস চলে যান। রান্নাঘর, দোকান যিনি সামলান, সেই গীতাপিসি বাড়িতে একা থাকেন। কুট্টুসের স্কুল বাস এলে গলির মোড় থেকে ওকে নিয়ে আসেন।

অনিতা অগ্নিহোত্রী

শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৫ ০২:১৭

বেশ কয়েক মাস ধরেই ‘কুকুর ছানা পুষব’ বলে বায়না করছিল কুট্টুস। সবে তার ক্লাস টু হয়েছে। ‘পরীক্ষা হয়ে যাক, আমরা সমুদ্রের ধারে বেড়িয়ে আসি’ ইত্যাদি বলে কুট্টুসের মা-বাবা দেরি করাতেই চাইছিলেন। সকালে কুট্টুসের স্কুল। তার একটু পরে বাবা-মাও অফিস চলে যান। রান্নাঘর, দোকান যিনি সামলান, সেই গীতাপিসি বাড়িতে একা থাকেন। কুট্টুসের স্কুল বাস এলে গলির মোড় থেকে ওকে নিয়ে আসেন।

কুকুরছানার দেখাশোনা করবে কে? অনেক দায়িত্বের ব্যাপার বাড়িতে পোষ্য রাখা।

কুট্টুস বলে, কেন, আমি দেখব? তুমিই তো বলো, আমি বড় হয়ে গেছি।

কী রকম ছানা পোষা হবে, তাই নিয়ে প্রবল উত্তেজনা। রাতে খাওয়ার পর বাবার সঙ্গে বসে ইন্টারনেটে নানা রকম কুকুরের ছবি দেখে কুট্টুস। তার পছন্দ বড়সড় কুকুর— লাব্রাডর, অ্যালসেশিয়ান, জার্মান শেফার্ড... ভাল করে ট্রেনিং দিলে কুট্টুসের বন্ধু হয়ে যাবে। তাই, মার সঙ্গে মায়ের বন্ধু আনন্দিতামাসির বাড়ি বেড়াতে গিয়ে যখন কুট্টুস দেখল ওদের চিহুয়াহুয়া বাবা-মার চারটে ছানা হয়েছে, তখন মা সে দিকে বিশেষ মন দেননি। কারণ, চিহুয়াহুয়ারা একেবারে ছোট কুকুর, বড় হয়েও তাদের সাইজ হুলোবেড়ালের চেয়ে বড় হয় না। কিন্তু কী যে হল, মা আর আনন্দিতামাসি যখন গল্পে ডুবে আছে, চিরকুট মাটিতে বসে মা-চিহুয়াহুয়া আর ছানাদের খেলা দেখছে। বাবা-মা কুকুর দু’জন মোটাসোটা, বড়সড়। তিনটে ছানা, যাদের বয়স তিন মাস সবে, গোলগাল মতো। কিন্তু চতুর্থ ছানাটা রোগা, সামনের ডান পায়ে একটু বুঝি দুর্বল ভাব আছে, কিছুটা খুঁড়িয়ে হাঁটে। রবারের একটা খেলনা আছে, সেটা একটা গোলাপি রঙের বুট জুতো, মাড়িয়ে দিলে ভেঁপু বাজে। তিনটে ছানা সেটা নিয়ে মারামারি করে খেলছে। তার ফাঁকে কখন যে চতুর্থ ছানাটা আস্তে আস্তে খুঁড়িয়ে এসে কুট্টুসের কোলে নিজের সামনের ডান পা’টা তুলে দিয়েছে, কেউ দেখতে পায়নি। দিব্যি ওর কোলে গুটিসুটি মেরে বসেছে ছানাটা। কুট্টুস একটু আঙুল বুলিয়ে দেখল, কী সুন্দর সিল্কের মতো আর নরম গা, বড় বড় কান, যেন হরিণ ছানা। বলের মতো গোল মাথা, তাতে বাদামি ছোপ। কুট্টুসের কোলে শুয়ে ওর চোখ জড়িয়ে আসছে ঘুমে।

বাড়ি ফিরে আসার সময় কোল থেকে নামিয়ে ছানাটাকে ওর নিজের বিছানায় রেখে আসতে হল। তার পর থেকেই কুট্টুসের মন খারাপ। খাবার সময় দু’আঙুলে ভাত নাড়াচাড়া করছে, খেলতে খেলতে আনমনা হয়ে পড়ছে। মা তো ঠিক বুঝেছেন, বললেন, কী হল কুট্টুস?

মা, ও না নিজে এসে আমার কোলে থাবাটা রেখেছিল!

তাতে কী! ও তো ছোট্ট কুকুর। চিহুয়াহুয়ারা এমনিতেই বড় হয় না। ও রকম ছোটই রয়ে যাবে, বয়স বাড়লেও।

কুট্টুস চুপ করে রইল। খানিক ক্ষণ পর বলল, তোমার ফোন থেকে আনন্দিতামাসির নম্বরটা দেবে? ছানাটা কেমন আছে জিজ্ঞেস করব। কখন ঘুমোয়, কী খায়...

মা কাগজে লিখে দিলেন নম্বরটা। মনে মনে হাসলেন। দিন পনেরো পর আনন্দিতামাসি একটা তোয়ালে দিয়ে আধ ঢাকা বেতের ঝুড়িতে করে কিছু একটা নিয়ে ঢুকলেন। সন্ধেবেলা। কুট্টুস ওদের হাউসিং সোসাইটির মাঠ থেকে খেলে ফিরে এসেছে একটু আগে। বাড়ির নীচেই দাঁড়িয়ে ছিল গীতাপিসির সঙ্গে। লাফাতে লাফাতে ফিরে এল।

তোয়ালের নীচে গুটিসুটি হয়ে ঘুমোচ্ছে চার নম্বর ছানাটা। মাথাটা রেখেছে ওর দুর্বল ডান পায়ের ওপর।

কী মজা, কী মজা! আমি খেলব ওর সঙ্গে! তুমি একটু ক্ষণ থাকবে তো, মাসি?

না, না, এখন থেকে ও তোমার কাছেই থাকবে কুট্টুস। দেখলে না কেমন তোমার কোলে চলে এসেছিল?

মায়ের দিকে তাকাতেই মা বললেন, ল্যান্ডফোনে রিডায়াল বোতাম টিপতেই আনন্দিতার নম্বর পেয়ে যাচ্ছি আজকাল। তার মানে আনন্দিতার সঙ্গে নিয়মিত কথা বলছে এ বাড়ির কেউ!

কুট্টুস লজ্জা পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল।

তোমাকে শিং দিয়ে গুঁতিয়ে দেব কিন্তু! বলে মাথা নিচু করে চোখ কপালে তুলল।

একটু পরে অফিস থেকে ফিরে বাবা খানিক ক্ষণ খেলা করলেন ছানাটার সঙ্গে। আনন্দিতামাসি ওর জন্য ক্লিনিকের কার্ড, নানা ইনজেকশনের তারিখ লেখা, দিয়ে গেছে। তৈরি খাবারের প্যাকেট, জলের বাটি, তোয়ালে এই সব ছোটখাটো জিনিসও দিয়ে গেছে, যাতে হঠাৎ করে অসুবিধেয় না পড়ে কুট্টুসরা। বাবা বললেন, ওর নাম রাখো, ‘চিরকুট’, ব্যস অমনি সবাই লুফে নিল নামটা।

মুশকিল বাধল ঘুমোবার সময়। খাইয়েদাইয়ে বেতের ঝুড়িতে তোয়ালে পেতে তাতে চিরকুটকে শুইয়ে ঘরের আলো নেভানো হয়েছে। মায়ের পাশে কুট্টুস, কুট্টুসের এ ধারে বাবা। এমন সময় নীচে থেকে ফোঁস ফোঁস, ঘঁৎ ঘঁৎ, কান্না আর ঘৌ ঘৌ মেশানো আওয়াজ। তোয়ালের উপর দাঁড়িয়ে অন্ধকারে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে চিরকুট।

দাঁড়িয়ে আছে তো থাক, এক সময় ঘুমোবে নিশ্চয়ই, মনে করে ওরা ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগল। ঘণ্টাখানেক পরে যখন চোখ মেলে মা দেখলেন, ছানাটা তেমনি দাঁড়িয়ে আছে, তখন বললেন, নাঃ, এ ভাবে চলবে না। ভাইবোন বাবা মাকে ছেড়ে এসেছে, এ বাড়িতে প্রথম রাত। বেচারা হয়তো অচেনা পরিবেশে ঘুমোতেই পারছে না। কুট্টুস, তুমি যাও, বাপির সঙ্গে ওঘরের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ো।

আর তুমি?

আমি ওকে পাশে নিয়ে ঘুমোচ্ছি।

আমিও থাকি, মা। কুট্টুস বলল। কাঁচা ঘুম ভেঙে ও যেন কিছু বুঝতে পারছে না।

না, না, চিরকুট তো একেবারেই ছোট্ট। তোমার হাত-পা ওর গায়ের উপর গিয়ে যদি পড়ে!

সকালে উঠে স্কুলের জন্য তৈরি হতে গিয়ে কুট্টুস দেখল, মা কখন উঠে পড়েছে, বিছানা ফাঁকা। না, পুরো ফাঁকা নয়। পাতলা চাদর গায়ে দিয়ে পাশ ফিরে আরামে ঘুমোচ্ছে চিরকুট। পাখাটা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে ওর জন্য। ভীষণ দুঃখ হল কুট্টুসের।

ব্রেকফাস্টের টেবিলে বাবা আর কুট্টুস। মা কোথায়? হাতে গড়া নরম আটার রুটি দইয়ে মিশিয়ে একটু একটু করে খাওয়াতে হচ্ছে চিরকুটকে। তাই রান্নাঘরে মোড়ায় বসে আছে মা, কোলে চিরকুট।

— সব কুকুর তো নিজেই খায় দেখেছি। বিড়বিড় করে বলল কুট্টুস।

— বাঃ রে দাদা, তোমাকে তো মা খাইয়ে দিয়েছে দু’আড়াই বছর অবধি! আর এ তো তিন মাসের বাচ্চা! গীতাপিসি হাসতে হাসতে বলল। এসো তোমার স্কুলের পোশাক, মোজা, টাই সব গুছিয়ে রেখেছি, দেখিয়ে দিই।

চিরকুটের উপর রাগ হচ্ছে কুট্টুসের। মার ওপর ভীষণ অভিমান। মা যেন কুট্টুসকে ভুলেই গেল রাতারাতি। ব্রেকফাস্টের সময় পাশে বসল না, দেখেও গেল না কুট্টুস কী খেল। বাবা অবশ্য ছিল, কিন্তু বাবা তো টিভি মিউট করে নিউজের হেডলাইন দেখছিল মন দিয়ে।

স্কুলেও উত্তেজিত ছিল কুট্টুস। বন্ধুদের বলেছে, বাড়িতে নতুন পোষ্য আসার খবর। চিরকুটের কেমন নরম গা, বড় বড় কান, জ্বলজ্বলে কালো চোখ! কিন্তু বলার সময়েও ওর মনের মধ্যে কোথাও একটা কাঁটা খচখচ করছিল। স্কুল বাস থেকে নেমে তাড়াতাড়ি ফুটপাথে উঠে পড়ল কুট্টুস। বাড়ি গিয়ে দেখতে হবে চিরকুটের নানা কাণ্ড। কিন্তু আজ তো গীতাপিসি আসেনি! ও মা, মা এসেছে কুট্টুসকে নিতে।

— তুমি অফিস যাওনি আজ?

মা বলল, অফিস যাব কী! এক কাণ্ড করেছে চিরকুট! বারান্দায় ফুলের টবের মাটি গিলে খেয়ে কী বমি! শেষে ওর ক্লিনিকের ঠিকানা দেখে নিয়ে গেলাম ডাক্তারের কাছে। এই করতে দেরি হয়ে গেল— সাড়ে বারোটা বাজল। তাই ছুটির জন্য অ্যাপ্লাই করে দিলাম।

— কিন্তু গত মাসে আমার যখন জ্বর এসেছিল, তুমি অফিস চলে গেলে, বললে জরুরি মিটিং? তার বেলা?

— ও কী, তোমার হিংসে হচ্ছে নাকি কুট্টুস! চিরকুট কত ছোট্ট বলো তো?

ডিনারের আগেই এসে হাজির আনন্দিতামাসি।
মা বলল, কী রে, তোদের বাড়ির ছানাকে ঠিকঠাক রেখেছি কি না দেখতে এলি বুঝি?

অঙ্কের হোমটাস্ক খুলে বই নিয়ে বসেছিল কুট্টুস। বাবা শক্ত শক্ত অঙ্কগুলো দেখিয়ে দিয়েছে। এ দিকে কান খাড়া করে আছে, মা আর আনন্দিতামাসির কথা শুনবে বলে।

আনন্দিতামাসি বলল, তোদের ল্যান্ডলাইন থেকে কুট্টুসের ফোন। এসে এখুনি চিরকুটকে ফেরত নিয়ে যাও। মা আমাকে আর ভালবাসছে না, কাছে ঘুমোতে দিচ্ছে না, চিরকুটকে পেয়ে ভুলে যাচ্ছে আমাকে...

মা অবাক! সে কী রে আনন্দিতা? এত কাণ্ড! আমি তো ভাবতেই পারছি না—

কুট্টুস আর থাকতে পারল না। ছুট্টে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy