Advertisement
E-Paper

জল খেয়ে বেঞ্চে শুয়ে পড়

আমাদের স্কুলে জীবনবিজ্ঞান পড়াতেন এস সি চৌধুরী। তাঁর ভয়ে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে শুধু জলই খেত না, জল খাওয়ার পর কোলাকুলিও করে যেত। সপ্তাহে তিন দিন টিফিনের পর, ফিফ্থ পিরিয়ডে এস সি চৌধুরী ক্লাস নিতে আসতেন, আর সঙ্গে বাহনের মতো বহন করে আনতেন একটা হৃষ্টপুষ্ট বেত।

সঞ্জয় কর্মকার

শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ২৩:৪৯

আমাদের স্কুলে জীবনবিজ্ঞান পড়াতেন এস সি চৌধুরী। তাঁর ভয়ে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে শুধু জলই খেত না, জল খাওয়ার পর কোলাকুলিও করে যেত। সপ্তাহে তিন দিন টিফিনের পর, ফিফ্থ পিরিয়ডে এস সি চৌধুরী ক্লাস নিতে আসতেন, আর সঙ্গে বাহনের মতো বহন করে আনতেন একটা হৃষ্টপুষ্ট বেত। দরজার কোণে দাঁড়িয়ে দূর থেকে স্যরকে ক্ষিপ্র গতিতে ক্লাসরুমের দিকে আসতে দেখেই সবার বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত, আর স্যরও ক্লাসে ঢুকেই জহুরির চোখ নিয়ে বুঝতে পারতেন, ঠিক কে কে পড়া পারবে না। তার পর সেই মতো তাদের কড়া ডোজের বেত্রাষুধ দিতেন। সুতরাং, যারা সেই পড়া না-পারার দলে থাকত, তাদের এক-আধ জন প্রায়শই মুখটা কাঁচুমাচু করে বলত, ‘স্যর পেটে খুব ব্যথা করছে।’ পেটব্যথার মতো সিরিয়াস অসুখের কথা শুনে এস সি চৌধুরী কখনওই উদাসীন থাকতেন না। ছাত্রকে কাছে ডেকে বেশ খানিকটা মোলায়েম সুরে তিনি জিজ্ঞাসা করতেন, ‘ব্যথাটা পেটের ডান দিকে, না বাঁ দিকে বেশি হচ্ছে রে?’

ছাত্র ডান দিক, বাঁ দিক— যা-ই দেখাক, স্যর আঙুল টিপে টিপে পরখ করে দেখতেন সেই ব্যথার তীব্রতা কতখানি। শেষে মুখটা গম্ভীর করে বলতেন ‘জল খেয়ে পিছনের বেঞ্চে শুয়ে পড়।’ এ রকম রোজই কেউ না কেউ বলত— ‘মাথা ঘুরছে স্যর’, কেউ বলত ‘স্যর, বাড়ি থেকে খেয়ে আসিনি, তাই গা গুলোচ্ছে’, আবার কেউ হয়তো সদ্য দাদু-ঠাকুমার মৃত্যুসংবাদ শুনিয়ে স্যরের বেত্রাঘাত থেকে বাঁচার মরিয়া চেষ্টা করত। আর, এস সি চৌধুরীও প্রতিটা সমস্যার সত্যাসত্য যাচাই করে শেষে গম্ভীর মুখে একটাই রায় দিতেন— ‘জল খেয়ে পিছনের বেঞ্চে শুয়ে পড়।’

এক দিন ক্লাসের সবচেয়ে ফচকে ছেলেরা টেবিলের ওপর হাত রেখে ‘রস-কষ-শিঙাড়া-বুলবুলি’ খেলছিল। কিন্তু খেলতে খেলতেই টেবিলের কোণে চোরাগোপ্তা দাঁড়িয়ে থাকা একটা জং ধরা পেরেকে আমাদের বন্ধু প্রকাশের ডান হাতের কড়ে আঙুল বিশ্রী ভাবে কেটে গেল। ফোঁটায় ফোঁটায় পড়তে থাকল রক্ত। আতঙ্ক আর ভয়ে প্রকাশ তখন হঠাৎই দৌড় দিল টিচার্স রুমের দিকে। কারণ, টিচার্স রুমের একটা আলমারিতেই ফার্স্ট এড-এর ওষুধপত্র থাকত। মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে আমরাও দু-একজন ছুটলাম প্রকাশের পিছু পিছু। কিন্তু কথায় বলে, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধে হয়। সুতরাং, হতভাগ্য প্রকাশও টিচার্স রুমে গিয়ে স্বয়ং এস সি চৌধুরীরই মুখে পড়ল। ক্লাস অফ থাকায় স্যর তখন বেশ আয়েশ করে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। কিন্তু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রকাশকে ইতস্তত করতে দেখে (আমরাও সব দেখছি, তবে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে) স্যর বেশ বিরক্তির ভঙ্গিতে বললেন, ‘কী ব্যাপার, এখানে তোর কী চাই?’ প্রকাশ প্রশ্ন শুনে কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, ‘স্যর হাত কেটে গেছে আমার।’

রক্তের কথাও স্যরের বিরক্তি এতটুকুও কমাতে পারল না। কাগজ পড়তে পড়তে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘বললাম তো, জল খেয়ে পিছনের বেঞ্চে শুয়ে পড়।’

প্রকাশ কেঁদে ফেলল। ‘স্যর! হাত কেটে গেছে! রক্ত পড়ছে!’

‘অ্যাঁ, হাত কেটে রক্ত পড়ছে! তা আগে বলিসনি কেন হতচ্ছাড়া? এক্ষুনি জল খা। আর পিছনের বেঞ্চিতে নয়, আপাতত আমাদের বসার ওই সামনের বেঞ্চটাতে শুয়ে পড়।’ কথাগুলো শেষ করেই ঠিক আগের মতো উদাস ভাবেই খবরের কাগজে মুখ ডুবিয়ে দিলেন এস সি চৌধুরী।

স্কুলের শিক্ষক/ শিক্ষিকা কি নিষ্ঠুর বা উদ্ভট ছিলেন? বিবরণ লিখে পাঠান ৪০০ শব্দে এই ঠিকানায়:
গাঁট্টা, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy