Advertisement
E-Paper

জা স্ট যা চ্ছি

শুভময় মিত্ররাঁচি এয়ারপোর্টের বাইরে কার পার্কের কাছেই একটা জ্যাকারান্ডা গাছ আছে। প্রত্যেক বার ওখানেই দাঁড়াই। ওখান থেকেই আমাকে তুলে নেয়, গাড়ি পাঠায় আমার ক্লায়েন্ট। পাত্রাতু’র থার্মাল পাওয়ার স্টেশনে যাই, কাজ থাকে। প্রায় ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে আছি, গাড়ি আসেনি। অনেক বার ফোন করলাম, ধরছে না।

শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৪ ০০:০০
ছবি: লেখক।

ছবি: লেখক।

রাঁচি এয়ারপোর্টের বাইরে কার পার্কের কাছেই একটা জ্যাকারান্ডা গাছ আছে। প্রত্যেক বার ওখানেই দাঁড়াই। ওখান থেকেই আমাকে তুলে নেয়, গাড়ি পাঠায় আমার ক্লায়েন্ট। পাত্রাতু’র থার্মাল পাওয়ার স্টেশনে যাই, কাজ থাকে। প্রায় ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে আছি, গাড়ি আসেনি। অনেক বার ফোন করলাম, ধরছে না। কী করব বুঝতে পারছি না। হঠাত্‌ দেখি একটু দূরে একটা লোক একই জায়গায় গোল হয়ে ঘুরছে আর উত্তেজিত হয়ে হাত নেড়ে মোবাইলে কথা বলে যাচ্ছে, হিন্দিতে। একটু কাছে গেলাম, যেতেই খুব চেনা লাগল, এ তো আমাদের কলেজের শঙ্কুদা। যে এক সময় গুপ্তচর হয়ে গিয়েছিল বলে শুনেছিলাম। যদিও তার সঙ্গে আমাদের কারুর কোনও যোগাযোগ নেই এত দিন, কান থেকে ফোন না নামিয়ে, আমার দিকে তাকিয়ে শঙ্কুদা অভয় দেওয়ার মতো, হাতের মুদ্রা দেখিয়ে বুঝিয়ে দিল, ‘দাঁড়া একটু, কথাটা সেরে নিই।’ অর্থাত্‌ চিনতে পেরেছে। নিশ্চিন্ত হলাম একটু। ওর জামাকাপড়ের চেহারা দেখে অবশ্য ওর জন্যে গাড়ি আসবে এটা মনে হল না। যাই হোক, চেনা লোক বেরিয়েছে সেটাই বড় কথা।

শঙ্কুদা এ বারে ব্যস্ত হয়ে হাঁটতে লাগল, আমাকেও ইশারা করল আসার জন্য। তার পর একটা মোটরবাইকে চেপে বসে স্টার্ট দিল। ফোনে কথাবার্তা কিন্তু চলছে, ফলে আমি কিছু বলার সুযোগ পাচ্ছি না। পিছনের সিটে বসলাম আমার ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে, ফরফর করে বাইক চলতে শুরু করল। এর মধ্যেই এক বার মুখ থেকে ফোন সরিয়ে শঙ্কুদা বলল, ‘বলল রাঁচি আসছে আজকের ফ্লাইটে, তাই এলাম কথা বলতে, এখন বলছে দিল্লি চলে গেছে’, বলেই আবার ফোনে চলে গেল। হেলমেটহীন অবস্থায় এই ভাবে ঘন ট্র্যাফিকের মধ্যে দিয়ে বাইক চালানো খুবই রিস্কি। কিন্তু সেটা বলা যাবে না। যেখান থেকে গাড়ি পেতে পারি তেমন কোথাও নামিয়ে দিলেই হয়, শঙ্কুদা তো আর পাত্রাতু যাচ্ছে না, এক ঘণ্টার ওপর রাস্তা, এতটা লিফ্টও চাওয়া যায় না। মুশকিল একটাই, ওর সঙ্গে কোনও কথা বলার উপায় নেই। এক হাতে ফোন, এক হাতে বাইক। মুখ, কান, হাত ব্যস্ত। রাঁচি শহরের ভিতরে না ঢুকে সোজা উত্তরমুখো যাচ্ছি আমরা। এক বার মরিয়া হয়ে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললাম, ‘পাত্রাতু যাব, যা হোক কোনও একটা কমফর্টেব্ল জায়গায় নামিয়ে দাও’ মাথা নাড়া দেখে সেটা আমার কথা শুনতে পাওয়ার সম্মতি না ফোনের কথোপকথনের রেশ সেটা বুঝতে পারলাম না। বাইক চলছে, শহর হালকা হয়ে আসছে, সাদা দানা দেওয়া, দু’পাশে ফ্লুরোসেন্ট রিফ্লেক্টর লাগানো ঝকঝকে হাইওয়েতে পড়ে গেছি। চেনা রাস্তা। এটাই তো পাত্রাতু’র দিকে গেছে, রাঁচি-পাত্রাতু-রামগড় রোড। পাকা বাড়ি কমে আসছে, কেব্‌ল-এর তার দেখা যাচ্ছে না, পরিষ্কার আকাশ, লালচে জমি, সবুজ গাছপালায় ঝলমলে বিকেলের রোদ, কানের পাশ দিয়ে ফুরফুর করে হাওয়া চলছে। শঙ্কুদা এত ক্ষণ ধরে যে কথা বলছিল সেটা একেবারেই বুঝতে পারছিলাম না, কারণ তাতে লোকাল প্রভাব প্রচুর। শুধু একটা শব্দই বারে বারে ছিটকে আসছিল পিছনে কইলা।

বাইক চলছে, ইঞ্জিনের একটু অনিচ্ছুক ভাবটা টের পাচ্ছি, কারণ রাস্তা পাহাড়ে উঠছে। শঙ্কুদা এখন কথা বলছে না। কিন্তু ওকেও কিছু বলতে পারছি না কারণ ফোনের উলটো পারের লোক এখন বকে চলেছে। পাত্রাতু’র দিকেই যখন যাচ্ছে যাক না, আমারই সুবিধে। কিন্তু শঙ্কুদা এখানে কী করছে সেটাই জিজ্ঞেস করার সুযোগ খুঁজছিলাম, পাচ্ছিলাম না। এক বার হাত আর কান বদলানোর সময় একটা স্বগতোক্তির মতো শুনলাম, ‘এ সব ডেঞ্জারাস জায়গা, মাইনিং যে কী সাংঘাতিক ব্যাপার তোরা বুঝবি না, কলকাতায় পার্টি পলিটিক্স করবি রকে বসে আর এখানে আসবি মাল কামাতে। ঠিকই আছে, মাল তো ছড়িয়েই আছে, নিতেই হবে, না হলে চলবে কেন?’

আগেও দেখেছি, এ বারেও চোখে পড়ল রাস্তার ধারে মাঝে মাঝে মানুষের জটলা। সবার সাইকেল রয়েছে সঙ্গে। সাইকেলের দু’পাশে, ওপরে বিশাল বস্তা-ভর্তি কয়লা দড়ি দিয়ে বাঁধা। সরকারি নিষেধাজ্ঞা, পরিবেশ দফতরের চোখ রাঙানিকে কলা দেখিয়ে দু’নম্বরি খোলা খনি থেকে কয়লা তোলে অনেক লোক। তার পর পাহাড় টপকে অন্য শহরে গিয়ে বেচে দেয়। দিয়েও ভয়ংকর গরিব থেকে যায়। মানুষগুলোর চেহারা কুচ্ছিত, মরা চোখের পাতায় ছাইরঙা মৃত্যু প্রলেপ। ভেতরে আগুন জ্বলছে হয়তো, জানি না। প্রচণ্ড ভারী হয়ে ওঠা সাইকেল চালিয়ে বা ঠেলে পাহাড়ে ওঠা যায় না। তাই অভিনব ব্যবস্থা করে ফেলেছে ওরা। মোটরবাইকের পিছনে দড়ি বেঁধে মালসহ অনেকগুলো সাইকেলকে একসঙ্গে টেনে তুলে দেওয়া হয় ওপরে। সেখান থেকে আর একটা বাইক চেন সিস্টেম। কত টাকা দিতে হয় জানতে চাইলাম শঙ্কুদার কাছে। উত্তর দিল না, কারণ এখন সে কথা শুরু করে দিয়েছে। গলায় প্রচ্ছন্ন রাগের আভাস, বাইকের ইঞ্জিনটাও বিদ্রোহ করছে চড়াইতে। কয়লা-ভরা সাইকেলের মালগাড়ি, ঘাট রোড্স দিয়ে পাহাড়ের মাথায় তুলে ওদের দায়িত্ব শেষ, নেমে যায় সমতলে, গড়িয়ে গড়িয়ে। আমরাও পাহাড়ের ওপরে পৌঁছে গেছি। শঙ্কুদা বাইক থামাল, নামল। আমিও নামলাম, কী আর করব?

বহু দূরে পাত্রাতু’র থার্মাল পাওয়ার স্টেশনের চিমনিগুলো দেখা যাচ্ছে। একটু অস্পষ্ট। দেখতে পাচ্ছি বিশাল লেক, ড্যাম আছে ওখানে। লাল-সবুজ পাহাড় কাটা হাইওয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে সেই দিকে, মাঝে মধ্যে অনেক নীচে খেলনা গাড়ি বা ট্রাক চলেছে, আর কোনও শব্দ নেই। সন্ধে হবে একটু পরে, রোদ নরম হয়ে এসেছে, শেষ বারের মতো চেটেপুটে দিয়ে যাচ্ছে কালো সোনায় ভরা উপত্যকাকে। সাদা-কালো রং করা পাহাড়ের ওপর এক পা রেখে শঙ্কুদা বলে চলেছে, ‘হাঁ হাঁ, রাঁচি, রাঁচি।’ তার পর হঠাত্‌ কান থেকে ফোন সরিয়ে হতাশ ভাবে আমাকে বলল, ‘এই রে, চার্জ শেষ।’ কী বলব বুঝতে পারলাম না, আমার ফোনটা ব্যবহার করতেই পারে। কিন্তু সেটা বলার আগেই শঙ্কুদা এক মুহূর্ত কী যেন ভাবল। তার পর বলল, ‘তুই এগিয়ে যা, আমাকে রাঁচি ফিরতে হবে এক্ষুনি, আমার দুটো লোককে মেরে দিয়েছে।’ এখান থেকে যাব কী করে সেটাও জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলাম না। তত ক্ষণে শঙ্কুদা মোটরবাইকে উঠে স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে। আমার মনের কথাটা বুঝে নিয়ে বলল, ‘আরে বাবা ঝামেলার জায়গাটা তো পার করে দিয়েছি, তুলে দিলাম তো এই পর্যন্ত। এ বার যা, নেমে যা সোজা, এটা তোদের শখের এভারেস্ট তো নয়, কি?’ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম পাহাড়-প্যঁাচানো হাইওয়ের ধারে। লরি বা বাস চলে নিশ্চয়ই, ধরতে হবে। শঙ্কুদা আবার বলল, ‘ভদ্দরলোকের ভেক ধরে তুইও মাল তুলতে এসেছিস। আমিও তাই। কি? একটু ঝামেলা নিবি না? আমিও নেমে যাচ্ছি। তুইও নেমে যা।’

suvolama@gmail.com

suvomoy mitra
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy