Advertisement
E-Paper

থমথমে বরণ, কেঁদে আশীর্বাদ

সম্বন্ধ করে বিয়ের দিন ঠিক হল। বয়স তখন মাত্র একুশ। সবে অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েট হয়েছি। আমাকে পছন্দ করে শ্বশুরমশাই বাবাকে বলেছিলেন, ‘আপনার মেয়েটিকে আমাদের এত পছন্দ হয়েছে যে, ওকে মামণি বলে ডাকতে ইচ্ছে করছে।’ সেই থেকে শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে আমি ‘মামণি’।

মায়া ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:৪৫

সম্বন্ধ করে বিয়ের দিন ঠিক হল। বয়স তখন মাত্র একুশ। সবে অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েট হয়েছি। আমাকে পছন্দ করে শ্বশুরমশাই বাবাকে বলেছিলেন, ‘আপনার মেয়েটিকে আমাদের এত পছন্দ হয়েছে যে, ওকে মামণি বলে ডাকতে ইচ্ছে করছে।’ সেই থেকে শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে আমি ‘মামণি’। খাস কলকাতার ভবানীপুরের হরিশ মুখার্জি রোড থেকে চলে যেতে হল ধানবাদের প্রত্যন্ত এক কোলিয়ারিতে। নাম, ‘আঙারপাথরা’। আমার শ্বশুরমশাই সেখানকার ডাক্তার। স্বামী স্বাস্থ্যবান, সুপুরুষ, শিক্ষিত, উচ্চপদস্থ অফিসার।

বিয়ের পর কলকাতা থেকে ট্রেনে ধানবাদ যাওয়ার সময় বার বার লুকিয়ে লুকিয়ে স্বামীকে দেখছি আর বুক ভরে উঠছে গর্বে আর সুখে। তারই মধ্যে আবার কলকাতা ছাড়ার দুঃখে, ভাইবোন, নিজের ঘরবাড়ি, চেনা পরিবেশ ছাড়ার দুঃখে মাঝেমধ্যেই দু’চোখ ভেসে যাচ্ছে। হঠাৎ আমার স্বামী ওই ট্রেনের মধ্যেই আমার কানের কাছে মুখ এনে চুপিচুপি বলল, ‘কেঁদো না, আমার মা খুব ভাল।’ আর ওই একটা কথা আমার বুকে শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দিল। মনে হল, যে সংসারে মা ভাল, তার সবই ভাল। আমি তো আর ‘আমিটি-তুমিটি’র সংসার চাই না। আমি তত ক্ষণে জেনে গিয়েছি, আমার স্বামী ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। আমি বড় বউ হয়ে সেখানে যাচ্ছি। সংসারে ওর দাদু-ঠাকুমা রয়েছেন। আমি সবাইকে নিয়ে খুব ভালবাসার সংসার চাই।

ধানবাদ স্টেশনে নেমে শ্বশুরবাড়ির বেশ কয়েক জনের সঙ্গে ট্যাক্সিতে ওঠা হল। বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থামামাত্র আমার বুক দুরদুর করছিল প্রচণ্ড। একদম নতুন পরিবেশ। সব নতুন নতুন মুখ। আমাকে ট্যাক্সি থেকে নামতে বারণ করা হল। শাশুড়ি আশীর্বাদ করবেন। হঠাৎ ট্যাক্সির দরজা খুলে বরণের ডালা নিয়ে শাশুড়ি মুখ ঢোকালেন, আর তাঁকে দেখে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। তাঁর মুখ-চোখ থমথম করছে। এক হাতে বরণের ডালা, অন্য হাতের তর্জনী আমার মুখের সামনে তুলে ভীষণ রকম কঠিন সুরে আমাকে বললেন, ‘আমি একটা বাচ্চার জন্য আমার ছেলের বিয়ে দিয়েছি। এই কথাটা মনে রেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা বাচ্চা তুমি এই সংসারে আনবে।’ এর পর অবশ্য যথারীতি আশীর্বাদ করে আমায় ট্যাক্সি থেকে নামানো হল।

ঘরে ঢুকে দেখলাম, দুটো আসন পাতা। আমাদের বসতে বলা হল। বাকি গুরুজনেরা আশীর্বাদ করবেন। সবার আগে আমার শ্বশুরমশাই। ধান-দুব্বো দিয়ে আশীর্বাদ করতে গিয়ে হঠাৎ তিনি হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, ‘আমার যদি ক্ষমতা থাকত, তবে আমি আমার ছেলের দুটো বিয়ে দিতাম।’

পর পর দুটো ঘটনায় আমি মানসিক ভাবে খানিকটা বিপর্যস্ত হয়ে গেলাম। আমার স্বামী দুটো ঘটনারই কোনও প্রতিবাদ করল না। পরে শুনেছিলাম, আমার বিয়ের বছরখানেক আগে আমার সবচেয়ে ছোট দেওর জলে ডুবে মারা যায়। এবং আমার শাশুড়ি ছেলের বিয়ে দেন সেই হারানো ছেলেকে ফিরে পাওয়ার জন্য। আর আমার শ্বশুর মনে মনে একটি মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে ঠিক করেছিলেন, যাকে আমার স্বামী পছন্দ করেনি। সেই যন্ত্রণারই বহিঃপ্রকাশ আশীর্বাদের সময় ওই চোখের জল। শ্বশুর-শাশুড়ির ‘মামণি’ ডাকের মধুটুকু প্রথম দিনই হারিয়ে গেল জীবন থেকে।

আপনার শ্বশুরবাড়ি ভাল? খারাপ? ভাল-খারাপ মিশিয়ে? শ্বশুরবাড়ির টকঝালমিষ্টি ঘটনা লিখে পাঠান ৪০০ শব্দে।
ঠিকানা: শ্বশুরবাড়ি, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy