Advertisement
E-Paper

প্রথম পৌষমেলায় খরচ ১৭৩২ টাকা ১০ আনা

পৌষ উৎসব-মেলাকে গুরুদেব তাঁর বিদ্যালয়ের শিক্ষাদর্শের সঙ্গে জড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা করেছিলেন।’— এক সাক্ষাৎকারে আমাদের এ কথা বলেছিলেন শান্তিদেব ঘোষ। অমিতা দেব বলতেন, ‘সাতই পৌষের উৎসব শান্তিনিকেতনের দুর্গোৎসব যেন। ভোরবেলায় বৈতালিকে ‘আমার মুখের কথা তোমার নাম দিয়ে দাও ধুয়ে’ গানটি দিনদার পাশে পাশে গেয়ে আশ্রম পরিক্রমা করতাম।’

পঙ্কজ সাহা

শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:০০
শান্তিনিকেতনে পৌষ উৎসবে রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গে আছেন ক্ষিতিমোহন সেন, সাগরময় ঘোষও।

শান্তিনিকেতনে পৌষ উৎসবে রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গে আছেন ক্ষিতিমোহন সেন, সাগরময় ঘোষও।

পৌষ উৎসব-মেলাকে গুরুদেব তাঁর বিদ্যালয়ের শিক্ষাদর্শের সঙ্গে জড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা করেছিলেন।’— এক সাক্ষাৎকারে আমাদের এ কথা বলেছিলেন শান্তিদেব ঘোষ। অমিতা দেব বলতেন, ‘সাতই পৌষের উৎসব শান্তিনিকেতনের দুর্গোৎসব যেন। ভোরবেলায় বৈতালিকে ‘আমার মুখের কথা তোমার নাম দিয়ে দাও ধুয়ে’ গানটি দিনদার পাশে পাশে গেয়ে আশ্রম পরিক্রমা করতাম।’ প্রমথনাথ বিশী বলেছিলেন, ‘সন্ধ্যার আগে খাওয়াটা বেশ রাজকীয় ধরনের হত। খাবার পরে আবার মন্দির, মন্দিরের সে কী আলোকসজ্জা!’ এমনই নানা জনের নানা অভিজ্ঞতার কথা আমরা প্রচার করতাম শান্তিনিকেতনের পৌষ উৎসব-পৌষমেলা নিয়ে আমাদের অনুষ্ঠানে। কলকাতা দূরদর্শনের একেবারে প্রথম বছর থেকেই দর্শকদের কাছে এটা হয়ে উঠেছিল একটা বিশেষ আকর্ষণ। গত বছর ১২০ বছর পূর্ণ হয়েছে এ মেলার। প্রথম পৌষমেলায় খরচ হয়েছিল ১৭৩২ টাকা ১০ আনা। মেলার রূপের কত পরিবর্তন হয়েছে! গত চল্লিশ বছরে আমাদের ক্যামেরাতে ধরা পড়েছে এই পরিবর্তনের নানা দিক। মেলার গ্রামীণ রূপের মধ্যে এসে পড়েছে নানান শহুরে প্রভাব। ধীরে ধীরে গাড়ি, টিভি, স্কুটার, কম্পিউটার ইত্যাদির স্টল জাঁকিয়ে বসেছে। কিন্তু সেই সাবেকি মেলার মাটির পুতুল, কাঠের জিনিস, গালার পশরা, সাঁওতালদের বাঁশের বাঁশি, তিরধনুক, রূপদস্তার গয়না, এ-সব হারিয়ে যায়নি।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম পৌষমেলার আয়োজন করেছিলেন কলকাতার কাছে গোরিটির বাগানে। তার পঞ্চাশ বছর পরে, ১৮৯৪ সালে, মহর্ষির ট্রাস্ট ডিড অনুসারে আনুষ্ঠানিক ভাবে শান্তিনিকেতনে পৌষমেলার সূচনা। অবশ্য পৌষ উৎসব শুরু হয়েছিল ১২৯৮ সালের ৭ পৌষ, ইংরেজি ১৮৯১ সাল সেটা। মহর্ষি কিন্তু কখনও শান্তিনিকেতনের মন্দির দেখেননি, মেলাও দেখেননি। ক্রমে মেলার গ্রামীণ চেহারাটার সঙ্গে সঙ্গে ঘরোয়া চেহারাটাও যেন উধাও হয়ে গেছে। এখন এটা এক বিপুল জনতার মেলা, বিশেষ করে ২৫ ডিসেম্বর ভিড় যেন একেবারে ভেঙে পড়ে। কিন্তু তারই মধ্যে মন্দিরে আয়োজিত খ্রিস্টোৎসব আমরা রেকর্ড করে দেখাই। ক্যামেরা নিয়ে যাই শান্তিনিকেতন আশ্রমিক সংঘের বার্ষিক অধিবেশনে, পরলোকগত আশ্রমবন্ধুদের স্মরণ-আয়োজনে, সাঁওতালদের খেলাধুলোয়, আর রাতের বাজি পোড়ানো দেখাতে। পুরনো দিনের স্মৃতিকথায় বাজির যে সুন্দর বিবরণী আছে, তার অনেকটাই দেখার এবং দেখানোর সুযোগ হয়েছে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, রাশিয়া— নানা দেশে বাজি দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার, কিন্তু শান্তিনিকেতনের বাজির যে সৃষ্টিশীল দিক, তা আর কোথাও দেখিনি। বিশেষ করে সব শেষের বাজিটিতে যে ভাবে ফুটে ওঠে রবীন্দ্রনাথের মুখ, তা সত্যিই মুগ্ধ হওয়ার মতো।

প্রায় প্রত্যেক ৭ পৌষ রবীন্দ্রনাথ মন্দিরে যে ভাষণ দিতেন, ‘... তিনি আজ এই পুণ্যদিনের প্রথম ভোরের আলোতে উৎসব দেবতার উজ্জ্বল বেশ পরে আমাদের সকলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন— জাগো, আজ আশ্রমবাসী সকলে জাগো’— রবীন্দ্রনাথের এমনধারা সব অনুভূতির কথা আমার ভাষ্যে দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিতাম। ১৯৯১-তে পৌষ উৎসবের শতবর্ষ লাইভ দেখানো হয়েছিল, ১৯৯৪-এ মেলার শতবর্ষও, বিশেষ ভাবে। মনে পড়ে, এক সময় ছাতিমতলায় উপাসনায় উপাচার্য সুরজিৎ সিংহ, গানে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, পাঠে সুপ্রিয় ঠাকুর, সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মন্ত্রোচ্চারণে মোহনলাল বাজপেয়ী, এঁদের পেতাম। মেলায় পুরনো আশ্রমিক আর প্রাক্তনীদের ভিড়, তারই মধ্যে হঠাৎ দেখা হয়ে যাচ্ছে শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে, শম্ভু মিত্র প্রাক্তন দু-এক জন ছাত্রীকে সস্নেহে কিনে দিচ্ছেন ছোট ছোট খেলনাবাটি, মেলায় এসেছেন অমর্ত্য সেন, ‘সেঁজুতি’ দোকানে গীতা ঘটক একের পর এক গান গেয়ে চলেছেন, অমিতাভ চৌধুরী মুখে মুখে ছড়া বাঁধছেন। ‘কালোর দোকান’-এ চলেছে তুমুল আড্ডা। সম্প্রতি মেলাতে ‘কালোর দোকান’ আর বসছে না। তবে বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী শর্মিলা রায় পোমো, শ্রীলা চট্টোপাধ্যায়, শিবাদিত্য সেনদের উদ্যোগে আয়োজিত হয় ‘চাঁদের হাট’। প্রকাশনা ও নানান সৃষ্টিশীল কাজের মধ্য দিয়ে শান্তিনিকেতনের অতীতের সঙ্গে বর্তমানের একটা যোগসূত্র রচনা করে চলেছে ‘চাঁদের হাট’।

দেখতাম, বিনোদন মঞ্চের পাশে সারা ক্ষণ মাথায় টুপি পরে বসে আছেন শান্তিদেব ঘোষ, মঞ্চের লোকসংস্কৃতির সব অনুষ্ঠান সামলাচ্ছেন। বাউলদের আখড়ায় রাত জেগে শুনছি সনাতন দাস বাউলের গান: ‘ও মন মাছ ধরতে বাসনা, ফেললে জাল জড়িয়ে পড়ে, ছড়িয়ে পড়ে না।’ আমাদের ক্যামেরা সারা দিনরাত সক্রিয় থাকত। অনেক পরিবর্তনের মধ্যেও যে সব কিছু হারায়নি, রেকর্ড করে রাখত এই সত্যটুকু।

pankajsaha.kolkata@gmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy