Advertisement
E-Paper

বাহন

ট্রে ন থেকে নেমে দাঁড়িয়েছিলাম রিকশার খোঁজে। প্রায় দিন যে বয়স্ক রিকশাওয়ালার রিকশায় যাই, সে তখন সওয়ারি তুলে ফেলেছে। আমাকে দেখেই বলল, ‘দাঁড়ান দিদিমণি, এই কাছেই যেতে হবে, মালটাকে ফেলে দিয়েই আসছি।’ ‘মাল’?

কিঙ্কি চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৬ ০০:০০
ছবি: সুমিত্র বসাক।

ছবি: সুমিত্র বসাক।

ট্রে ন থেকে নেমে দাঁড়িয়েছিলাম রিকশার খোঁজে। প্রায় দিন যে বয়স্ক রিকশাওয়ালার রিকশায় যাই, সে তখন সওয়ারি তুলে ফেলেছে। আমাকে দেখেই বলল, ‘দাঁড়ান দিদিমণি, এই কাছেই যেতে হবে, মালটাকে ফেলে দিয়েই আসছি।’ ‘মাল’? চমকে দেখি, এক জোড়া বুড়ো-বুড়ি। বুড়োর গালভর্তি দাড়ি, কোলে মস্ত এক পোঁটলা, আর বুড়ির সিঁথেয় ডগডগে সিঁদুর, কপালে রসকলি, পায়ে চওড়া আলতা ও হাওয়াই চটি। ভাবলাম, আমাকেও তা হলে লোকটি ‘মাল’ই ভাবে?

মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে যখন হাঁটু টনটন, একটু এগিয়ে উঠলাম এক টোটো-গাড়িতে। গাড়িগুলো দেখতে চমৎকার, ব্যাটারিতে চলে। ভাড়া রিকশার চেয়ে কম। চার জনের বসার ব্যবস্থা। স্পিড প্রায় রিকশারই মতো। পোঁ...ও...ও করে ভাঙা-ভাঙা সুরে নাচতে-নাচতে চললুম। যাদের রক্তে শর্করার পরিমাণ বেশি, তাদের প্রত্যহ না হেঁটে, সেই সময়টা টোটোয় চাপলেই হবে। হাঁটার থেকেও বেশি উপকার— সারা শরীরের ব্যায়াম হয়ে যাবে। মিউনিসিপ্যালিটির বদান্যতায় রাস্তাঘাটের অবস্থা— ঘামে ধুয়ে যাওয়া অভিনেত্রীর সাজের মতো খাপছাড়া।

গাড়িতে আরও দুটি অল্পবয়সি কলেজপড়ুয়া মেয়ে ছিল। আমার ভয় দেখে তারা প্রবল উৎসাহে হিসেব দিতে লাগল, কবে-কবে, কোথায়-কোথায় টোটো ভেঙে পড়েছে। ড্রাইভার-ছেলেটি এত ক্ষণ ধরে চুপচাপ শুনছিল। এ বার রেগে গিয়ে বলল, ‘আমার নতুন গাড়ি, ভাঙার কোনও চান্সই নেই মাসিমা। যেগুলোর কথা ওরা বলছে, ওগুলো পুরনো গাড়ি। আপত্তি থাকলে সিঙ্গিলে (সিগন্যাল) নামিয়ে দিচ্ছি, চলে যান।’ আমি চোখের ইশারায় মেয়ে দুটিকে থামতে বললাম, কারণ মাঝরাস্তায় অটো বা রিকশা পাওয়া খুব মুশকিল।

মফস্‌সলের অটো আবার অতি ভয়ংকর। পিছনে গুঁতোগুঁতি করে চার জন, সামনে আরও চার জন। তিন নম্বর ব্যক্তি হলে, চার নম্বরের কোমর থেকে একটি পা আপনার কোলের ওপর চেপে বসার সম্ভাবনা প্রবল। গাড়ি থামলে, কেবলমাত্র চতুর্থ ব্যক্তিকে যদি নামতে হয়, আর এক প্রস্থ কসরত। যেন, হাঁড়ির ভিতরে কিংবা গ্রিলের ভিতরে অসাবধানতাবশত মাথা ঢুকে গেছে, কিছুতে বের করা যাচ্ছে না। গন্তব্যে যদি চার জনই নামে, তা হলে আধ মিনিট লাগবে তৃতীয় ও চতুর্থ ব্যক্তির পায়ের গিঁট ছাড়াতে। মাঝে মাঝে চার জনের সহাবস্থান একান্ত অসম্ভব হলে, ড্রাইভার পারমুটেশন কম্বিনেশনের আশ্রয় নেয়। ‘বোনটি তুমি পাতলা আছো, চলে যাও চার নম্বর জায়গায়। আর এই যে জেঠু-দা, আপনি চলে আসুন সামনে, আপনার চেহারাটা ভারী আছে।’

পিছনের সিটে বসার আবার নিয়ম আছে। একেবারে ডান দিকের জন এগিয়ে, তার পরের জন পিছিয়ে বসবে। তৃতীয় ব্যক্তিকে আবার এগোতে হবে। তখন রসুনের কোয়ার মতো একটি ফাঁক তৈরি হবে, সেখানে চতুর্থ ব্যক্তিকে একটু উঠে দাঁড়িয়ে সেঁধোতে হবে। তৃতীয় এবং প্রথম ব্যক্তি লম্বা হলে তাদের হাঁটু গিয়ে ঠেকবে পার্টিশনে, ফলে অটো রাস্তায় বার তিনেক ঝাঁকুনি খেলেই নুনছাল উঠে যাবে।

অটোতে যদি বেশ কয়েক জন ছাত্রছাত্রী থাকে, তা হলে তাদের ব্যাগ রাখার একটা এইটুকু জায়গা আছে, পিছনের সিটের পিছনে। ব্যাগের সংখ্যা বেশি হয়ে গেলে ল্যাপটপ ও বইসুদ্ধ ব্যাগগুলো অটো চলার তালে তালে ক্রমাগত হড়কে হড়কে ঘাড়ের ওপর নেমে আসতে থাকবে। পিছনের চার জনের প্রত্যেককে তখন তাদের নিজের নিজের ঘাড়ের সাহায্যে ব্যাগগুলোকে ঠেলে ধরে রাখতে হবে। ভালই, এই লোকগুলোর স্পন্ডিলোসিস হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।

সবচেয়ে নিরাপদ: ড্রাইভারের পাশের সিট। কিন্তু সেখানে বিড়ির গন্ধ ফ্রি পাওয়া যাবে। ড্রাইভার যদি বিড়ির বদলে রজনীগন্ধা বা শিখর খায়, তা হলে সে পারতপক্ষে কথা বলবে না, কারণ তার মুখভর্তি থুতু। ডান দিকের সওয়ারি নেমে গেলেই সে এক বার করে মুখ নামিয়ে থুতু ফেলে নেবে রাস্তায় (এরা সম্ভবত মোদীর স্বচ্ছ ভারতের স্লোগানের কথা জানে না)।

মোড়ের মাথায় ট্রাফিক সিগনালে যদি সার্জেন্ট থাকে, তা হলে আগেভাগেই ড্রাইভারদের কাছে খবর থাকে। ড্রাইভারের ডান দিকে সওয়ারি নেওয়া নিষেধ। তাই, ডান দিকে যে থাকে, মোড় আসার একটু আগেই তাকে নেমে যেতে হয়, তার পর মোড় পেরিয়ে একটু এগিয়ে, আবার তুলে নেয়। এক বার ড্রাইভারের ডান দিকে বসে কী বিপত্তি! সে বলল, ‘ম্যাডাম, নেমে যান। মোড়টা পার হয়ে আমি দাঁড়াব, আপনি ছুট্টে উঠে আসবেন আমার গাড়িতে।’ সে দিন টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল, আমি আমার বেতো হাঁটু নিয়ে যথাসাধ্য দৌড় লাগালাম। হোঁচট খেয়ে পড়বি তো পড় এক সার্জেন্টের গায়ে। সে অতি ক্ষিপ্রতায় আমাকে ধরে না ফেললে কী হত বলা মুশকিল। অত্যন্ত বিস্ময়ে আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে সে বলল, ‘ম্যাডাম, এই বয়সে আনাড়ির মতো দৌড়চ্ছেন কেন?’ আমি তো আর বলতে পারলুম না, দূর থেকে হতভাগা অটো ড্রাইভার গলা বের করে নির্নিমেষে আমার দিকে তাকিয়ে আছে অস্থিরমতি প্যাসেঞ্জার নিয়ে। আমার পৌঁছতে দেরি হলে অটো ছাড়তে দেরি হবে, আর তারা কুট কাটবে!

যাকগে, আমার টোটো পোঁ...ও...ও করতে করতে বাঁ দিকের একটা গলিতে ঢুকে পড়ল। কী, না ব্যস্ত সময়ে বড় রাস্তায় টোটো চালানোর পারমিশন নেই, পুলিশে ধরবে। এ বারের প্রবল বর্ষায় মাঠ-পুকুর-গলির রাস্তা সব একাকার। এর উঠোনের পাশ দিয়ে, ওই পুকুরের পাশ দিয়ে টোটো যেতে লাগল। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, আমাদের সবসুদ্ধ নিয়ে পুকুরেই না নেমে যায়। বলেই ফেললাম, ‘আমি কিন্তু সাঁতার জানি না।’ ছেলেটির স্মার্ট উত্তর, ‘একদম টেনশন করবেন না মাসিমা, পুকুরটা মজে গেছে, জাস্ট কোমর অবধি জল। বর্ষায় ডুবে আছে বলে ও রকম মনে হচ্ছে।’

হঠাৎ মনে পড়ে গেল একটা ঘটনা, বছর পাঁচেক আগের। ট্রেন ধরব বলে রিকশায় চেপেছি। তখন টোটো তো ছিলই না, মফস্‌সলে অটোর এত দাপাদাপিও ছিল না। ডেলি প্যাসেঞ্জাররা সব সময় ট্রেন ধরতে মাথায়-মাথায় সময় নিয়ে বের হয়। সওয়ারির থেকে তখন রিকশাওয়ালার টেনশন বেশি। আমার কাছে ট্রেনের সময় শুনে ঘড়ি দেখে সে বলল, ‘আর একটু আগে বেরোতে পারেন না? ঠিক আছে, দেখছি।’ কিন্তু দেখবে কী, অচিরেই তার পকেটে মোবাইল বেজে উঠল। আমি নাচার হয়ে, কিছু দূর যাওয়ার পর তার পিঠে হাত ঠেকিয়ে বললাম, ‘একটু জোরে টেনে দাও না ভাই, তা হলে ট্রেনটা পেয়ে যাই।’ সে বিরক্ত হয়ে বলল, ‘দেখছেন না, ফোনে কথা বলছি!’

আমার ঠিক আগে একটা রিকশা যাচ্ছিল। রিকশাওয়ালা মনে হল খুব রসিক। হাত নেড়ে-নেড়ে জোরে জোরে সওয়ারির সঙ্গে গল্প করতে করতে চলেছে। গা জ্বলে গেল। নিজের যখন টেনশন হয়, তখন অন্য লোকে আনন্দে আছে দেখলে কার মাথা ঠিক থাকে! স্টেশন আসার ঠিক আগে, প্রতি সেকেন্ডে ঘড়ির কাঁটা দেখে হিসেব করছি, রেলের ঘড়ির থেকে আমার ঘড়ি দেড় না দু’মিনিট এগিয়ে— হঠাৎ দেখি সামনের রিকশাটা হড়হড় করে রেলের ঝিলের দিকে নেমে যাচ্ছে। আরে! আরে! ধর-ধর! বলতে না বলতেই রিকশা উলটে গেল। ভাগ্যিস সামনে একটা বড় গর্ত ছিল! নইলে ভরা ঝিলের মধ্যে রিকশা পড়লে হয়েছিল আর কী! লাফ দিয়ে নেমে দেখলাম, আমার পাড়ার এক বৃদ্ধ দম্পতি গড়াগড়ি খাচ্ছেন। রিকশাচালক মদ খেয়ে চুর। বুঝলাম, তাই এত হাত নেড়ে-নেড়ে গল্পের ঘটা। সে দিন ট্রেন মিস, কিন্তু শিক্ষা হল। রিকশা দর করার সময় নিজের ঘ্রাণশক্তির ওপর যথেষ্ট আস্থা রেখে তবেই রিকশায় চড়তে হবে।


kinkichattopadhay@yahoo.co.in

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy