Advertisement
E-Paper

পাহাড়ী সান্যালের রান্নার লোক

ক্লাসিকাল সংগীত যে খুব ভাল বুঝি, তেমন দাবি করব না। তবে এই সংগীতের যে একটা মাদকতা আছে, সেটা অনেক আগেই বুঝে ফেলেছিলাম। পণ্ডিত রবিশংকরের সেতার কিংবা আমজাদ আলির সরোদ বা ভীমসেন জোশীর গান— সবই আমায় মোহিত করে তোলে। কেবল একটাই জিনিস আমার মোটে ভাল লাগত না। যাঁরা ক্লাসিকাল গান করেন, তাঁদের হাত আর মুখের অঙ্গভঙ্গিমা।

গুলজার

শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৫ ০২:৪৪

ক্লাসিকাল সংগীত যে খুব ভাল বুঝি, তেমন দাবি করব না। তবে এই সংগীতের যে একটা মাদকতা আছে, সেটা অনেক আগেই বুঝে ফেলেছিলাম। পণ্ডিত রবিশংকরের সেতার কিংবা আমজাদ আলির সরোদ বা ভীমসেন জোশীর গান— সবই আমায় মোহিত করে তোলে। কেবল একটাই জিনিস আমার মোটে ভাল লাগত না। যাঁরা ক্লাসিকাল গান করেন, তাঁদের হাত আর মুখের অঙ্গভঙ্গিমা। মুখ ঘন ঘন বেঁকায় বলে আমার টেনিস প্লেয়ার নাদালকে অবধি পছন্দ নয়! কিন্তু... কিন্তু এই অভ্যাসের ব্যতিক্রম ছিলেন এক জন। পণ্ডিত ভীমসেন জোশী। পণ্ডিতজি যখন গান করেন, তখন মনে হয় সুরটাকে ঘেঁটি ধরে ওপর থেকে নামিয়ে আনছেন, অথবা কোনও সুরকে এমন বকাবকি করছেন যে ওঁর গলায় সে বাধ্য ছেলের মতো যাওয়া-আসা করছে। ওঁর স্বরের যে বৈশিষ্ট্য, আমরা যাকে ‘টিম্বার’ বলি, সেটা অসামান্য ছিল। আর যে এনার্জি নিয়ে উনি গান গাইতেন— সেটা আমায় বড় টানত। আমার গাড়িতে সব সময় ভীমসেন জোশীর ক্যাসেট থাকত। তবে তাঁর গায়কির কোন খাঁজের কী বৈশিষ্ট্য, সে প্রশ্নের সদুত্তর আমি দিতে পারব না। এটুকু বুঝতে পারি, ওঁর গান শুনলে মনে হয় নিশ্চুপ পুকুরের ঠান্ডা জলে ডুব দিয়ে উঠলাম।

আমার এক বন্ধুর ছেলের জন্মদিন ১০ অক্টোবর। প্রতি বছর ১০ অক্টোবর ওর বাড়িতে পণ্ডিতজি আসতেন। আর আমরা মনপ্রাণ দিয়ে গান শুনতাম। এক বার বিনোদ খন্নার জন্মদিনে, বিনোদ ঠিক করল, কোনও ঝিনচ্যাক পার্টি হবে না। পণ্ডিতজিকে আমন্ত্রণ করা হবে। ওই দিন কেবল ওঁর গান হবে। গেলাম গান শুনতে। বিনোদ ঠেলেঠুলে আমায় সামনে পাঠিয়ে দিল। আমি তো জড়সড় হয়ে বসে আছি। অত বড় এক জন শিল্পী, তাঁর একদম সামনে বসে শুনব? আমার সামনের সারিতে ডিরেক্টর রাজ খোসলা বসে ছিলেন। গান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখি উনি বারবার মাথা নাড়ছেন আর ‘ওয়া ওয়া’ বলছেন। হঠাৎ পণ্ডিতজি মাঝপথে গান থামিয়ে ওঁকে বললেন, ‘আরে মশাই, আপনি তো দেখছি বাউন্ডারি মারার আগেই ওয়া ওয়া করছেন। বরং একটু পেছনে গিয়ে বসুন তো। আর এই যে, আপনি, সামনে এসে বসুন।’ আমায় সামনে ডেকে নেওয়ায় আমি আরও নার্ভাস হয়ে পড়লাম! এই বুঝি ভুল জায়গায় মাথা নাড়িয়ে ফেলি, সেই ভয়ে কাঠ হয়ে বসে থাকলাম।

আর আমার সৌভাগ্য দেখুন, আমিই কিনা ফিল্মস ডিভিশনের কাছ থেকে ওঁর ওপর তথ্যচিত্র তৈরির বরাত পেলাম। ভীমসেন জোশী আদতে পুণের লোক। ওঁর ছোটবেলা খুব সুখকর নয়। সৎমা। স্কুল যাওয়া-আসার পথে একটা রেকর্ডের দোকানে করিম খানের গান বাজত, আর ছোট্ট ভীমসেন মুগ্ধ হয়ে সেই গান শুনতেন, শুনে শুনে নিজে গাওয়ার চেষ্টাও করতেন। বয়স তখন এগারো। এক দিন, রুটিতে ঘি কম মাখিয়েছে মা, এই নিয়ে রাগারাগি করে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। ঘটনাটা যখন উনি আমায় বলেছিলেন, আমি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘একটা রুটিতে ঘি কম মাখিয়েছে, আর আপনার সৎভাইয়ের রুটিতে ঘি বেশি মাখিয়েছে, এ জন্য আপনি বাড়ি ছেড়ে পালালেন?’ উনি খুব ক্যাজুয়ালি উত্তর দিলেন, ‘ধুর! আমি তখন গান শিখতে চাইছিলাম। বাড়ি থেকে পালিয়ে গান শিখতে হত। তাই পালানোর একটা ছুতো খুঁজছিলাম মাত্র।’

তখনই উনি শুনেছিলেন গ্বালিয়রে নাকি খুব ভাল ক্লাসিকাল মিউজিকের চর্চা হয়। আর হাফিজ আলি খান সাহেব, মানে আমজাদ আলি খানের বাবা, খুব বড় সঙ্গীতজ্ঞ। বিনা টিকিটে ট্রেনে উঠে পড়লেন। গন্তব্য গ্বালিয়র। কিন্তু টিকিট চেকার তাঁর তাগিদের মর্ম কী বুঝবে? জরিমানার পয়সা তো নেই‌ই। অতএব ট্রেন থেকে নামিয়ে শ্রীঘরে পাঠিয়ে দিল। এই ভাবে কোথাও ক’দিন জেলে কাটিয়ে, কোথাও রাস্তায় শুয়ে থেকে, ফের বিনা টিকিটে ট্রেনে উঠে, ফের চেকারের গলাধাক্কা খেয়ে, তিন মাস পর পৌঁছলেন গ্বালিয়রে। উনি খুব মজা করে আমায় বলেছিলেন, ‘এই তিন মাসের জার্নিতে, আমি যদি কোনও সুরের বোদ্ধাকে পেয়ে যেতাম, তাকে প্রায় ধরেবেঁধে করিম খান সাহেবের গান শোনাতাম। সাহস ভাবো আমার। কোনও কোনও চেকার গান শোনার পরেও আমায় কান ধরে ট্রেন থেকে নামিয়ে লক-আপে পুরে দিত।’

হাফিজ আলি খানকে গান শুনিয়েছিলেন। চমকে গিয়েছিলেন খান সাহেব। এত কমবয়সি একটা ছেলের গলায় ধ্রুপদ গানের এমন সম্ভাবনা! উনি ভর্তি করে দিলেন গ্বালিয়রের সিন্ধিয়া স্কুলে। স্কুলে তালিম পেতেন বটে, তবে তেমন শিখতে পারতেন না। রেওয়াজ ছিল ওঁর একমাত্র নিস্তার। নিজে নিজেই রেওয়াজ করতেন। তবে কিনা স্কুল যেতেই হত, কারণ এক বেলা ফ্রি খাবার জুটত। আর রাতের দিকে নাকি খান সাহেবের খাবার সময় তাঁরই বাড়িতে ঘুরঘুর করতেন, ফলে রাতের খাবারও জুটে যেত ওখানেই। খান সাহেবও পাকা জহুরি ছিলেন, তা না হলে, এত কম বয়সে নিজে উনি দরবারি শেখাতেন না ভীমসেন জোশীকে।

এই তালিমে কেটে গেল দুটো বছর। এখানেই পণ্ডিতজি শুনেছিলেন, কলকাতায় ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় বলে এক জন গুরু আছেন, যিনি ভগবান। পালিয়ে এলেন কলকাতায়। কিন্তু শিখবেন কী করে? সে খবরও জোগাড় হল। অভিনেতা পাহাড়ী সান্যালকে গান শেখাতে আসতেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়। ভীমসেন জোশী কাজ নিয়ে নিলেন পাহাড়ী সান্যাল মশায়ের বাড়িতে। রান্না করতেন, টিফিন কেরিয়ারে করে খাবার পৌঁছে দিতেন সিনেমার সেটে, আর চুরি করে গান শিখতেন।

কী? চমকে গেলেন বাঙালি?

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy