১৯৫২। ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন চলছে। একই সঙ্গে লোকসভা এবং বিধানসভার ভোট হচ্ছে। আমি তখন ব্যারাকপুর দেবীপ্রসাদ হাইস্কুলের ক্লাস সিক্সের ছাত্র। এক দিন দেখি ব্যারাকপুর কোর্ট চত্বরের ভিতর শামিয়ানা টাঙানো হচ্ছে। ভাবলাম, নিশ্চয়ই কারও বিয়ে-শাদির ব্যবস্থা হচ্ছে। দু’দিন পর সকাল থেকে সেখানে হইহই ব্যাপার। জিজ্ঞেস করে জানলাম, ওখানে ‘ভোট গণনা’ চলছে। ভিতরে গিয়ে দেখার খুব ইচ্ছে হল। কোনও পুলিশ ছিল না। একটু ইতস্তত করছি। দেখি, শামিয়ানার বাইরে কুড়ি-বাইশ বছরের এক যুবক আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। প্যান্ট-শার্ট পরা, পায়ে জুতো, হাতে ঘড়ি, চোখে গগল্স। সেই সময় এই বয়সের ছেলেরা ধুতি-শার্ট পরত, পায়ে থাকত চপ্পল। বুঝলাম, ইনি কেউকেটা হবেন। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ভিতরে যাব? বললেন, এখন জ্যোতিবাবু ভিতরে আছেন, পরে যেও। ভাবলাম, জ্যোতিবাবু বোধহয় কোনও সরকারি অফিসার হবেন।
ঘণ্টাখানেক পর। জেলখানার মোড়, যেখান থেকে বারাসত আর শ্যামবাজার যাওয়ার বাস ছাড়ে, সেখানে দাঁড়িয়ে আছি। দেখি, ব্যারাকপুর কোর্ট থেকে পাঁচ জন লোকের একটা দল বেরিয়ে স্লোগান দিতে দিতে জেলখানার দেয়ালের পাশ দিয়ে এগিয়ে আসছে। দলের সামনে এক জন ছোট্টখাট্টো মানুষ। গায়ে ঢোলা পাজামা, খদ্দরের পাঞ্জাবি। কাঁধে একটি ঝোলাব্যাগ, পায়ে চপ্পল। পিছনের চার জন ‘জ্যোতি বসু জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ’ বলছে।
আশেপাশে যত লোকজন ছিল, মোড়ের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। জ্যোতি বসু কাছে আসতেই সবাই তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে লাগল। আমি এত ভিড় দেখে পাশেই একটা বাড়ির খোলা বারান্দায় ওঠার চেষ্টা করতে লাগলাম। বারান্দাটা বেশ উঁচু। আমার বুক পর্যন্ত। বারান্দায় ওঠার সিঁড়িও দেখতে পেলাম না। একটা বড় পাথর পড়ে আছে, কিন্তু সেটা নড়বড়ে। আমি ওটায় পা রেখে লাফিয়ে বারান্দায় উঠে পড়লাম। এমন সময় লোকজন বলতে লাগল— জ্যোতিবাবু কিছু বলুন। জ্যোতিবাবু বলতে আরম্ভ করার সঙ্গে সঙ্গে পিছনের লোকজন হইহই করে উঠল, জ্যোতিবাবুকে দেখা যাচ্ছে না। তখন সবার বারান্দাটার দিকে নজর পড়ল।
—এই খোকা, জ্যোতিবাবুর হাত ধরে বারান্দায় তুলতে পারবে?
—পারব।
জ্যোতি বসু পিছন ফিরে বারান্দার উচ্চতা এবং আমাকে দেখে ব্যবস্থাটা পছন্দ করলেন না। কিন্তু তত ক্ষণে সবাই মিলে চিৎকার করে বলতে লাগল, এই খোকা, জ্যোতিবাবুর হাতটা ধর না। হাতটা বাড়িয়ে ধর। আমি হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। লোকজন বলতে লাগল, জ্যোতিবাবু উঠে পড়ুন, উঠে পড়ুন। উনি আমার দিকে তাকিয়ে দেখলেন। বললেন, পারবে তো?
‘হ্যাঁ হ্যাঁ পারব। আপনার হাতটা দিন না।’ সন্দিগ্ধ মনে আমার হাতটা ধরলেন। তার পর বড় পাথরটায় একটা পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে এক টানে ওঁকে বারান্দায় তুলে ফেললাম। জনতা ‘শাবাশ, শাবাশ’ বলে চিৎকার করে উঠল। জ্যোতি বসু গম্ভীর মুখে আমার আগাপাশতলা ভাল করে দেখে জনতার দিকে ফিরে বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করলেন, আমিও তাঁর পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম দশ-বারো মিনিট।
বক্তৃতা শেষ। বারান্দা থেকে নামার পালা। আমি তো লাফিয়েই নামব, কিন্তু ওঁর পক্ষে তা সম্ভব নয়। জনতার মধ্যে থেকে দু-এক জন পরামর্শ দিলেন— জ্যোতিবাবু লাফ দেন। নীচের দিকে তাকিয়ে তিনি থমকালেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার হাতটা ভাল করে ধরে রেখো, না বলা পর্যন্ত ছেড়ো না।
তা-ই করলাম। উনি একটা পা নড়বড়ে পাথরে রেখে নীচে নেমে গেলেন। কাছেই একটা জিপ দাঁড়িয়ে ছিল, সেটাতে করে চলে গেলেন। শুনেছিলাম, সেই বার জ্যোতি বসু বেলঘরিয়া কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন।