Advertisement
E-Paper

পুপুল

পুপুল ওর দাদুকে খুব ভালবাসে। দাদুও পুপুল বলতে অজ্ঞান। পুপুল একটা দশ বছরের মেয়ে। ওই বয়সের মেয়েদের যেমন মাথাভর্তি চুল। সুন্দর দুটি চোখ থাকে। পুপুলেরও তা আছে। কিন্তু পুপুলের একটা খুঁতও আছে, সে কথা বলতে পারে না। পুপুল জন্মেছেই এই খুঁত নিয়ে। কোনও চিকিৎসায় ফল হয়নি কিছু। ডাক্তারবাবুরা বলেছেন, এ অসুখ ওষুধ খাইয়ে বা অন্য ভাবে সারবার নয়। পুপুল যেমন আছে তাকে তেমনি ভাবে মেনে নিতে হবে।

শৈবাল চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৫ ০১:২৩
ছবি: রাজেন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়

ছবি: রাজেন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়

পুপুল ওর দাদুকে খুব ভালবাসে। দাদুও পুপুল বলতে অজ্ঞান।
পুপুল একটা দশ বছরের মেয়ে। ওই বয়সের মেয়েদের যেমন মাথাভর্তি চুল। সুন্দর দুটি চোখ থাকে। পুপুলেরও তা আছে। কিন্তু পুপুলের একটা খুঁতও আছে, সে কথা বলতে পারে না।
পুপুল জন্মেছেই এই খুঁত নিয়ে। কোনও চিকিৎসায় ফল হয়নি কিছু। ডাক্তারবাবুরা বলেছেন, এ অসুখ ওষুধ খাইয়ে বা অন্য ভাবে সারবার নয়। পুপুল যেমন আছে তাকে তেমনি ভাবে মেনে নিতে হবে।
পুপুল গান শোনে মন দিয়ে। বরং তুলি দিলে ঠিক ছবি নয়, তবে মজার সব নকশা এঁকে দেয় কাগজে। কিন্তু তার যে খিদে পেয়েছে বা বিকেল হলে তার পার্কে বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করছে, তা বলে বোঝাতে পারে না।
পুপুলের জন্যে তার মা বাবার মনে ভীষণ দুঃখ। তাঁদের বাড়িঘর সুন্দর। পড়শিরা সব মাটির মানুষ, কেবল এই একটা দুঃখ তাঁদের বড় কষ্ট দেয়।
পুপুল তার দাদুর নয়নের মণি। গগন তাঁর নাতনিকে একটু অন্য চোখে দেখেন। তাঁর কেমন একটা বিশ্বাস যে পুপুল গতজন্মে তাঁর মা ছিল। গগনবাবুর মা যখন পৃথিবী ছেড়ে চলে যান, তখন গগনের বয়স আড়াই কী তিন বছর। ছোট্ট গগন মানুষ হয়েছিলেন তাঁর জেঠিমার কাছে। তাঁর কাছে যত স্নেহ ভালবাসাই পেয়ে থাকুন তিনি, মা-র অভাব তাতে পূরণ হয়নি। মা-র প্রায় কোনও স্মৃতিই নেই তাঁর মনে। রয়েছে কেবল দেয়ালে টাঙানো এক ছবি— বাবার বন্ধু বিখ্যাত অতুল বসুর তোলা। সে ছবিতে মা চেয়ে আছেন তাঁর বড় বড় দুই চোখ মেলে। সেটা দেখে দেখেই ছোট থেকে এত বড়টি হয়েছেন গগন বসু।
মা চলে গেছেন কত কাল আগে, তার অনেক পরে এসেছে পুপুল। প্রায় তার জন্মের সময় থেকেই তাকে দেখে গগনবাবুর মনে হত তাঁর মা-ই ফিরে এসেছেন পুপুল হয়ে। শুধু দু’জনের মুখচোখে নয়, স্বভাবেও কিছু কিছু মিল চোখে পড়েছে তাঁর। মা মিষ্টি খেতে ভালবাসতেন। পুপুলও তাই। গগন শুনেছেন অফিস ফেরত বাবাকে রোজ কড়াপাকের সন্দেশ নিয়ে আসতে হত মা-র জন্যে, পুপুলকেও বাটিতে করে কমলাভোগ দিলে আর দেখতে হচ্ছে না, চেটেপুটে সে সব শেষ করবে তখনই। মা বৃষ্টি ভালবাসত, পুপুলও তাই। আষাঢ় কী শ্রাবণ মাসে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলে পুপুল জানলার ধারে বসে আকাশের দিকে হাত তুলে মুখে ‘আঃ আঃ’ করে বোধ হয় বলতে চায়, আরও বৃষ্টি হোক, আরও...।

মা’রও বর্ষা ছিল প্রিয় ঋতু। জেঠিমার মুখে শুনেছেন গগন, বৃষ্টি নামলে আলমারি থেকে ‘গীতবিতান’ বার করে মা গাইতেন। ‘আজি ঝরঝর বাদল দিনে...’

গগন ভালবাসেন শীতকাল। এই এক ঋতু, যখন বেড়িয়ে এবং শুয়ে বসে থেকে সমান আনন্দ পাওয়া যায়। সকালে শীতের রোদ্দুরে পার্কে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে যে মজা, সন্ধ্যায় গায়ে চাদর জড়িয়ে আগাথা ক্রিস্টির নভেল পড়ে সে-ই এক সুখ।

কষ্ট হয় তাঁর গরমের দিনগুলোয়। কষ্ট বা অসুবিধে যা-ই বলা যাক। বাড়িতে বসে স্বস্তি নেই, বাইরে বের হলে রোদের তাপে গা ঝলসে যায়। এ বছর মার্চ মাসের শুরুতেই বেশ গরম পড়ে গিয়েছে। তারিখটা দশই মার্চ হবে— দুপুরবেলায় হঠাৎ পুপুলের খুব শরীর খারাপ হল। পুপুলের বাবা মা দু’জনেই কাজে বেরিয়েছেন। গগন ডাক্তারকে ফোন করেন। ডাক্তার একটি বিশেষ ওষুধের নাম করে তখনই তা পুপুলকে খাইয়ে দিতে বলেন। পুপুলের আলমারি খুলে দেখা যায় সে ওষুধটা বাড়িতে নেই। এ দিকে পুপুল যন্ত্রণায় ছটফট করছে বিছানায়।

বাড়ির ওষুধ আসে ‘আরোগ্য’ নামে যে ওষুধ দোকান থেকে, সেখানে ফোন করতে দোকানের মালিক বলেন, ‘আজ হোম ডেলিভারির ছেলেটি আসেনি, মেসোমশাই। ওর মা-র অসুখ। আমি ওষুধ বার করে রাখছি, আপনি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন।’

বাড়িতে পুরুষমানুষ বলতে তখন তিনিই। তাই ছাতা হাতে বের হতে হয় গগনবাবুকে। ‘আরোগ্য’ গ্রিন পার্কের খুব কাছে নয়, এ রাস্তায় মোটর, বাস চলে বলে রিকশা চালানো বারণ। মাথার ওপর আগুন রোদ। গগন দু’পা হাঁটেন, একটু জিরান। এতটা পথ হেঁটে পাড়ি দেবেন কী করে, ভেবে পান না। যেন সাহায্য চেয়ে আকাশের দিকে মুখ তোলেন। অমনি এক কাণ্ড ঘটে। দাদু দেখেন তাঁর ঠিক মাথার ওপর ভেসে এসেছে এক জলভরা মেঘ। মেঘ নয়, যেন তাঁর মায়ের মুখ। আর রোদ লাগে না তাঁর গায়ে। গগন যেমন যেমন হাঁটেন, মেঘও তেমন তেমন তাঁর মাথার ওপর ছায়া দিতে দিতে ভেসে চলে তাঁর যাওয়ার পথে। তিনি ‘আরোগ্য’-র দরজায় এসে থামতে মেঘও থেমে যায় দোকানের বাইরে।

গগন দোকানের ভেতর পা দিতে কুণ্ডুবাবু বলেন, ‘এই যে মেসোমশাই, আসুন, আপনার ওষুধ রেডি।’ দাদু ওষুধ ঝোলায় ভরে দাম মিটিয়ে ‘আসি’ বলে পথে নামেন। মেঘও চলতে থাকে মাথার ওপর ভেসে ভেসে। দাদু বাড়ির দরজায় এসে পৌঁছতে মেঘও থামে দোরগোড়ায়। দরজা খুলতেই বেলাআন্টির কোল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুপুল দাদুর বুকের ওপর। এত ক্ষণ তাঁকে না দেখে বড় অস্থির হয়েছিল সে।

তখনই বৃষ্টি নামে। প্রথমে ঝিরিঝিরি, পরে ঝমঝমিয়ে। পুপুলকে ওষুধ খাইয়ে দেয় বেলাআন্টি। ঠাম্মা হাত বুলিয়ে দেয় মাথায়। অমনি ঘুম নামে তার চোখে। সে ঘুমোয় ওদিকে বৃষ্টি পড়ে চলে সমানে। সন্ধেবেলা মা-বাবা বাড়ি ফেরেন। হাসপাতালের কাজ শেষ করে আসেন ডাক্তার মিত্রও। পুপুলের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, ওষুধে কাজ হয়েছে। এখন ঘুমোক ও। কাল কেমন থাকে জানাবেন আমায়।’

পুপুলের ঘুম ভাঙে সকালেবেলায়। বৃষ্টি থেমে গেছে। চতুর্দিকে সকালের আলো। চোখে-মুখে জল দিয়ে ছুটে আসে দাদু পুপুলের বিছানার কাছে। শুয়ে শুয়েই পুপুল হাসে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে। দাদুর মনে হয় তাঁর মা যেন তাঁকে বলছেন, কেমন আছিস, খোকা?

দাদুর বুকের ভেতর বৃষ্টি পড়ে শুনতে পান তিনি।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy