স ময়টা গত শতাব্দীর শেষ দশক। ভারত সরকারের একটি অফিসে কাজে যোগ দিলাম। প্রথম দিন কোম্পানির মেজ সাহেব তাঁর পূর্ববঙ্গীয় উচ্চারণে বললেন: ‘বেবাকটারে এক রকম পহা (পয়সা) দিতে হইব। কারে ভাল পাইলেন, দুই টাকা বেশি দিলেন, কারে বা খারাপ পাইলেন, দুই টাকা কম দিলেন, হেই চলব না। বেবাকটারে একই রকম, কারণ এই হইল গিয়া প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়ার মানি।’
ওই সাহেব খুবই ভুলভাল ইংরেজি বলতেন। এক বার দিন পাঁচেকের ছুটি নিয়ে আমি তিন দিনের মাথায় অফিসে ফিরে আসি। দেখা হতে উনি বললেন: ‘ইউ কেম বিফোর ইউ কেম।’ আর এক দিন ওঁর জন্মদিনে ওঁকে শুভেচ্ছা জানাতেই বললেন ‘সেম টু ইউ!’
চাকরিতে ঢুকে সরকারি পয়সার অপব্যয় ঠেকাতে সচেষ্ট হলাম। করণিক বা শ্রমিকেরা যখনই যাতায়াত ভাড়ার হিসেব দেন, তখনই ‘ই-বাস’এর ভাড়া দাবি করেন। এক দিন এক জনকে ডেকে বললাম, আমি তো ই-বাস দেখতেই পাই না, আপনি অফিস থেকে বেরোলেই ই-বাস পান? তিনি অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, ‘আপনি কাল কা যোগী! আমরা এখানে ত্রিশ বছর রক্ত দিয়েছি।’ আমি বিল ছাড়লাম না। সেই খবর গোটা অফিসে রটে গেল। এক সহকর্মী এসে বললেন, ‘করেছেন কী মশাই? দু’টাকার বিল আটকেছেন? ওরা যদি ‘টুল ডাউন’ ধর্মঘট করে বসে, তখন সবাই তো আপনাকেই দুষবে!’ এটা আগে ভাবিনি, একটু ভয়ই পেয়ে গেলাম। হঠাৎ দেখি, সেই শ্রমিকটির বিনীত আবির্ভাব। দেখে মনে হল, তিনিও ভয় পেয়েছেন। জানালেন, বিল ফিরিয়ে নিতে চাইছেন। আমিও বিল ফিরিয়ে দিলাম। পরে জানতে পারলাম, অন্য শ্রমিকরা তাঁকে বুঝিয়েছে, দু’টাকার জন্য বেশি ঝগড়াঝাঁটি করলে, পরে সকলেরই ওই টাকা পাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। তার চেয়ে এ বারের মতো বৃহত্তর স্বার্থে তিনি বরং দু’টাকার মায়া ত্যাগ করুন। তারও পরে, ভ্রমণ-ভাতা বাড়ানোয়, ই-বাসের চক্করও থামল।
আমার দফতরের এক পুরুষ করণিক প্রায়ই দুপুরবেলা তিনটে নাগাদ এটা-ওটা কারণ দেখিয়ে ছুটি নিয়ে বাড়ি যেতে চান। আমিও তাঁকে ছুটি দিই। এক দিন আর এক মহিলা করণিক এসে আমাকে বললেন, ‘ওঁকে রোজ রোজ দুপুরে ছাড়বেন না।’ আমি বললাম, ওঁর স্ত্রী অসুস্থ, ছেলে ছোট... ভদ্রমহিলা আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘সব বাজে কথা। উনি অফিস থেকে বেরিয়ে রোজ আমার বাড়িতে গিয়ে বসে থাকেন। আমি ছুটির পর বাড়ি ফিরে দেখি, উনি বসে আছেন।’ আমি শুধু বললাম: উনি আপনার বাড়ির চাবি পেলেন কী করে?
অন্য এক মহিলা করণিক এক দিন কামাই করেছেন। আমি ছুটি মঞ্জুর করেছি। যেহেতু ওই মহিলা একটি দলের হয়ে ইউনিয়ন করেন আর আমার সেজ সাহেব তার বিপক্ষ দলের অনুরক্ত, সেজ সাহেব তাই আমাকে ধমক দিলেন ওই মহিলার ছুটি মঞ্জুর করার জন্য। আমি যুক্তি দিলাম, সরকারি আইন অনুসারে ক্যাজুয়াল লিভ সর্বদা প্রাপ্য। উনি খুব খেপে গিয়ে অন্য কয়েক জন অফিসারের সামনে ওই মহিলাকে ডেকে পাঠালেন। ভদ্রমহিলা ঢুকতেই প্রথম প্রশ্ন: ‘কাল আসেননি কেন?’ উত্তর এল: ‘অসুস্থ ছিলাম।’ ফের প্রশ্ন: ‘কী অসুখ?’ মহিলা অম্লানবদনে বললেন: ‘ফিমেল ডিজিজ।’ সেজ সাহেব থতমত, অন্য অফিসাররা মুখ নিচু করে হাসছেন। তার পর থেকে সেজ সাহেবের নামই হয়ে গেল ‘ফিমেল ডিজিজ’।
আস্তে আস্তে আবিষ্কার হল, অফিসে কিছু পরকীয়া প্রেম চলছে— কখনও সহকর্মীদের মধ্যেই, কখনও বা বাইরের কারও সঙ্গে। কিছু অফিসারও ওই দলে আছেন। এক বার এক অফিসার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি, তাঁর পায়ের কাছে প্রেমিকা পরস্ত্রীটি গিয়ে বসেছেন। চোখ খুলে মহিলাটিকে দেখেই অফিসার উদ্বেল: ‘কত দিন দেখিনি তোমায়...’ ভদ্রমহিলা বলে ওঠেন, ‘দাদা চুপ, চুপ! মাথার কাছে যে বউদি বসে আছে!’
পরকীয়ার বড় নাটক দেখা যেত মাইনের দিন। কিছু কর্মীর দুটি বা তিনটি অবৈধ স্ত্রী দরজার বাইরে হাজির, যাতে তাঁরা পুরো মাইনে সহ স্বামীটিকে হাতেনাতে ধরতে পারেন। এই সব স্ত্রীদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি, গালাগালি, এমনকী চুলোচুলিও হত। কিন্তু স্বামীটিও কম ঘুঘু নন। তিনি অন্য কোনও সহকর্মীকে তাঁর মাইনে তুলে নেওয়ার লিখিত অনুমতি দিয়ে মাইনের দিন নিজে অনুপস্থিত। ফলে দেখা যেত, সন্ধ্যাবেলা স্বামীর দেখা না পেয়ে এবং মাইনের টাকারও কানাকড়ি না পেয়ে জনা কুড়ি স্ত্রীলোক কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরছেন। আর কী আশ্চর্য, সকালের কোঁদল ভুলে তখন তাঁরা একে অন্যকে সান্ত্বনাও দিচ্ছেন!
অফিসেরই এক জন বাংলা ছবিতে ছোটখাটো রোল-এ অভিনয় করেন। শোনা গেল, তাঁর তিনটি স্ত্রী। আমি তাঁকে ভয় দেখালাম, আপনার চাকরি চলে যেতে পারে কিন্তু! তিনি কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, ‘এ সব তো লিখিতপড়িত বিয়ে নয়, কোনও প্রমাণ নেই। তা ছাড়া, আমার আসল সংসারে যখন টাকাপয়সার টানাটানি হয়, এই অন্য দুই বউ টাকা ঢালেন। এক জন শিক্ষিকা, অন্য জন একটা অফিসে কাজ করেন।’ বুঝলাম, সিনেমার এক এক্সট্রা-র আকর্ষণে শিক্ষিতা মহিলারাও কাবু।
সিনেমায় অভিনয়ের প্রসঙ্গে আমার সেই পূর্ববঙ্গীয় মেজ সাহেবের একটা ঘটনা বলি। এক বার উনি আমাকে ওঁর ঘরে নিভৃতে প্রশ্ন করলেন, ‘গত কাল সন্ধ্যায় মুনমুন সেন কী কইল?’ আমি তো অবাক— মুনমুন সেনের সঙ্গে আমার কথাবার্তা! এ সব আবার ওঁর মাথায় কে ঢোকাল! উনি কিন্তু বলেই চলেছেন: ‘আরে কইয়া ফ্যালান কইয়া ফ্যালান, অল্প কইরা কয়েন।’ কথা আর একটু এগোতেই বুঝলাম, উনি আসলে বলছেন মনমোহন সিংহের কথা। মনমোহন সিংহ, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী, আগের দিনই বাজেট-ভাষণ দিয়েছেন, মেজ সাহেব তারই সারাংশ শুনতে চাইছেন। ওঁর উচ্চারণে ‘মনমোহন সিং’ হয়ে গেছেন ‘মুনমুন সেন’!
এ ভাবেই, রসেবশে কাটে অফিসের জীবন। আসলে তো আজকের দিনটা গতকালকের পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই নয়!
শ্রীশঙ্কর ভট্টাচার্য নিউ বালিগঞ্জ
srishankarbhattacharya@yahoo.com
যেখানেই কাজ করুন, ব্যাংক, রেস্তরাঁ, আইটি, অন্য কোথাও— আপনার অফিসের পরিবেশ পিএনপিসি
হুল্লোড় কোঁদল বস কলিগ ছাদ ক্যান্টিন— সব কিছু নিয়ে ৭০০ শব্দ লিখে পাঠান।
ঠিকানা: অফিসফিস, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১